জ্বলদর্চি

তিব্বতের লোকগল্প (পাথরের সিংহ)/ চিন্ময় দাশ

  দূরদেশের লোকগল্প (তিব্বত)

চি ন্ম য়  দা শ

পাথরের সিংহ 

চার দিকে পাহাড় দিয়ে ঘেরা দেশটা। সে দেশে এক পাহাড়ের তলায় বাস করে দুই বুড়াে-বুড়ি। দুই ছেলে নিয়ে তাদের সংসার। কোনও অভাব নাই সংসারে। ঘরখানা তাদের বড়সড়ই। চাষের জমিজিরেতও আছে বেশ কয়েক বিঘা। বুড়াে মারা যাবার পর, বড় ছেলেটা হাল ধরল সংসারের। ঘরবাড়ি, জমিজমা সবই সে দেখাশােনা করে।


বুড়ির দুই ছেলে দুই ধাতের। বড় ছেলেটা যেমন কর্মঠ, তেমনি চালাক-চতুর। আর ছােটটি তার ঠিক উলটো। যেমন রােগা-পটকা, তেমনই বােকাসােকা মানুষ। তবে মানুষটা ভারি সহজ সরল। সব সময় চেষ্টা করে বড়ভাইয়ের কাজেকর্মে হাত লাগিয়ে সাহায্য করবে। কিন্তু সে পেরেও ওঠে না, আবার বুঝেও ওঠে না, কোন কাজটা করলে দাদার সাহায্য হয়।

একদিন বড়ভাই তাকে ডেকে বলল- "চিরকাল তােমার মত অকম্মার ধাড়িকে বসিয়ে বসিয়ে খাওয়াব, এটা ভেবাে না। তার চেয়ে সময় থাকতে বিদেয় হও। নিজের পায়ে দাঁড়াবার চেষ্টা কর বাইরে কোথাও গিয়ে। এ সংসারে আর নয়।”

মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল ছােটর। কিন্তু কারও প্রতিবাদ করা তার স্বভাব নয়। সাহসও নাই তেমন। কী আর করে ? মাকে গিয়ে বলল দাদার হুকুমের কথা।

বুড়ি তো অবাক। তার পেটের ছেলের মনে এমন হিংসে। বুড়ি বলল- “চল বাছা, আমিও যাব তাের সাথে। যে সংসারে ভাই ভাইকে দেখে না, সেখানে আর নয়। দুজনেই বেরিয়ে যাই এ সংসার থেকে।” সামান্য কাপড়-চোপড়, দু-চারটে টুকিটাকি জিনিস গুছিয়ে নিয়ে, ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল দু'জনে।

কিছুদূর গিয়ে, একটা বড় পাহাড়ের তলায় এসে থামল মায়ে-পােয়ে। ফাঁকা একটা কুঁড়েঘর দেখে, ভাবল এখানেই থেকে যাই আজকের রাতটা। তাতেই ঢুকে পড়ল দু 'জনে। ঘরে কিচ্ছুটি নাই। একেবারে খাঁ-খাঁ শূন্য ঘর। মানে, যে গেছে সে আর ফিরবে না বলেই গেছে।

কিন্তু সাথে একটি দানাও নাই, পেটে দেবার মত। একটা কুড়ুল ছিল সাথে। সকাল হতে, সেটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ল ছেলেটা।

সূয্যি যখন মাথার উপর, ভালাে মতন এক বােঝা কাঠ কাটা হয়েছে। খুশি মনে বাজারে গিয়ে, বােঝাটা বিক্রি করে দিল সে। তখন আর পায় কে ছেলেটাকে। জীবনের প্রথম উপার্জন। কিছু খাবার-দাবার কিনে ঘরে ফিরে এল ছেলে। মা বলল- “তবে আর ভাবনা কী, বাছা। দুটো পেট এভাবেই চলে যাবে।” পরদিন আবার সকাল হতে না হতেই কাধে কুড়ুল ফেলে, বেরিয়ে গেল ছেলে। 

উপরে নিশ্চয় ভালাে কাঠ পাওয়া যাবে, এই ভেবে পাহাড়ের বেশ খানিকটা উপরে উঠে কাজে লাগল সেদিন। কিছু কাঠ কাটা হয়েছে। হঠাৎ তার চোখে পড়ল, একেবারে আস্ত এক সিংহ তার সামনে। তবে কি না, জ্যান্ত নয়। প্রমাণ সাইজের পাথরের এক সিংহ।

ছেলেটা ভাবল, এ সিংহ নিশ্চয়ই এই বন-পাহাড়ের ঠাকুর। সব কিছুর পাহারাদার। সাথে সাথেই মনে হােল, তাহলে তাে এর দয়াতেই পেটে দুটি অন্ন জুটেছে কাল। এর দয়া হলেই, কপাল ফিরতে পারে আমাদের। অমনি সিংহের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল ছেলেটা। মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে গড় করল পাথরের ঠাকুরকে।

সেদিন হাটে গিয়ে কাঠ বিক্রির পয়সায় প্রথমে দুটি ধূপকাঠি কিনে রাখল সে। পরের দিন সােজা সিংহের সামনে এসে হাজির হল ছেলেটা। ধূপ জ্বেলে সিংহের দু'দিকে পুতে দিল কাঠি দুটি। মাথা ঠেকিয়ে একেবারে গড় হয়ে প্রণাম করল ঠাকুরকে। হল কী, যেই ধূপের ধোঁয়া লেগেছে, অমনি চোখের পাতা মেলে তাকাল সিংহ। বলল- "কে তুমি ? কোথা থেকে এলে এখানে ? আর এসেছই বা কেন?”

প্রথমে একটু চমকে গেল ছেলেটা। তারপর তার সব কথা খুলে বলল ঠাকুরকে। শেষে বলল- "বড়ভাই তাড়িয়ে দিল। তাই মাকে নিয়ে চলে এসেছি। তাইতাে ঢুকেছি তােমার বন-পাহাড়ে। কাঠকুটো কেটে বুড়ি মাকে দুমুঠো খেতে দিতে হবে তাে।” রাগ নয়, মনে ভারি দয়া হােল সিংহের। বলল- "কাল আবার এসাে আমার কাছে। এমন জিনিস দেব, মায়ের সব অভাব পূরণ করতে পারবে তুমি। আর শােন, সাথে একটা ঝুড়ি নিয়ে এসাে কিন্তু। মনে রেখাে, ঝুড়ি যত বড় হবে, তােমার লাভ তত বেশি।”

একটা ঝুড়ি কিনে, ছেলেটা পরদিন আবার এল সিংহের কাছে। ধূপ জ্বেলে প্রণাম করল প্রথমে। ধূপের ধোঁয়ায় চোখ মেলে চাইল সিংহ- "এবার যা বলি, মন দিয়ে শােন। তােমার ঝুড়িটা আমার মুখের সামনে পেতে দাও। সোনা-রুপা ঝরে ঝরে পড়বে ঝুড়িতে। তবে নজর রেখাে। ঝুড়ি ভরে এলে, সাথে সাথে জানাবে আমায়। একটি দানাও যদি মাটিতে পড়ে যায়, সব চলে যাবে তােমার। কিছুই থাকবে না হাতে। মনে থাকে যেন।” 

সিংহের কথা মত ঝুড়ি পেতে দেওয়া হল তার মুখের সামনে। অমনি ছােট-বড় দানায় সোনা-রূপা ঝরে ঝরে পড়তে লাগল সিংহের মুখ থেকে। ঝুড়ি যখন ভরে এসেছে, ইঙ্গিত করে দিল ছেলেটা। অমনি সােনা-রূপাে ঝরাও বন্ধ হয়ে গেল।

এক ঝুড়ি সােনা-রূপাে। এ সবই তার নিজেের? ভাবতেই পারছেনা ছেলেটা। সবই এই সিংহঠাকুরের দান। ঝুড়ি থেকে বেছে বেছে এক আঁজলা বড় বড় সােনার দানা তুলে নিল ছেলেটা। সিংহের পায়ে প্রণামী হিসাবে দিয়ে মাথা ঠেকাল মাটিতে - "অসীম দয়া তােমার, ঠাকুর।" সিংহও এবার অবাক। বেছে বেছে সােনাই তাকে প্রণামী দিয়েছে ছেলেটা। তাও আবার বড়গুলােই। এমন সরল আর নির্লোভ মানুষ হয় না কি? 

সিংহ হেসে বলল- “খুব সন্তুষ্ট হয়েছি তােমার ওপর। প্রণামীর সােনাগুলােও ঝুড়িতে তুলে রাখাে। সবই তােমার।" যেই প্রণামী সােনাগুলাে ঝুড়িতে রাখা হল, অমনি ঝুড়ির রুপােগুলােও সব সােনা হয়ে গেল। সিংহ হেসে বলল- “এটা তােমার সরলতা আর ভালমানুষীর পুরস্কার। বাড়ি যাও। ঘর-বাড়ি, জমি-জিরেত, মােষ-ভেড়া সব জোগাড় করে ফেলাে। সুখে থাকো মাকে নিয়ে।" 

সিংহ যেমনটি বলেছিল, এক এক করে সব হােল তাদের। অনেক জমিজমা কেনা হােল। বাড়ি বানানাে হােল বড় করে। গরু-মহিষ-ভেড়া-ছাগল হােল গােয়ালভরা। এখন গােটা এলাকায় তাদের মত বড়লােক কেউ নাই। অত সুখেও নাই কেউ তাদের মত। 

খবর বাতাসে ওড়ে। বড় ভাইয়ের কানে গেল এদের অবস্থা ফেরার কথা। শুনে সে ছেলের তাে বিশ্বাসই হয় না। তার বউ বলল- “চলাে না, একবার নিজেদের চোখে দেখে আসি গিয়ে।"

দু’জনে এসে হাজির হােল ছােটর বাড়ি। দেখে যেন বিশ্বাসই হয় না বড়র। কী করে এই অসম্ভব সম্ভব হয়! কৌতুহল চাপতে না পেরে, সে প্রশ্নই করে ফেলল ভাইকে। ছােট তাে বরাবরই সরল মানুষ। সে গড়গড় করে সব বলে গেল বড়ভাইকে। শেষে বলল- “আমি পথের হদিশ বলে দেব, তুমিও চলে যাও একটা ঝুড়ি নিয়ে।” 

বড় তাে এটাই চাইছিল। তার বউ চুপি চুপি বলল- “শােন, এমন মওকা আর পাওয়া যাবে না। কালকেই বেরিয়ে পড়াে তুমি।" তাদের যেন আর তর সয় না। খুঁজে পেতে বাজারের সবচেয়ে বড় একটা ঝুড়িও কিনে এনে রাখল। সকাল হতে না হতে, বন-পাহাড় পেরিয়ে সিংহের সামনে এসে হাজির হােল বড়। প্রথমেই দুটো ধূপবাতি জ্বেলে দিল সে। 

অমনি চোখ মেলে সিংহ বলল- “তুমি আবার কে ? এখানে এলে কেন?” বড় তাড়াতাড়ি বলল- “আমি তাে কিছু জানতামই না। আমার ভাই-ই আমাকে পাঠালাে জোর করে। দয়া করে আমাকেও এক ঝুড়ি সোনা দাও, ঠাকুর।" 

বিশাল একটা ঝুড়ি এনেছে সাথে। চাইছোও কেবলই সোনা। সামান্য মুচকি হাসি হাসল সিংহ- “যা বলছি মন দিয়ে শােন। ঝুড়ি ভরে যাবার আগেই জানাবে আমাকে। একটা সোনা যদি মাটিতে পড়ে যায়, বিপদ হবে তোমার।” বড়র তখন তর সইছে না। সে বলল- “সবই আমি ভাইয়ের কাছে জেনে এসেছি। এ নিয়ে ভাবতে হবে না।" 

বড়র চাহিদামত, সােনা-ই পড়তে লাগল ঝুড়িতে। সােনা পড়ছে, ছেলেটা থেকে থেকেই ঝাঁকিয়ে দিচ্ছে ঝুড়িটা। আসলে যাতে সােনার মাঝে একটুও ফাঁকফোকর না রয়ে যায়, সেদিকেই তার নজর।

ঝুড়িটা কানায় কানায় ভরে এসেছে। কিন্তু বড় কোনও ইঙ্গিত করছে না সিংহকে। তার চাহিদা আর একটা সোনা পড়ুক। আর একটা, আরও একটা!

ভাবতে ভাবতেই ঝুড়ি ভর্তি হয়ে গেছে। এবং একটি সোনার চাকতি ঠং করে মাটিতে পড়ে গেল। অমনি সাথে সাথে বন্ধ হয়ে গেল সােনা ঝরাও। কিন্তু সিংহের মুখ তখনও খােলা। সিংহ বলল- “এটা কী করলে তুমি? বেশি লােভ করতে গিয়ে সব খোয়ালে। তাছাড়া, আমার কী হবে এখন?”

বড় বলল- “কেন, তােমার আবার কী হােল ? ” সিংহ ককিয়ে উঠল-"আরে সবচেয়ে বড় সোনার চাকতিটা তাে আমার গলায় আটকে গেল। দেখছাে না, হাঁ করে আছি।” 

বড় বলে উঠল- “এ নিয়ে ভেবাে না। আমি বের করে দিচ্ছি।“ বলেই ডানহাত ঢুকিয়ে দিল সিংহের মুখে। অমনি কপ করে সিংহ কামড়ে ধরল হাতখানা। যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠল ছেলেটা। কিন্তু পাথরের সিংহ পাথরের মতই স্থির হয়ে রইল। চোয়াল আলগা করল না একটুও।

যন্ত্রণায় প্রাণ যাবার জোগাড় ছেলেটার। সে কত কাকুতি মিনতি করল। সিংহ তখন জোর এক কামড় বসাল। হাতটাই কেটে নিল কুট করে। এদিকে অত বড় ঝুড়িটাও একেবারে শূন্য সােনার একটা কণাও নাই আর তাতে। বুক ফেটে কান্না বেরিয়ে এল বড়র গলা দিয়ে-- “হায় ভগবান, আমার হাত ? “

এবার সিংহ কথা বলল- “যে হাত বুড়াে মাকে ভাত দেয় না, ছােট ভাইকে পথে বের করে দেয়, সে হাতের জন্য হাহাকার করতে নাই। ঘরে ফিরে যাও। যাদের একদিন দয়া করােনি, তারাই দয়া করবে তোমাকে।“ 

কাঁদতে কাদতে ফিরে এল বড়ভাই। সব শুনে, ছােট তার মাকে বলল- “দাদা আর কোথায় যাবে একটা হাত নিয়ে। এখানে আমাদের সাথেই থাকুক ওরা দু'জনে।“ 

সেই থেকে চারজনে একসাথে থাকে। সুখে শান্তিতেই থাকে তারা। বছরে একদিন পাহাড়ে যায় ছােট। ধূপ জ্বেলে প্রণাম করে আসে পাথরের সিংহঠাকুরকে।
 _______________________________
প্রতি মঙ্গলবার প্রকাশিত হচ্ছে দূরদেশের লোকগল্প। 
অভিমত জানাতে পারেন।  jaladarchi@yahoo.in           

Post a Comment

0 Comments