জ্বলদর্চি

ঘোড়াডিহির অন্তর্ধান রহস্য- ৪ /গৌতম বাড়ই

ঘোড়াডিহির অন্তর্ধান রহস্য

 গৌ ত ম  বা ড় ই

 পর্ব-৪

সালতামামির ডায়েরীটা পড়া কি গর্হিত কাজ হচ্ছে?মনে মনেই প্রশ্ন জাগলো আমার।আবার ভাবছি আমায় তো ওর কথা জানতেই হবে এই উদ্ভূত পরিস্থিতিতে।সে আমারও ডায়েরী এমন একটা ঘটনা যদি আমি ঘটাতাম তাহলে সালতা পড়লেও আমি কিছু মনে করতাম না। সালতামামির নামটাও তো পাগলামি।সায়ন্তন কে সালতামামি করেই ওর যত লেখালেখি শুরু হলো আর আমাদেরকেও বলে দিলো আজ থেকে একটাই নাম আমার,পদবী নেই।মানে জাত ধর্ম কিছুই নেই।মেঘবর্ণা দাশ সোদপুর, তিনিও দেখি তার কিছুদিন পর নাম পাল্টে স্যোশাল সাইটে সোচ্চার হলেন।জেন্ডার শুন্য।নির্ভয়াকে নিয়ে তোলপাড় চলছে তখন।মেঘেরোদহাসির সম্ভবত চাকরিটি গিয়েছে এই করোনাকালে।সে প্রসঙ্গে পরে আসছি।একদিন হঠাৎ করেই সালতা আর মেঘ একসাথে থাকতে শুরু করে।তারপর এই ফ্লাটটি কেনে।ওখানের সবাই জানে ওরা স্বামী-স্ত্রী।সোদপুরের ওদের বাড়িও আত্মীয়স্বজনকে তাই বলে দিয়েছে।আমি জানি আর একমাত্র আমি জানি আমরা তিনজনে কী!তবে আমি নাম পাল্টাই নি।পদবীতেও বিশ্বাস নেই।আছে চলছে এখনও এই আর কী।
ডায়েরীর পাতায় মহামারীর ছোঁয়াচ লেগেছে দেখছি একটু একটু করে।আমি একটু এগিয়ে গিয়ে এক জায়গায় পড়তে শুরু করলাম।


১৫-ই ফেব্রুয়ারী রাত দেড়টা

চিন নাকি মারণ ভাইরাস সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিয়েছে।কী হিম্মত রে মাইরি!এশিয়া তো জবর খবর দেখছি এখন।মেডিকেল টিপস সরঞ্জাম সবের যেমন এক চেটিয়া চৈনিক ব্যবসা পৃথিবীতে আর তেমনি নিঃশব্দে বড় বড় বায়ো মেডিক্যাল রিসার্চ সেন্টার করে তো আমেরিকা আর ইওরোপকে তাক লাগিয়ে দিচ্ছে।আমেরিকা কত্তো মহান রে মাইরি?ভিয়েতনাম ভুলে গিয়েছে? হিরোশিমা আর নাগাসাকি?ইরাক ইরাণ আফগানিস্তান সব স্মৃতি থেকে লোপাট!একটা বদখত লোককে নিয়ে আমাদের হাউডি নাচ খুব ভালো লাগলো দেখছি দেশপ্রেমিকদের?সারা দুনিয়াটা ক্রমে একটা ভার্চুয়াল জগতে ডুবে যাচ্ছে। মিডিয়ার ঝলকানি তৈরী খবর চিন্তাশক্তিহীন উন্মাদনা।মেঘকে বললাম ডুববি শিগগিরই দেখ।
মেঘ কালকে গায়ের কাছে বসে গরম গরম নিঃশ্বাস নিচ্ছিলো।আমি বললাম তোর জন্য আমার আজ কিছু লেখা হবে না।স্কুল করে তো সময় থাকে না।আজ পবিত্র খিদের সমাপ্তির পর মেঘ নাক ডাকাচ্ছে এখন। আমি রাতের গভীরতায় এবারে ব্যালকনীতে গিয়ে বসবো।ঝিলের জলের অন্ধকারেই আমার চেতনায় আলেয়ার আলো দু একটি বিন্দু ঝলসে উঠবেই।

আমার এই একটু লেখা পরম শান্তি আমার।আমার দিনযাপনের মৌন ইতিহাস।জানি মেঘ আমার ভেতরে যতই বৃষ্টি ঝড়াক ও আমাকে বাঁধতে চাইবে না।আর যতই জেন্ডার শুন্য হোক এই নারীদেহ অন্যকথা বলে।সুপ্রিয়র কি হাসি দেখেছিলাম হাজরা মোড়ে আমার ঠোঁটে আমিষ মাখা কিস করে বলে তুই না কত সেক্সী!বদখত পেঁয়াজ গন্ধ।ছ্যাঁ!মেঘ পাশে ছিলো,বলল-তৃতীয় লিঙ্গের সোহাগ পেয়ে ক্যামন লাগলো গা?আজ ঠোঁটটা ডেটল দিয়ে ধুবি।আমি বললাম---অনুভব করছি।পরে বলবো।সুপ্রিয় আমার বন্ধু। খুব সুন্দর লেখে।তবে সব ব্যপারেই সে খুব নাছোড়।আমায় বলে এলজিবিটি তো বৈধ এখন।আমায় সুপ্রিয়া বলেই ডাকতে পারিস ডার্লিং।

এবার ফেব্রুয়ারীর শেষের দিকে একটা বড় লেখার দিকে নজর গেলো।ডেটটা আন্ডারলাইন করা।

২৭-শে ফেব্রুয়ারী রাত-২টো

কোভিড-১৯ ভাইরাস তো আমেরিকা আর ইওরোপে ছড়িয়ে পড়েছে।সেই পুরানো ঐতিহাসিক পথ ধরে চিন থেকে মধ্যপ্রাচ্য হয়ে ইওরোপ আমেরিকায়।অণুজীবেদের ও কি ইতিহাস জানা আছে!আমি লিখি ভালো লাগে তাই। ছোটবেলার সেই স্কুলের কথা মনে পড়ে গেলো আজ।অঙ্কের স্যার,আমরা তখন শিক্ষকদের বিশেষণে সম্মানে ডাকখোজে ভরিয়ে দিতাম,জগদীশ বাবু স্যার।আর বাইরে হাতি নামে ছাত্রমহলে এই ডাকনাম জনপ্রিয় ছিল।কী যে অঙ্ক করাতেন ঐ দুচারটি সুবোধ বালক ছাড়া ক্লাসের বাদবাকি শুধু গাট্টাই খেয়ে যেতেন।আমিও।আমায় অঙ্ক খাতা দেখিয়ে বললেন-গোরুর ল্যাজ ধরেও এই ক্লাসের বৈতরণী পার হতে পারবি না।তারপর প্রকাশ্যে চূড়ান্ত অপমান।আমার মুখ দিয়ে ভেতরের যন্ত্রণায় অস্ফুট স্বরে বেরিয়ে এলো--হাতি।ব্যাস আর কোথায় নিস্তার পাই! অভিভাবক, হেডমাস্টার, বেত্রাঘাত, একটা অপরাধীর যা যা দাওয়াই সব চললো।ঐ নৃশংসতা আজও ভুলিনি।মনে মনে হাতির মৃত্যু চেয়েছিলাম।আর অনেক বছর পর শুনেছিলাম হাতি ট্রেনে কাটা পড়ে মারা গিয়েছে।হাতি মানে আমাদের জগদীশ স্যার।আমার আবার সেইসময় এ শুনে খুব খারাপ লেগেছিল।তার অস্তিত্ব মুছে গেল পৃথিবী থেকে।কী হয়েছে এখন খালি পুরানো কথা ঘুরে ফিরে মনে আসছে।তবে মেঘ আমাকে বন্ধনে ফেলতে চাইছে।বুঝতে পারছি।জানিনা তোর সাথে এই যৌথ থাকা ঠিক হল কিনা?তোর শরীরে যখন ডুবে যাই তখন কিন্তু আমার পুরুষত্ব জেগে ওঠে।আর তুই একটা কুহক মায়াবিনী হয়ে আমায় গিলে গিলে খাস।

এই পর্যন্ত পড়বার পর থমকে গেলাম।না হে!এতো মেঘকে জানাতেই হয়--তোদের প্রাইভেট জগতে কিন্তু সালতার লেখার সাথে ঢুকে পড়ছি।এটা ঠিক হচ্ছে না।হয়ত মেঘ কিছুই বলবে না বা দুকলম কাঁচা খিস্তি।সালতামামির ডায়েরী ওল্টাতে লাগলাম।

এরপরে এই পাতাটির লেখাটি পড়লাম একটু এগিয়ে।

২৪-শে মার্চ ২০২০
ঘোড়াডিহি রাত দুটো

সমীর কুমার মিত্র। ৫৭বছর বয়স। গতকাল কলকাতায় প্রথম কোরোনা ভাইরাসে আক্রান্ত মৃত ব্যক্তি।
মানুষ কত অসভ্য অসামাজিক হারামীর বাচ্চা সেটা প্রমান করে দিচ্ছেন এই ব্যক্তির মৃতদেহ ঘিরে। যেখানে মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন তাঁর দেহ দ্রুত সৎকার করতে। কিন্তু নিমতলা শ্মশানে একদল স্থানীয় পাপী আর বেজন্মা মানুষ সৎকার করতে বাধা দিচ্ছেন। অথচ এই অসভ্যগুলো বুঝছে না মৃতদেহ বেশিক্ষণ রাখা মানেই সংক্রমণ ছড়াবার আশংকা আর যারা সেখানে বাধা দিচ্ছে তাদেরও সংক্রামিত হবার আশংকা রয়েছে। এদেরকেও হয়তো প্লাস্টিকে মুড়েই শ্মশানে ফেলতে হবে।এরাই দেশটাকে বারোটা বাজানোর জন্য দায়ী।লকডাউনের শুরু থেকেই বিপত্তি শুরু হয়ে গেলো বোধহয়।এবার চলবে হয়তো সামাজিক ধ্বংসলীলা।লীলার কতই মহিমা দেখবো বলেই এখন বসে থাকি।

তবে আমায় একবার উজানে ভাসতেই হবে এবং তা অল্পদিনের মধ্যেই।


শেষের লাইনটি পড়েই আমি হঠাৎ তড়াক করে বসে পড়লাম।উজানে ভাসতেই হবে,মানে?উত্তরে।ওর দেশ বাড়িতে।ওখানে এখন তো ওর আপন বলে কেউ নেই জানি।তাহলে?কালকে কথাচ্ছলে মেঘকে জিগ্গেস করবো।

আবার সালতামামির ডায়েরীর পাতায় ব্যোমকেশ বক্সী হয়ে  নজর করতে শুরু করলাম।ওর লেখায় কোন মামুলী কথা নেই।আর মামুলী কথার ছেলে সালতা নয়।

এরপর পর্ব পাঁচে----

Post a Comment

0 Comments