জ্বলদর্চি

আবৃত্তির পাঠশালা- ১/শুভদীপ বসু

আবৃত্তির পাঠশালা
পর্ব- ১

শুভদীপ বসু

আবৃত্তি কী ও কেন

লকডাউনের সময় সমাজ মাধ্যমে যে শিল্পটি জনপ্রিয়তা থেকে অতি জনপ্রিয়তা পেয়েছে তা আবৃত্তি শিল্প। খুব সজাগ ভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে নৃত্য, অংকন বা সংগীতের তুলনায় আবৃত্তিশিল্পীর পাল্লা ভারী। অবশ্য আগের তুলনায় এখন আবৃত্তির প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষার্থীর পরিমাণ অনেক বেড়েছে। অভিভাবক অভিভাবিকারা মনে করছেন আবৃত্তি শেখার প্রয়োজনীয়তা আছে। সকলে যে একজন দক্ষ আবৃত্তিশিল্পী হবেন এমন নয় ভালোভাবে স্পষ্ট উচ্চারণে কথা বলার জন্য বহু শিক্ষার্থী মা-বাবার হাত ধরে প্রতিষ্ঠানে আসছে।
 পূর্বে এই শিল্পটিকে আড়চোখে দেখা হতো অনুষ্ঠানে দুটো গানের মাঝে ফিলার হিসেবে  বা নৃত্যের পর সতরঞ্চি তোলার সময় আবৃত্তিশিল্পী চান্স পেত কবিতা বলার। এখন সময় পাল্টেছে একক আবৃত্তি অনুষ্ঠান, আবৃত্তি নিয়ে নানা এক্সপেরিমেন্ট, ব্যান্ড, আবৃত্তিতে আলোও নৃত্যের ব্যবহার শিল্পকে একটা আলাদা প্ল্যাটফর্ম দিয়েছে। একজন আবৃত্তির কর্মী হিসেবে আমার কাছে এটা অত্যন্ত আনন্দের।শুধু ছোটরাই নয় কলেজপড়ুয়া থেকে গৃহবধূ, শিক্ষক থেকে ভিন্ন পেশার অনেকেই এই শিল্পকে ভালোবেসে শিখতে আসছেন ও পরিচিতিও পাচ্ছেন। আবার অনেকেই খুব কম জানার জায়গা থেকেই কম সময়ে পরিচিতি পাওয়ার জন্য অল্প কিছু জেনে 'লাইভ' করে দিচ্ছেন। প্রশংসা যে পাচ্ছেন না এমন নয় আসল কথা এই 'লাইভ'-র যুগে পায়ে পা দিয়ে, থুড়ি মোবাইলের ডাটা খরচ করে ঝগড়া করবে কে? তাই 'ভালো হয়েছে', 'বাঃ', 'অসাধারণ' লিখে এড়িয়ে যাওয়াই ভালো। আমি আবৃত্তির পণ্ডিত নই। দীর্ঘদিন শিখতে শিখতে যে অভিজ্ঞতা হয়েছে সেই বিশ্বাস থেকেই এই প্রবন্ধ লেখার তাগিদ। চারি পাশে এতো ভুল উচ্চারণ, ভুল অভিব্যক্তি শুনে যখন ক্লান্ত হই তখন মনে হয় একটু শিখলে ক্ষতি কি?

আবৃত্তি কী ও কেন?

আবৃত্তি মানে কিছু মানুষের সামনে কিছু বলতে আসা।এর উৎস লুকিয়ে আছে 'আবৃত্ত' শব্দটার মধ্যেই। পূর্বশ্রুত, পূর্বে পরিচিত কোনও বিষয়ের পুনর্বিবরণ দেওয়াই হলো আবৃত্তি। যিনি আবৃত্তি করছেন তিনি তাঁর আবেগ, অনুভব, বক্তব্য শ্রোতাদের কাছে পৌঁছে দিতে চান। তিনি বলবেন- শ্রোতারা শুনবেন। এই সংযোগটা যেন অবিচ্ছিন্ন থাকে। আবৃত্তিকারের বাচনভঙ্গিতে, কণ্ঠস্বরের উত্থান-পতনে উচ্চারণে অভিব্যক্তিতে এমন একটা মায়া থাকবে যা শ্রোতাদের সমগ্র কথনকাল জুড়ে টেনে টেনে রাখবে। এই কথন শোষিত মানুষের কথাই হোক বা প্রেমাকাঙ্ক্ষা বা ঈশ্বরের কথা। আবৃত্তিকারের আত্মমগ্নতায় শ্রোতারা যাতে তাকে অনুসরণ করতে বাধ্য হন। এই সময়কালে যে অমৃত মুহূর্ত সৃষ্টি করবেন সেই নন্দিত আস্বাদ আসরের পর আসরে, নানা সময়ে, নানা পরিবেশে যেন বারবার ফিরে ফিরে আসে।
ইংরেজি পরিভাষায় আবৃত্তি মানে recitation আর ফার্সিতে Recite এর অর্থ হল স্মৃতি থেকে কিছু বলা আবার ইতালিতে একে বলা হয় recitetito -এর অর্থ হল স্মৃতিনির্ভর পাঠ। বচন মানে উক্তি, উচ্চারিত কথা বা বাক্য ও বচনের বিশেষণ হলো বাচনিক যার আভিধানিক অর্থ হল মৌখিক। আবৃত্তি শব্দটি তাই ব্যাপক অর্থে আকার নিল বাচিক শিল্প নামে যেখানে শ্রুতি নাটক, সঞ্চালনা এমনকি সংবাদ পাঠকও বাচিক শিল্পের মধ্যেই স্থান পেল। তাই কন্ঠনির্ভর শিল্প বাচিক শিল্প যার সিংহভাগ জুড়ে রয়েছে আবৃত্তি।

  আবৃত্তির একটি সংজ্ঞা রবি ঠাকুর বহু আগেই দিয়ে গেছেন "আমাদের মনের ভাব যখন বেগবান হয় তখন আমাদের কণ্ঠস্বর উচ্চ হয়, নইলে অপেক্ষাকৃত মৃদু থাকে।" সচরাচর জীবনে আমরা যে স্বরে কথা বলি সেটা মাঝামাঝি স্বর। ইংরেজিতে যাকে বলে throught register। এই স্বরে কথা বলতে আলাদা করে কোনো আয়াসের  প্রয়োজন হয় না। কোনও শ্রম লাগে না কিন্তু উচ্চস্বরে head register বা নিচু স্বরে কথা বলতে গেলে মাংসপেশি শ্রম দাবি করে। আমরা যখন শান্তভাবে কথা বলি আমাদের কথার স্বর অনেকটা একঘেঁয়ে হয়। সুরের উঁচু-নিচু খেলে না কিন্তু মনোবৃত্তির তীব্রতা যতই বাড়ে ততই আমাদের কথার সুর উঁচু-নিচু হয়। আমাদের গলা নীচু থেকে উঁচু পর্যন্ত ওঠানামা করতে থাকে।

   আবৃত্তিতে অভিনয়ের মত প্রবল স্বরভঙ্গির প্রয়োজন না হলেও বিভিন্ন ভাব প্রকাশের একটা স্বরভঙ্গির সাহায্য নিতেই হয়। ক্রোধের ভাব প্রকাশে স্বর একটু তীব্র হবে এবং মাঝে মাঝে শব্দ প্রকাশে একটু বিরতি দিতে হবে। দুঃখের ভাব প্রকাশে ভাঙা ভাঙা বিষণ্ণ গলা, ভয়ের ভাবে নিচু ও হতাশা যুক্ত কণ্ঠস্বর সৃষ্টি করতে হবে। বীর ভাবে একটু দীপ্তস্বর প্রয়োগ করা উচিত। কষ্টের ভাব প্রকাশে কান্নার ভাব থাকবে না বটে কিন্তু স্বরের একটু ভাঙা ভাঙা ভাব ও গাম্ভীর্য চাই। আনন্দজনক ভাব প্রকাশে নরম আনন্দ জনক কণ্ঠস্বর প্রক্ষেপণ করতে হয়।

 ভাব ও রস অনুযায়ী কণ্ঠস্বর ব্যবহারের কথা ভাবা দরকার। লয় তিন প্রকার দ্রুত, মধ্য ও বিলম্বিত। হাস্য ও শৃঙ্গার রসে মধ্যলয়, করুণে বিলম্বিত লয় এবং বীর, রৌদ্র, অদ্ভুত, বীভৎস ও ভয়ানক রসে দ্রুত লয় প্রযুক্ত হতে পারে।

  আবৃত্তির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছন্দজ্ঞান।ভালো ছন্দজ্ঞান ছাড়াও অনেক সময় অশিক্ষিত পটুত্ব নিয়ে কাজ চালানো যায় কিন্তু তাতে ভুলের সম্ভাবনাই অধিক। কাজেই আবৃত্তি অনুশীলনের জন্য ছন্দ সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান লাভ করা একান্তই কর্তব্য।

  নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর একটি কবিতায় আছে-" আঁকতে পারি চক্ষু তাহার আঁকতে পারি নাক,/নকল চুলে লুকিয়ে রাখা মস্ত বড় টাক,/ ঠোঁটের পাশে কাজল দিয়ে বানিয়ে তোলা তিল, কিন্তু সবটা মিলিয়ে মুখ আঁকাই তো মুশকিল।"- আবৃত্তি আসলে এটাই।(ক্রমশ...)
---------------------------
প্রতি মঙ্গলবার প্রকাশিত হবে এই ধারাবাহিক।  অভিমত(jaladarchi@yahoo.in) জানাতে পারেন।

জ্বলদর্চি পেজ-এ লাইক দিন।👇


Post a Comment

0 Comments