জ্বলদর্চি

আন্তর্জাতিক মহামারি প্রতিরোধ দিবস/দোলনচাঁপা তেওয়ারী দে

আন্তর্জাতিক মহামারি প্রতিরোধ দিবস

দোলনচাঁপা তেওয়ারী দে 

আজ ২৭শে ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক মহামারী প্রস্তুতি দিবস। এই দিনটি সাধারণত মহামারী প্রতিরোধ প্রস্তুতি ও সচেতনতার গুরুত্ব বোঝাতে পালিত হয়। দিনটি সম্পর্কে আসুন বিস্তারিতভাবে জেনে নিই।

বর্তমান বিশ্ব একে অপরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত। যোগাযোগ ব্যবস্থা, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও যাতায়াতের বিস্তারের ফলে যেমন উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়েছে, তেমনি সংক্রামক রোগ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকিও বেড়েছে। ইতিহাসে প্লেগ, কলেরা, স্প্যানিশ ফ্লু, সার্স, ইবোলা এবং সর্বশেষ কোভিড-১৯ মহামারি মানবসভ্যতাকে বারবার চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। এই বাস্তবতা উপলব্ধি করেই জাতিসংঘ প্রতি বছর ২৭শে ডিসেম্বর দিনটিকে আন্তর্জাতিক মহামারি প্রস্তুতি দিবস হিসেবে পালন করার সিদ্ধান্ত নেয়।

দিবসটির পটভূমি সম্পর্কে বলতে গেলে বলা যায় যে,
২০২০ সালের ডিসেম্বরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ সর্বসম্মতিক্রমে এই দিবস পালনের প্রস্তাব গ্রহণ করে। কোভিড-১৯ মহামারি বিশ্বব্যাপী লক্ষ, লক্ষ মানুষের প্রাণহানি ঘটায় এবং অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যব্যবস্থা ও সামাজিক জীবনকে গভীরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এই অভিজ্ঞতা বিশ্ববাসীকে শেখায় যে মহামারি মোকাবিলায় শুধু চিকিৎসা নয়, বরং পূর্বপ্রস্তুতি, সচেতনতা এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা অত্যন্ত জরুরি। সেই উপলব্ধি থেকেই এই দিবসের সূচনা।
🍂

মহামারি হল, এমন একটি সংক্রামক রোগ, যা দ্রুত বিস্তৃত হয়ে বহু দেশ বা মহাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে সৃষ্ট এই রোগগুলো অল্প সময়ের মধ্যে ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। প্রস্তুতির অভাবে স্বাস্থ্যব্যবস্থা ভেঙে পড়ে, চিকিৎসা সেবা ব্যাহত হয় এবং সাধারণ মানুষের জীবন বিপন্ন হয়। তাই মহামারি শুরু হওয়ার আগেই প্রস্তুতি গ্রহণ করা গেলে প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি অনেকাংশে কমানো সম্ভব।
দিবসটির উদ্দেশ্য
আন্তর্জাতিক মহামারি প্রস্তুতি দিবসের মূল উদ্দেশ্যগুলো হল,
মহামারি প্রতিরোধ ও মোকাবিলায় সচেতনতা বৃদ্ধি
শক্তিশালী ও কার্যকর স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে তোলা
বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও টিকাদান কার্যক্রমে গুরুত্ব দেওয়া।উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি
ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে মহামারি সম্পর্কে শিক্ষিত করা
কোভিড-১৯ থেকে শিক্ষা
কোভিড-১৯ মহামারি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যে স্বাস্থ্য নিরাপত্তা ছাড়া কোনো উন্নয়ন টেকসই নয়। হাসপাতালের অভাব, অক্সিজেন সংকট, চিকিৎসাকর্মীদের সুরক্ষা ঘাটতি এবং ভুয়া তথ্যের বিস্তার পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে। একই সঙ্গে এই মহামারি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির গুরুত্বও তুলে ধরে—যেমন দ্রুত টিকা উদ্ভাবন, ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবা এবং তথ্য বিনিময়।
স্বাস্থ্যব্যবস্থার ভূমিকা
একটি শক্তিশালী স্বাস্থ্যব্যবস্থা মহামারি মোকাবিলার প্রধান হাতিয়ার। পর্যাপ্ত হাসপাতাল, প্রশিক্ষিত চিকিৎসক ও নার্স, আধুনিক পরীক্ষাগার এবং জরুরি চিকিৎসা সরঞ্জাম থাকা অত্যন্ত প্রয়োজন। পাশাপাশি গ্রামীণ ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য সহজলভ্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করাও মহামারি প্রস্তুতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

মহামারি প্রতিরোধে কেবল সরকার বা আন্তর্জাতিক সংস্থার উদ্যোগই যথেষ্ট নয়, সাধারণ মানুষের সচেতন ভূমিকা অপরিহার্য। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা, টিকাদান গ্রহণ, গুজব এড়িয়ে চলা এবং অসুস্থ হলে দ্রুত চিকিৎসা নেওয়া—এসবই সামাজিক দায়িত্বের অংশ। এই দিবস মানুষকে সেই দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
আন্তর্জাতিক সহযোগিতা
মহামারি কোনো দেশের সীমানা মানে না। তাই এর মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক সহযোগিতা অপরিহার্য। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO), জাতিসংঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা তথ্য আদান-প্রদান, গবেষণা ও টিকা সরবরাহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। উন্নত দেশগুলোর উচিত দরিদ্র দেশগুলোর পাশে দাঁড়ানো, যাতে বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়।
উন্নয়নশীল দেশের চ্যালেঞ্জ
উন্নয়নশীল দেশগুলোতে জনসংখ্যার চাপ, দারিদ্র্য, অপুষ্টি ও স্বাস্থ্যসেবার সীমাবদ্ধতার কারণে মহামারি মোকাবিলা আরও কঠিন হয়ে পড়ে। এই দিবস উন্নয়নশীল দেশগুলোর সমস্যাগুলো তুলে ধরে এবং টেকসই সমাধানের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

শিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রে এর গুরুত্ব অনেক।
ভবিষ্যৎ মহামারি প্রতিরোধে শিক্ষা ও গবেষণার বিকল্প নেই। নতুন রোগ শনাক্তকরণ, ওষুধ ও টিকা উদ্ভাবনে বৈজ্ঞানিক গবেষণা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পাশাপাশি স্কুল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্বাস্থ্য শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আরও সচেতন হয়ে উঠবে।
আন্তর্জাতিক মহামারি প্রস্তুতি দিবস কেবল একটি দিবস উদযাপন নয়; এটি একটি সতর্কবার্তা ও দায়িত্বের স্মারক। মহামারি আমাদের শেখায় যে মানবসভ্যতার নিরাপত্তা পারস্পরিক সহযোগিতা ও প্রস্তুতির ওপর নির্ভরশীল। সময়মতো পরিকল্পনা, শক্তিশালী স্বাস্থ্যব্যবস্থা এবং সচেতন নাগরিক সমাজ গড়ে তুলতে পারলেই ভবিষ্যৎ মহামারি মোকাবিলা করা সম্ভব হবে। এই দিবস আমাদের সেই লক্ষ্যেই এগিয়ে চলার অনুপ্রেরণা জোগায়।

Post a Comment

0 Comments