দর্শনের আলোকে
প্রথম পর্ব
স্বাতী ভৌমিক
(আত্মোপলব্ধির প্রয়োজনীয়তা)
দর্শন বিষয় শেখায়, খোলামনে জগতের মুখোমুখী হতে। দর্শনে একই বিষয়ে বিরোধী মতবাদ দেখা যায়। তাও তারা বইয়ের পৃষ্ঠায় সমমর্যাদায় স্থানলাভ করেছে, যা প্রমান করে মুক্তচিন্তার দার্শনিক প্রেক্ষাপট।
পৃথিবীতে পার্থিব হোক বা অপার্থিব সবক্ষেত্রেই দার্শনিকগণ তাঁর স্বীয়মতকে সর্বজনগ্রাহ্য করে তোলার প্রচেষ্টায় বদ্ধপরিকর। তারজন্য যে যাঁর মতো করে মত উপস্থাপিত করেছেন ও অন্য মতবাদের গ্রহণযোগ্যতার উপর প্রয়োজনে আলোচনা করেছেন। পরে স্বীয় মতবাদের অনুগামীদের নিয়ে সেই সম্প্রদায়ের নামকরণ হয়েছে। কিন্তু সর্বোত্তম এর তকমা বা একমাত্র স্বীকার্য বক্তব্য বলে কোনো মতবাদই চূড়ান্তভাবে পরিগনিত হয়নি।
দৃশ্যমানজগতে দৃশ্যমান ব্যাপারেই সর্বসম্মত মতবাদ গ্রহণ করা সম্ভব হয়না, সেখানে অনুভূতিগম্য জগৎ বা বুদ্ধিলব্ধ জগৎ তো আরো বৃহৎ ও ইন্দ্রিয়াতীত। সেখানে সকলে একমত হওয়াটা নিতান্তই অসম্ভব কল্পনা ছাড়া আর কিছুই নয়।
তবে হ্যাঁ, জীবকেন্দ্রিক এই জগতে সেই মতবাদ-ই বেশী ব্যাক্তিমন ছুঁয়ে যায়, যে মতবাদ জীবের জীবনের সমস্যাগুলোকে যত সহজে সমাধান করতে পারে। মতামত আলাদা হতেই পারে তবে সব দার্শনিক আলোচনার লক্ষ্য হোলো জীবকল্যান। এই লক্ষ্যেই দার্শনিক আলোচনা ও অগ্রগতি সেই সুপ্রাচীন কাল থেকে আজও অব্যাহত।
🍂
দর্শন শুধুমাত্র একটি বিষয় নয়। "দর্শন "এর অর্থ দেখা। কিন্তু এই দেখা বাহ্যিক অর্থে শুধু দেখা নয়। বাহ্যিক দেখার অন্তরালে যে বৃহত্তর উপলব্ধির জগৎ আছে দৃষ্টিশক্তি প্রসারিত করে দর্শন আমাদের তা দেখতে শেখায়। দর্শন হোলো আমাদের জীবনের গভীরতম উপলব্ধি। প্রত্যেকের জীবনদর্শন আলাদা। এই জীবনআলেখ্য দর্শনের জন্য চাই শান্তভাবে প্রক্ষেপিত গভীর অন্তরদৃষ্টি। বাইরের কোলাহলে আমরা যা শুনতে পাইনা, সেই নীরবতার মর্মকথা দর্শন আমাদের শুনতে শেখায়। জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত থেকে প্রাপ্ত উপলব্ধি ক্ষণিক সাক্ষাতের পর যা ঠাঁই নেয় অচেতন অথবা অবচেতন মনের চিলেকোঠায়, দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গী তার সাথে পরিচয় ঘটায়।
ব্যাক্তিমন নিয়ত সুখ অন্বেষনে ব্যাস্ত। এই সুখকেই আবার শান্তির সমার্থক বলে ব্যাক্তিমন ভুল ভাবে। বাহ্যইন্দ্রিয়ের তথা চোখ,কান, নাক, জিহবা,ত্বক-এই পঞ্চইন্দ্রিয়ের সাথে তাদের বিষয়ের সংস্পর্শের ফলে যে অনুভূতি মানবমন প্রাপ্ত হয়, তা হোলো সুখ-দুঃখের উৎসারক।কিন্তু শান্তি অনেকটাই আত্মিক বিষয় -যা আত্মা বা আমাদের প্রকৃত সত্তার সাথে সম্পৃক্ত। বাইরের জগতের ভোগ্যবিষয়ের থেকে যে সুখ আসে তা এই সত্তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। আত্মউপলব্ধি -পূর্ণতার অনুভবেই সত্তা শান্তি অনুভব করে। নিয়ত এই বাহ্যজগতের বিষয়বাসনা তথা টাকা- সম্পত্তি ইত্যাদি এসবের চিন্তায় মগ্ন থেকে ক্ষণিক জোয়ার -ভাঁটার স্রোতে ভেসে ব্যাক্তিসত্তা শান্তি পায় না।সে সর্বদা চায় স্থায়ীত্ব। কিন্তু এই জড়বিষয় তো স্থায়ী নয়-পরিবর্তনশীল। তাই ইহজাগতিক বিষয় প্রাপ্তির সাথে সাথে হারানোর ভয়টাও ব্যাক্তি মনকে অস্থির রাখে। সংরক্ষণের চিন্তা বা পরিবর্তনশীলতা ব্যাক্তি অন্তরকে অস্থির করে তোলে। আর চিরউৎকণ্ঠার মধ্যে কখনো শান্তি আসতে পারে না।
অন্তরে সন্তুষ্টি ও পূর্ণভাবের উপলব্ধিই ব্যাক্তিমনকে শান্ত করতে পারে। ব্যাক্তি যখন এটা উপলব্ধি করতে পারে যে,বাহ্যজগতে ইন্দ্রিয়বিষয় অন্বেষনে নয়, সন্তুষ্টির মধ্যেই শান্তি থাকে,তখনই এই উৎকন্ঠার সমাপ্তি ঘটে।
উপলব্ধি মানব অন্তরকে সমৃদ্ধ করে। ভোগাকাঙ্খা কখনোই চিরভোগতৃপ্তির উপায় হতে পারে না। নিজের পূর্ণতাকে উপলব্ধি করলে, তবেই এই ভোগাকাঙ্খা ও তারজন্য পাগলপ্রায় ব্যর্থ অনুসন্ধান ভাব প্রশমিত হয়। মানব অন্তঃকরনে এক প্রশান্তি ভাব আসে। এটাই শান্তির অনুভব। আর এটাই সত্তার প্রকৃত কাম্য বিষয়।এই শান্তির জন্য প্রয়োজন আত্মিক জ্ঞান, আত্মস্বরূপ উপলব্ধির। দেহসম্পৃক্ত ভোগ্যবিষয় একসময় নাএকসময় হয় পরিবর্তিত অথবা অন্তর্হিত হবেই। এতে দুঃখী হওয়ার কিছু নেই। চেতনসত্তাস্বরূপ যে "প্রকৃত আমি"তা-ই হোলো অপরিবর্তনীয়-শাশ্বত।
কোনকিছুর খোঁজ -অন্বেষন প্রকারান্তরে তার অভাবকে সূচীত করে-তা অনুভূতির সীমাবদ্ধতা হোক্ বা বাস্তব ব্যাপার সম্পর্কিত যা-ই হোক্। কিন্তু পূর্ণতার আনন্দ-অনুভূতি হোলো সদর্থক ভাবের আধার।আর এখানেই রয়েছে শান্তির উৎস।
অশান্ত মন অশান্ত জীবনের পটভূমি তৈরি করে। মানুষ -ই হল একমাত্র জীব যার বিবেক বোধ আছে। ভালো-মন্দ যুক্তিসহকারে বিচার করতে পারে। এই বিচার ক্ষমতাই মানুষকে সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব হিসেবে পরিচিতি দিয়েছে। তাই এই বিবেক জ্ঞান জাগ্রত করে জীবনকে আলোর পথে নিয়ে গেলেই মানুষ প্রকৃত শান্তি পেতে পারে। নাহলে ফুটো কলসিতে জল ভরলে কলসি ভর্তির আশা যেভাবে নিরাশায় পর্যবসিত হয়, বিবেকবোধে জীবন নির্বাহ না করলে জীবনে শান্তি -পূর্ণতার আশাও ঠিক সেভাবেই নিরাশায় পর্যবসিত হতে বাধ্য। মানব আত্মা অনন্ত জ্ঞানের উৎস। শুধু সেদিকে সজাগ অন্তর দৃষ্টি প্রদানের প্রয়োজন।
সুখ শান্তির চাবিকাঠি ব্যক্তির নিজের কাছেই রয়েছে। ব্যক্তি নিজ মনকে জ্ঞানালোকে যত আলোকিত করতে পারবে, ততই নিজেকে পূর্ণ বলে উপলব্ধি করতে পারবে ও বাইরের জগতের ক্ষণিক -অস্থায়ী সুখ ও শান্তি অন্বেষণের প্রচেষ্টা থেকে বিরত হবে।
ক্রমশঃ...
0 Comments