জ্বলদর্চি

ভীমাচরণ বাগলী ছিলেন প্রথম সারির স্বাধীনতা সংগ্রামী/মঙ্গলপ্রসাদ মাইতি

ভীমাচরণ বাগলী ছিলেন প্রথম সারির স্বাধীনতা সংগ্রামী

মঙ্গলপ্রসাদ মাইতি

স্বাধীনতা আন্দোলনে অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলা এক উল্লেখযোগ্য স্থান অধিকার করে রেখেছে। একথা সর্বজনবিদিত-সর্বজন স্বীকৃত। ইতিহাসবিদরা মেদিনীপুরকে বলেছেন স্বাধীনতা যুদ্ধের পীঠভূমি। তবে শুধু মেদিনীপুর নয়-এর লাগোয়া বাঁকুড়া ও হুগলি জেলার অবদানও কম নয়। সীমান্তবর্তী এই দুটি জেলা থেকে অসংখ্য স্বাধীনতা সংগ্রামী দেশের স্বাধীনতা আনয়নের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। তাঁদের অসাধারণ আত্মত্যাগ এবং দেশের জন্য জীবন মরণ পণ তাঁদেরকে এক উচ্চাসনে বসিয়েছে। এমনই এক নির্ভীক স্বাধীনতা যোদ্ধা হলেন ভীমাচরণ বাগলী। তিনি ছিলেন মহাত্মা গান্ধীর অনুগামী। তাঁর নেতৃত্বে তিরিশ দশকে জয়পুর, কোতুলপুর ও বিষ্ণুপুর থানার বিভিন্ন অঞ্চলে গান্ধীজীর ডাকা আইন অমান্য আন্দোলন ও লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করেছিল। এতটাই উত্তাল হয়েছিল এখানকার স্বাধীনতা আন্দোলন যে ইংরেজ সরকারের রাতের ঘুম ছুটে গিয়েছিল। 

   ভীমাচরণ বাগলীর পিতা যোগেন্দ্রনাথ বাগলী ছিলেন তখনকার দিনে তমলুক কোর্টের নাজির। সেই তমলুকেই ১৯০১ সালে ২১ ডিসেম্বর ভীমাচরণ বাগলীর জন্ম হয়। কিন্তু মানুষ হবার জন্য নিজগ্রাম ময়নাপুরে চলে আসেন তিনি। বাঁকুড়া জেলার জয়পুর থানার অধীন এই ময়নাপুয়ে গ্রাম। মাতার নাম স্বর্ণময়ী দেবী। 

   ১৯২১ সালে ভীমাচরণ বাগলী কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। তিনি ছিলেন কুঁচিয়াকোল রাধাবল্লভ ইনস্টিটিউশনের ছাত্র। ডাক্তারী পড়ার জন্য বাঁকুড়া সম্মিলনী মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু ডাক্তারী পড়া আর হয়ে ওঠে না। এ সময় হঠাত্‍ তাঁর বড়োভাই ধর্মদাস বাগলীর মহাপ্রয়াণ ঘটে। ডাক্তারী পরীক্ষা আর না দিয়ে ভীমাচরণ বাগলী ময়নাপুর গ্রামে ফিরে আসেন। দাদা ধর্মদাস বাগলীও ছিলেন একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী। তিনি ১৯১৭ সালে কলকাতার সিটি কলেজ থেকে বি. এ পাশ করেছিলেন। কিন্তু ব্রিটিশ সরকারের দেওয়া চাকরি গ্রহণ না করে মহাত্মা গান্ধীর ডাকে স্বাধীনতা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। তাঁর অকাল মৃত্যুতে এলাকায় স্বাধীনতা আন্দোললের কাজ স্তব্ধ হওয়ার মুখে। এই অবস্থায় শক্ত হাতে হাল ধরেন তাঁরই সহোদর ভাই ভীমাচরণ বাগলী। ব্যক্তিগত সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বিসর্জন দিয়ে স্বাধীনতা আন্দোলনের সর্বক্ষণের কর্মী হয়ে উঠেন তিনি। 

   ভীমাচরণ বাগলী আন্দোলন শুরু করেছিলে সাধারণ মানুষদের নিয়ে। সহকর্মী হিসাবে যাঁদের পাশে পান তাঁরা হলেন হৃষীকেশ সিংহ, রামচন্দ্র কর্মকার, রামগতি সূত্রধর, ত্রিলোক কর্মকার, ননীবালা ঘোষ, কিশোরীবালা ঘোষ, স্ত্রী হিল্লোলবাসিনী বাগলী প্রমুখদের। 
   ১৯৩০-৩১ সালে জাতির জনক মহাত্মা গান্ধীর আইন অমান্য আন্দোলনের ডাক দেন। ব্রিটিশ সরকারের এক চেটিয়া লবণ ব্যবসার বিরুদ্ধে এই আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন তিনি। এ সময় বাঁকুড়া শহর হতে বেলিয়াতোড় ও সোনামুখী হয়ে একদল সত্যাগ্রহী আন্দোলনকারী মেদিনীপুরের কাঁথির উদ্দেশ্যে পদযাত্রা শুরু করেন। ময়নাপুরের ভীমাচরণ বাগলী এবং হৃষীকেশ  সিংহের নেতৃত্বে এ সময় এখানে লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলন ও আইন অমান্য আন্দোলন প্রত্যন্ত গ্রামগুলিতে ছড়িয়ে পড়ে।

   আন্দোলনকারীদের নিয়ে ভীমাচরণবাবু জয়পুর, কোতুলপুর থানা দখলের উদ্যোগ নেন। পতাকা উত্তোলনের ব্যবস্থা করেন। এদিকে বাগলী পরিবারের প্রায় প্রত্যকেই তখন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে লিপ্ত হয়েছেন। 

   ১৯৩২ সালে বাঁকুড়া জেলার জয়পুর থানাতে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করার অপরাধে ভীমাচরণ বাগলীর সহধর্মিনী হিল্লোলবাসিনী ও বৌদি সরোজিনী বাগলীকে ইংরেজ সরকার গ্রেপ্তার করে। ছ’মাসের জন্য তাদের মেদিনীপুর সেণ্ট্রাল জেলে পাঠানো হয়। ভীমাচরণ নিজে এসময় আত্মগোপন করেন। ইংরেজ সরকার তাঁকে ধরার জন্য হন্যে হয়ে ঘুরতে থাকলেও ধরতে আর পারে না। অসহনীয় কষ্ট সহ্য করে প্রায় দশবছর এখানে সেখানে পালিয়ে আত্মগোপন করে থাকেন ভীমাচরণ বাগলী। স্ত্রী-বৌদি জেলে আর তিনি নিজে লুকিয়ে আছেন। এই সুযোগে সুচতুর ইংরেজ সরকার ভীমাচরণবাবুদের স্থাবর-অস্থাবর সমস্ত সম্পত্তি নিলাম করিয়ে নেয়। শোনা যায় ময়নাপুর থেকে চোদ্দটি গরুর গাড়িতে করে বাড়ির যা কিছু নিয়ে গিয়ে বিষ্ণুপুর কোর্টে নিলাম করা হয়েছিল। ভীমাচরণবাবুকে যখন কোনভাবেই ধরা যাচ্ছে না তখন ইংরেজ সরকার পুরস্কার ঘোষণা করে। বলা হয়, যে ভীমাচরণ বাগলীকে ধরিয়ে দেবে তাকে পাঁচশত টাকা এবং দু’নলা বন্দুক একটি দেওয়া হবে। 
   এই লোভ সংবরণ করতে পারেননি পাশের হিজলডিহা গ্রামের তত্কাালীন জমিদার অমূল্য রায়। তিনি ভীমাচরণবাবুকে চায়ের আসরে নিমন্ত্রণ করে তাঁকে পুলিশের হাতে তুলে দেন। চরম বিশ্বাসঘাতকতার পরিচয় দেন অমূল্য রায়। অনেক পরে অবশ্য অমূল্যবাবু তাঁর ভুল বুঝতে পেরেছিলেন। শোনা যায় ভারতবর্ষ স্বাধীনতা লাভ করলে একদিন অমূল্যবাবু নিজে ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে পুরস্কার হিসাবে পাওয়া দু’নলা বন্দুকটি ভীমাচরণবাবুকে ফেরত্‍ দিতে আসেন। নিজ কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা ভিক্ষা করেন। কিন্তু ভীমাচরণবাবু ঘৃণাভরে তা প্রত্যাখ্যান করেন। ধরা পড়ার পর বিচার হয় ভীমাচরণবাবুর। বিচারে ছয়মাসের জেল হয়। সেটা ১৯৩০ সাল। “He is one of Principal Leader in the Elaka, convicted and sentenced to 6 months R.D. under the ordinance 11 of 1930. Sd/S.Dutta. I.C.S. 11.8.30” 
   দেশ যাঁকে টেনেছে, মাতৃমন্ত্রে যিনি দীক্ষিত, দেশমাতৃকার শৃঙ্খল মোচনের জন্য যাঁর জীবন-মরণ পণ তাঁকে কী কারারুদ্ধ করে তাঁর পথ থেকে সরিয়ে দেওয়া যায়? ইংরেজ সরকারের নির্দয় শাসন ও নির্যাতন ভীমাচরণবাবুকে তাঁর কাজের থেকে দমিয়ে দিতে পারেনি। জেল থেকে ছাড়া পাবার পর আবার আন্দোলন শুরু করেন, নেতৃত্ব দিতে থাকেন। শোনা যায় হিজলডিহা ও ময়নাপুর এই দুই গ্রামের মাঝখানের মাঠে একবার ইংরেজ সরকারের সঙ্গে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সংঘর্ষ হয়। সেই সংঘর্ষে ভীমাচরণবাবু অসাধারণ সাহসের পরিচয় দেন। ইংরেজদের হাতে পুনরায় তিনি ধরা পড়েন। এবার তাঁর দু’বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হয়। 
   “The accused is convicted and sentenced to two years R.D. Sd/-S. Dutta I.C.S.15.12.32”
   এইভাবে একের পর এক সহকর্মীদের নিয়ে ভীমাচরণ বাগলী পিকেটিং করেছেন। থানা দখল করেছেন আর বার বার জেলে গেছেন। জীবনের অনেকটা সময়ই তাঁর কেটেছে জেলে। তবু তাঁর সংগ্রামী পথ থেকে সরে আসেননি তিনি। শেষ বয়স পর্যন্ত তাঁর সংগ্রামী মনোভাব অটুট ছিল।

   স্বাধীনতা লাভের পর বহু জনহিতকর কাজে অংশগ্রহণ করেন ভীমাচরণ বাগলী। জেলে থাকাকালীন ভীমাচরণবাবু জেল চিকিত্সাকের কাছে চিকিত্সা বিদ্যা আয়ত্ত করেছিলেন। এদিকে তাঁর কাকা প্রফুল্ল বাগলী চিকিত্সিক হিসেবে সে সময় যথেষ্ট সুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন। সেই কাকার কাছেও তিনি হাতে কলমে চিকিত্সাি শুরু করেন। এইভাবে চিকিত্সাবর মাধ্যমে দেশসেবার কাজ করে গেছেন তিনি। ময়নাপুর ইউনিয়ন বোর্ডের একবার প্রেসিডেন্টও হয়েছিলেন তিনি।

   ১৯৬০ সালের ৩১ অক্টোবর স্বাধীনতা সংগ্রামী ভীমাচরণ বাগলীর জীবনাবসান ঘটে। ময়নাপুরবাসী এক শোকসভায় তাঁকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন। 
   “ময়নাপুর নিবাসী দেশ মাতৃকার একনিষ্ঠ সন্তান অক্লান্তকর্মী, পরোপকার ব্রতে ব্রতী কুচিয়াকোল মণ্ডল কংগ্রেসের সম্পাদক ভীমাচরণ বাগলীর অকালমৃত্যুতে আমরা সকলে তাঁহার শোকসন্তপ্ত স্ত্রী, পুত্র ও অন্যান্য সকলে আন্তরিক সমবেদনা জানাই।”
                                      স্বাক্ষর: করুণাময় রায়
 ৩.১২.৬০                               প্রধান শিক্ষক-         কুচিয়াকোল রাধাবল্লভ ইনস্টিটিউশন

ময়নাপুরের মতো একটি প্রত্যন্ত এলাকাতেও তখনকার দিনে ভীমাচরণ বাগলী স্বাধীনরা সংগ্রামের যে নিদর্শন রেখে গেছেন তা কোনদিনই ভুলবার নয়। ময়নাপুরবাসী চিরকাল তাঁকে স্মরণ করবেন। স্মরণ করবো আমরাও – একথা নির্দ্ধিধায় বলা যায়। 

জ্বলদর্চি পেজ- এ লাইক দিন👇


আরও পড়ুন 
সত্যের পূজারি মহাত্মাজী
মঙ্গলপ্রসাদ মাইতি 


Post a Comment

0 Comments