জ্বলদর্চি

সমরেশ বসু (Samaresh Basu)/সন্দীপ কাঞ্জিলাল

"সংসারে কেউ নিজেকে খোঁজে, কেউ খোঁজে ঈশ্বরকে। যে নিজেকে খোঁজে জগত সংসার তার পানেই চেয়ে থাকে। আসলে নিজেকে খোঁজার অর্থ, নিজের ভিতরের অন্ধকারকে খোঁজা।" 

সমরেশ বসু 
Samaresh Basu 
(১১/১২/১৯২৪-১২/০৩/১৯৮৮) 

সন্দীপ কাঞ্জিলাল

গভীর রাত! শুয়ে আছি! হঠাৎ কানে বাজলো কারা যেন বাইরে বসে চাপা স্বরে কথা বলছে। আমি ঘরের দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে দেখি, সদরে বসে আছে দুজন বয়স্ক লোক। ওরা নিজেদের মধ্যে কি সব আলোচনা করছিল। যিনি একটু কম বয়সী, তিনি তাঁর থেকে বেশি বয়সের লোকটিকে বলছেন- এ কথা ঠিক যে, আমি তোমার জীবনী লিখিনি। জীবনকে নিয়ে একটা উপন্যাস লিখেছি মাত্র। বয়স্ক লোকটি বলছে- তুমি তো জানতে, আমার যদি বিবাহ কোথাও হয়ে থাকে তাহলে শিল্পের সঙ্গেই হয়েছিল। আমার পায়ের শব্দ শুনে, দুজনেই আমার দিকে তাকালো। আরে, মেদহীন বলিরেখা ভেদ করে এ আমি কাকে দেখছি? পরনে সিল্কের ধূতি পাঞ্জাবি, গায়ে শাল, পরিপাটি চুল, চোখ দুটি জ্বলজ্বল করছে। ইনি তো বিংশ শতাব্দীর উপন্যাসের চরিত্র বদলে দেওয়া, প্রখ্যাত উপন্যাসিক সমরেশ বসু। আর উনার পাশে গালে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি, অবিন্যস্ত চুল, উদাস দৃষ্টি বসে আছেন কিংবদন্তি শিল্পী রামকিঙ্কর। তবে কি উনাদের মধ্যে কথা হচ্ছিল- 'দেখি নাই ফিরে' উপন্যাসের কথা নিয়ে। ভাবছি এরা হঠাৎ কেন? 

সমরেশ বসু প্রথম মুখ খুললেন- দ্যাখো সামনে ১১ই ডিসেম্বর। নিশ্চয় তুমি আমাকে নিয়ে কিছু লিখবে। যদি লেখো, তবে কিন্তু ঐ কথাটা লিখতে ভুলবে না।হকচকিয়ে বললাম- কোন কথাটা?- ঐ যে, ১৯৫০ সালের শেষের দিকে কমিউনিস্ট পার্টি করার জন্য, যখন এক বছর জেল খেটে বেরোলাম, তখন একটা বিড়ি খাবো পয়সাও আমার ছিল না। ইচ্ছাপুর রাইফেল ফ্যাক্টরির কর্তৃপক্ষ বললেন- যদি তুমি বন্ড দাও, আর কোনদিন কমিউনিস্ট পার্টি করবে না, তবে চাকরি ফেরত পাবে। বিশ্বাস কর,আমি কিন্তু বন্ড দিইনি। সেদিনই ঠিক করেছিলাম মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো আমিও লিখব, লিখেই বাঁচবো। আমার কলমের উষ্ণতা পার্টি ব্যবহার করতে চাইছিল, আমি কিন্তু রাজি হইনি। তাইতো আমার মৃত্যুর পর তদানীন্তন তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য লিখলেন, 'লেখকের দ্বিতীয় মৃত্যু।' মাথা নেড়ে বললাম তাই হবে। তখন শিল্পী রামকিঙ্কর বললেন, "শোনো ওর কথা লিখতে গেলে আমার কথা আসবেই।" আমার কথা এলে অন্ততঃ এই কথাটি লেখো- "ভদ্দরলোকের মেয়ে বিয়ে করতে চাইলুম, সবাই চোখ রাঙালো। পরে ছোটলোকের মেয়ে বিয়ে করতে চাইলুম, সবাই বললে ছিঃ। তাই একটা ডোমের মেয়েকে বিয়ে না করেও, আমি স্ত্রীর মর্যাদা দিয়েছিলাম।" এ কথাটা লিখতে ভুলো না। মাথা নেড়ে বললাম তাই হবে। এই কথা বলতেই দেখি জ্যোৎস্নালোক খচিত রাত্রে দুজন হেঁটে চলে গেলেন। এরপরই আমার ঘুম ভেঙে গেল। ক্যালেন্ডারের দিকে তাকিয়ে দেখি ৯ই ডিসেম্বর।সমরেশ বসু। জন্ম ১১ই ডিসেম্বর ১৯২৪ সাল। ঢাকা জেলার মুন্সিগঞ্জ মহকুমার অন্তর্গত রাজনগর গ্রামে পৈতৃক বাস্তুভিটায়। জন্মের সময় বাবার এক মাসিমা সদ্যোজাত সমরেশকে দেখতে এসে বলেছিলেন, "এযে তড়বড় কইরা আইয়া পড়ল।" এতেই ডাক নাম দাঁড়ালো 'তড়বড়ি'। পরে উচ্চারণ পরিবর্তে তরবরি। বাবার দেওয়া নাম 'সুরথনাথ'। বাবার নাম মোহিনীমোহন বসু। মায়ের নাম শৈবলিনী বসু।
বাড়ির পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে সমরেশের আদলটা একটু আলাদা। বই পড়ায় তাঁর মন নেই, বাঁধাধরা শিক্ষার বাইরের জীবনযাপনই তাঁকে বেশি টানে। ছুটে যান সেদিকে। তবু তাকে পাঠানো হলো গিরিশ মাস্টারের পাঠশালায়। পরে গ্রাণ্ডরিয়া (গ্যাণ্ডারিয়া) গ্রাজুয়েট স্কুলে পড়লেন সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত। পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়ায় বাবা তাঁকে পাঠালেন নৈহাটিতে দাদা মন্মথর কাছে। মন্মথ তখন কর্মসূত্রে নৈহাটির রেল কোয়ার্টার্সে থাকতেন। 

শুরু হলো নতুন জীবন। ১৯৩৯ সালে নৈহাটি। দাদা মন্মথনাথ নৈহাটি মহেন্দ্র স্কুলে ভর্তি করলেন অষ্টম শ্রেণিতে, সেটা ৬ ফেব্রুয়ারী ১৯৩৯। অষ্টম শ্রেণিতে ফেল। তাতেও ভ্রুক্ষেপ নেই। স্থানীয় বন্ধুদের নিয়ে ছবি আঁকা আর শরীরচর্চায় মেতে উঠলেন। মন্মথনাথ বিরক্ত হয়ে পাঠিয়ে দিলেন ঢাকায়। ঢাকায় ঢাকেশ্বরী মিলে শিক্ষানবিশের চাকরী। সেখানে অভিনয়ে সবাইকে মাতিয়ে দিলেন। বাবা বিরক্ত হয়ে আবার পাঠালেন নৈহাটিতে। এখানে এসেও নাটক 'সিরাজউদ্দোলা' তে অভিনয়, গান শেখেন। রোজগারের জন্য চটকলের কোয়ার্টার্সে মেমদের ছবি আঁকা। ঘনিষ্ঠবন্ধু দেবশংকর মুখোপাধ্যায় সুসাহিত্যিক সৌরেন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়ের একটি উপন্যাসের নায়কের নামানুসারে তাঁর নতুন নাম দিলেন 'সমরেশ'। অতএব সুরথনাথের নাম হল 'সমরেশ'। যাওয়া আসা বাড়লো দেবশঙ্করের বাড়িতে। দেবশঙ্করের ছয় ভাই চারবোনের মধ্যে গৌরী'র সঙ্গে জমে উঠলো প্রেম। সে আবার ১৩ বছর বয়সে বিবাহবিচ্ছিন্না। সমরেশের থেকে তিন বছরের বড়ো। ১৮ বছরের সমরেশ ২১ বছরের গৌরী, দুটো বাড়ির অমতে পালিয়ে বিয়ে করলেন। কেউ এ বিয়ে মেনে নিলো না। তাঁরা নৈহাটি থেকে চার কিলোমিটার দূরে আতপুরের পুলিশ ফাঁড়ির নিকট চটকলের শ্রমিক আবদুল মিস্ত্রির বাড়ি ভাড়া নিলেন। মাসিক ২টাকা। শুরু হল জীবনযুদ্ধ। পাড়ায় পাড়ায় ডিম বিক্রির কাজ! সপ্তাহে তিন চারদিন খাওয়ার জোটে। বাকি দিন অভুক্ত। ১৯৪২ সালে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিলেন। ১৯৪৩ সালে তাঁর প্রথম ছোটগল্প 'আদাব' পরিচয় পত্রিকায় প্রকাশিত হল। হিন্দু মুসলমান দাঙ্গার পটভূমিতে লেখা মানবিকতার গল্প। ঐ একটি গল্পেই তিনি লোকের চোখে পড়লেন, কারণ গল্পটি ছিল দারুণ প্রাসঙ্গিক। দেশ পত্রিকায় বেরোল গুনিন। এটি সম্পূর্ণ ভিন্ন স্বাদের। গুনিনের জীবিকা নেওয়া এক গ্রাম্য যুবকের বিফল প্রেমের রোমান্টিক গল্প। এটিও প্রশংসিত হল। সমরেশ বসুর প্রথম উপন্যাস, 'নয়নপুরের মাটি'--১৯৪৬। কিন্তু প্রকাশিত হয় ১৯৫২ সালে।

নামে বেনামে প্রায় ২৭৫টি গল্প উপন্যাস লেখেন। তাঁর এই সময়কালে লেখা বইগুলির মধ্যে একটা দুর্দান্ত ক্রোধ টগবগ করে ফুটছে। বিবর, পাতক, প্রজাপতি, 'স্বীকারোক্তি' নামের ছোটগল্প প্রভৃতি রচনা তার প্রমাণ। বিবর ও প্রজাপতি নিয়ে এককালে অনেক হৈ চৈ হয়েছিল। প্রজাপতি লিখে তাঁকে অশ্লীলতার দায়ে কাঠগড়ায় দাঁড়াতেও হয়েছিল। বাংলাসাহিত্যে একটিমাত্র উপন্যাস, যেটি নিম্ন আদালত কতৃক নিষিদ্ধ থাকার পর, ১৭ বছর পর সর্ব্বোচ্চ আদালতের রায়ে মুক্তি পায়। সেটি হল 'প্রজাপতি' উপন্যাস। সেদিন তাঁকে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে সমর্থন করেছিলেন বুদ্ধদেব বসু, সন্তোষকুমার ঘোষ এবং আরো কেউ কেউ। ওদিকে খুব সুকৌশলে এই অপবাদ ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল যে তিনি সি আই এর চর। আজকে নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে দেখে বলা ভালো যে প্রজাপতির মূল গল্পটিতে কোনো অশ্লীলতা ছিল না। অশ্লীলতা যদি কিছু থেকে থাকে তা নায়ক সুখেনের স্ল্যাং বুলিতে। সমরেশ বসু একটিমাত্র খোলা চিঠিতে দেশ পত্রিকায় নিজের বক্তব্য জানিয়েছিলেন। তিনি এই মর্মে কথা বলেছিলেন যে যদি কোন ছেলে জ্ঞান হওয়ার পর থেকে ক্রমাগত দেখে তার চারপাশের গুরুজনেরা সবাই তাকে যেরকম হবার জন্য উপদেশ দেয়, নিজেরা আদৌ সেরকম হতে চায় না। যদি সে দেখে বাল্যে তাঁর বাড়ির বড়রা, কৈশোরে তাঁর পাড়ার দাদা ও ইস্কুলের মাষ্টারমশাইরা, যৌবনে তার এলাকার নেতারা সকলেই মনে এক, মুখে অন্য। এবং সকলেরই ধান্দা লোক ঠকানো। তাহলে সেই ক্রুদ্ধ উদভ্রান্ত ছেলের মুখে ভদ্রভাষা আসবে কি? তার মুখে ঐ অবস্থায় যে ভাষা আসে তিনি সেটাই দিয়েছেন। 'বিবর' উপ্যাসের সঙ্গে আলবেয়ার কামুর বিশ্ববিখ্যাত উপন্যাস 'The Outsider' এর মিল আছে। আসলে বিবর এর নায়ক যে বিচ্ছিন্নতাবোধ (Alienation) আক্রান্ত তা আধুনিক সভ্যতার ব্যাধি। তখনকার নবীন লেখক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় বিবর পড়ে অনুপ্রাণিত হওয়ার কথা স্বীকার করেছেন, তাঁর নিজের ঘুণপোকা উপন্যাসও একই ধারার রচনা। বিবর ও প্রজাপতি নিয়ে যত হৈ চৈ হয়েছিল স্বীকারোক্তি নিয়ে তা হয়নি, কিন্তু এই পর্বের সমরেশকে জানাতে হলো স্বীকারোক্তিই সবচেয়ে উপযুক্ত বই। লেখক নিজেও সেটাই মনে করতেন। কারণ ঐ দুই রচনায় (গল্প ও উপন্যাস স্বীকারোক্তি) আছে তাঁর আত্মানুসন্ধানের "নৈতিক ও মানসিক আর্তি।" 

অনেকদিন আগে একবার বন্ধুবান্ধবসহ শান্তিনিকেতনে বেড়াতে গিয়ে তাঁরা অন্নদাশঙ্করের বাড়ি উঠেছিলেন। লীলা রায় তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন "তুমি লেখ কেন?" তিনি উত্তর দিয়েছিলেন "মানুষকে জানবার জন্য লিখি।" লীলা রায় প্রতিপ্রশ্ন করেছিলেন "নিজেকে জানার জন্য নয় কেন?" এই প্রশ্ন সেদিন তরুণ লেখকের মনের মধ্যে গভীর রেখাপাত করেছিল। পরে তা শাখাপল্লব বিস্তার করে বড় হয়ে উঠেছে তার প্রমাণ দেখি তাঁর মধ্যজীবনে।

উত্তর ২৪ পরগণার শ্যামনগর এবং জগদ্দলের মধ্যবর্তী গঞ্জ এলাকা, আতপুর। একটি আধা বস্তির দেড় কামরা টালির চালের নীচে ছ'টি প্রাণীর বসবাস। ঘরের চেয়ে বাইরে-বাইরে ঘুরে বেড়াতে তিনি স্বচ্ছন্দ বোধ করতেন। কেননা টালির ঘরের ফাটা মেঝের উপর জলচৌকি রেখে দোয়াতে ডোবানো কলম দিয়ে  লিখতেন। ঘরের উলটো দিকে একফালি খোলা বারান্দায় তোলা উনুনে (ভাঙা বালতির উপর মাটি লেপে বানানো) স্ত্রী গৌরী বসু, রান্না করতেন। মাঝে মাঝে দু'চার পাতা লেখা কাগজ নিয়ে সমরেশ উঠে যেতেন গৌরী'র কাছে। উবু হয়ে বসে, লেখা পড়ে শোনাতেন গৌরীকে। গৌরী মতামত দিতেন লেখা শুনে। 

রাজনৈতিক বন্দি হিসাবে জেল থেকে ফিরে এসে যখন 'ইচ্ছাপুর রাইফেল ফ্যাক্টরি'র চাকরিটি খোয়ালেন, তখন চারটি শিশুসন্তান থাকা সত্ত্বেও স্ত্রী গৌরী বলেছিলেন, "যা হওয়ার হবে, কিন্তু তুমি আর চাকরি করতে যেও না।" ভাবলে গায়ে কাঁটা দেয়। চাল নেই, চুলো নেই, চাকরি নেই, ছ'জনের সংসার, তার মধ্যে চারটি কচি ক্ষুধার্ত মুখ সব সময়ে হাঁ করে রয়েছে। এরই মাঝখানে একজন স্ত্রী তার স্বামীকে বলছেন, "তুমি লেখো। চাকরি করতে হবে না।" পাগলামি না কি আত্মবিশ্বাস। ভালবাসা না কি মরণঝাঁপ। জায়া-জননী-বন্ধু-কমরেড, কে এমন ভাবে পাশে দাঁড়ায়। 

সমরেশ বসু কিন্তু আর ফিরে দেখেননি। ফিরে দেখার সময় তাঁর ছিল না। ছিল শুধু কয়েকজন সহৃদয় বন্ধু। কেউ পুরনো জামাকাপড় এনে দিতেন ছেলেমেয়ের জন্য। কেউ কলাটা-মুলোটা দিয়ে যেতেন। গ্রাম্য গোয়ালা গৌরীকে বলেছিলেন, "পয়সা দিতে পারবে না বলে বাচ্চাদের দুধ বন্ধ করে দেবো? অত অভাব আমার এখনও হয়নি। দুধ দেওয়া আমি বন্ধ করব না। যে দিন পয়সা হবে, সে দিনই দিও।" গৌরী গান শেখাতেন। জামাকাপড় সেলাই করতেন। 

সমরেশ বসুর ছদ্মনাম 'কালকূট'। এই নাম কেন, তা লেখকের মুখে শুনে নিই-  কালকূট জানাচ্ছেন, "তখন সবে জেল থেকে বেরিয়েছি৷ ছদ্মনামের খুব দরকার ছিল। কালকূট, হলাহল, এটা খানিকটা যেন আমার নিজেরই ভিতরের ব্যাপার।" বুঝে নিতে অসুবিধে হয় না যে মানুষটার ভিতরে একটা যন্ত্রণা কাজ করছিল। মনের মধ্যে এক অস্থিরতা ছিল। শাসক দলের বিরুদ্ধে কলম ধরেছিলেন তাই নাম-কে গোপন রাখা দরকার ছিল। অঙ্গে বিষ নিয়ে তিনি অমৃতের খোঁজে ঘুরে ফিরছেন। তাঁর 'গাহে অচিন পাখি' রচনাতেই সমরেশের কালকূট হয়ে ওঠার (নাম গ্রহণ) উল্লেখ তিনি নিজেই করেছেন।
"কিন্তু এমন নামটি কেন? তা হলে যে প্রাণটি খুলে দেখাতে হয়। দেখলেই বোঝা যাবে, বুক ভরে আছে গরলে। আপনাকে খুঁজে ফেরা, আসলে তো হা অমৃত হা অমৃত! বিষে অঙ্গ জরজর, কোথা হা অমৃত!....কালকূট ছাড়া, আমার আর কী নাম হতে পারে?"

সর্বভারতীয় মেলার প্রাঙ্গনে রচিত 'অমৃত কুম্ভের সন্ধানে'- ১৯৫৪। উপন্যাসে তিন কাল গিয়ে এক কালে ঠেকা বৃদ্ধের যুবতী বউ শ্যামার মনের মধ্যে বেদনা কালকূটকে ভাবিয়েছে। 'মা খেগো বলা' অর্থাৎ বলরাম ও লক্ষীদাসের গানের কথা ও সুর, তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার কাহিনি। ভূতানন্দ ও তার সঙ্গিনী ভৈরবীর টক-ঝাল-মিষ্টি সম্পর্ক, তন্ত্র সাধনার প্রকৃতি পুরুষ তত্ত্বের আভাস উপন্যাসে পাওয়া যায়। কালকূট দেখলেন তীর্থে আসা মানুষগুলোর বিচিত্র ভক্তি। সন্ন্যাসীর কাছে জানলেন, প্রেম কি জিনিস! গৃহী ও সন্ন্যাসীর পার্থক্য কোথায়! তীর্থে আসা সাধিকা রামাদাসীজি (ইনি আগে মনিয়াবাঈ ছিলেন, পরে দীক্ষা নেন) অতীত জীবনের সুখ-দুঃখময় কথা কালকূটকে বলেন। এরকম এমন কত মানুষ আছেন বা এসেছেন। এই মেলায় যাদের কথা কালকূটের শোনা হয়নি। লেখক দেখছেন, পরম পুরুষকে পাওয়ার আশায় মানুষ ছুটছে। জাতি বর্ণ ধর্ম নির্বিশেষে। কালকূটের কাছে বিচিত্র এই মানুষই হয়ে উঠেছে ভারততীর্থ। 

'অমাবস্যায় চাঁদের উদয়' এই উপন্যাসে বাউল গানের নামে হলেও মূল তত্ত্বটি তন্ত্র সাধনার উপরেই প্রাধান্য পেয়েছে। "...একটা তত্ত্ব আছে, তত্ত্বটা জানা থাকা চাই।...ভাণ্ড ব্রহ্মাণ্ডেরও একটা তত্ত্ব আছে।...এই ভাণ্ডই যে ব্রহ্মাণ্ড, তা বোঝবার একটা তত্ত্ব আছে, সেই তত্ত্ব যে সাধে সে তা বুঝতে পারে। সবাই পারে না।... এমনই সাধনা, যা সাধলে অমাবস্যায় চাঁদের উদয় হয়।" 

এ যাত্রার নাম 'চলো মন রূপনগরে'। উপন্যাসে মানুষের বহু রূপের মধ্যে অরূপের লীলাকে খুঁজতে আগ্রহী হয়েছেন কালকূট। কোথায় খুঁজছেন! পথে-ঘাটে, গ্রাম-গঞ্জে, যত্রে-তত্রে। কালকূটের মনে প্রশ্ন উঁকি দিয়েছে, 'রূপের এই ধারাবাহিক গতিময়তার মধ্যে অরূপের রূপ কেমন?' সংসারের সাধারণ মানুষকে তিনু বৈরাগী হতে দেখেছেন। হুগলীর শ্রীপুর গ্রামে গোলক দাস বাবাজীর সান্নিধ্যে তিনি বৈষ্ণবধর্মের তত্ত্বকথা শুনেছেন। কল্যাণীর ঘোষপাড়ায় সতীমায়ের মেলাতে কর্তাভজা সম্প্রদায়ের উল্লেখ রয়েছে 'কোথায় সে জন আছে' উপন্যাসটিতে। এই মেলায় যাত্রাকালে কালকূটের সঙ্গী ছিলেন কালপেঁচা (বিনয় ঘোষ)। ধর্মের নামে ভণ্ডামির দিকটা লেখক দেখিয়েছেন। বন্ধ্যা মেয়েদের গুরুরা গুরুপ্রসাদীর নাম করে পূণ্যফল দেন। বন্ধ্যা মেয়েরা নাকি সেই প্রসাদীরই কামনা করে। কালকূটের এতে মন ভরে না। সে অবশ্য খুঁজে বেড়ায় সেই জনকে।

সাহিত্যে যার কোনো ফাঁকি নেই, জীবনে তাঁর অদৃশ্য ফাঁক রচিত হয়ে যাওয়াই কি নিয়তি। না, রচিত তো হয়ে যায় না, রচনা করা হয় বলেই রচিত হয়। এই রচনাই মনস্তত্ত্বের জটিল রসায়ন? জীবন শিকারী লেখক তিনি, নিজেকে সেভাবেই চিনিয়েছেন। বলেছেন, "সাহিত্যের থেকে জীবন বড়।" সেই মানুষ কবুল করেন, "কাঠ খেয়েছি, আংরা বেরুবো।" কোথাও অনুতাপ ছিল কি? বা কিঞ্চিৎ আত্ম-তিরস্কার? হ্যাঁ, তীব্র অনুভূতিসম্পন্ন ও বাস্তববাদী, আত্মবিশ্বাসী লেখকটির আরও একটি সম্পর্কে ভেসে গেলেন। সম্পর্ক-রচনার পাত্রীটির সঙ্গে তাঁর তো রুচি-সংস্কৃতি-বুদ্ধিমত্তা কোনও কিছুরই মিল ছিল না। অথচ নিশির ডাকের মতো টানে ষাটের দশকে নিত্য ছুটে যেতেন পূর্ব কাঁঠালপাড়ার সেই বাড়িতে। একমাত্র এক যুবতীর আকর্ষণে। সে আকর্ষণে ধারাবাহিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল তার পুত্র-কন্যারা। অসম্মানে, গ্লানিতে বিধ্বস্ত-ছারখার-ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছিলেন তাঁর সেই 'বুড়ি'(গৌরী'র ডাক নাম)।

একটা গোলমাল বিভ্রান্তি লেগেই থাকে। অথচ দিন যায় তার পরেও। লেখকের খ্যাতি-সুনাম-স্বাচ্ছন্দ্য..... কোনোও কিছু পড়ে থাকেনা, উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়। মানুষটা যেন পাঁকাল মাছের মতো। কাদা-পাঁকের মধ্য দিয়ে চললেও, তাঁর গায়ে আলোর ঝলকানি। ছেলে-মেয়ে স্ত্রীকে ফেলে পাতলেন কলকাতায় নতুন সংসার, দ্বিতীয়- স্ত্রী।যে আবার গৌরীর ছোটো বোন। অপেক্ষাকৃত অধিক বয়সে আর একটি সন্তানলাভ।
সমরেশ বসু ১৯৮০ তে সাহিত্য আকাদেমি লাভ করেন তাঁর 'শাম্ব' উপন্যাসের জন্য। এটি কালকূট ছদ্মনামে লেখা। কৃষ্ণতনয় শাম্ব এক অসামান্য রূপবান যুবক। সমরেশ বসু লেখেন - "তাঁর আয়ত চোখে সর্বদা কামনার বহ্নি অনল প্রজ্জ্বলিত হয় না, কিন্তু তাঁর মুগ্ধ দৃষ্টিতে এমন একটি চিত্তজয়ী দুর্বার আকর্ষণ আছে, রমণী মাত্রেই তাঁর মিলন আকাঙ্ক্ষায় কাতর হয়ে ওঠে।" রমণীকূল তাঁর সঙ্গ লাভে ব্যাকুল। এমনকি দ্বারকাতে কৃষ্ণের ষোলো হাজার রমণীও এই অসামান্য রুপবান যুবকের সঙ্গ লাভে  ব্যাকুল। এই কথা কৃষ্ণকে অবগত করেন স্বয়ং নারদ। কৃষ্ণ দেবতা।কিন্তু মানুষের বৈশিষ্ট্যের বাইরে নয়। লোভ কাম লালসা ঈর্ষার ঊর্ধ্বে নন। তাই ক্রোধান্বিত হয়ে  নিজের পুত্রকে নৃশংস অভিশাপ দেন- "তোমার এই রমণীমোহন রূপ নিপাত যাক। কুষ্ঠরোগের কুশ্রীতা তোমায় গ্রাস করুক।"

"আয়নার প্রতিবিম্বেই নীতার শ্যাম্পু করা রুক্ষ চুলের দিকে তাকালাম। যে চুলের গোছা, একটু আগেই আমি বিলি কেটে কেটে ঘাড় থেকে তুলে ওর মাথার উপর দিয়ে লুটিয়ে  দিয়েছি। নীতাও উপুড়  হয়ে রয়েছে। আমিই উপুড় করে দিয়েছি।.....নিটোল কোমল ফর্সা পিঠ, জামা নেই। পিঠটা যেন ক্রমাগত ত্রিভুজের রেখায় কোমরের দিকে নেমে গেছে।" এটি একটি যুবতীর মৃতদেহ। বর্ণনা দিচ্ছে একটি যুবক। যে রমণের উদ্দামলীলার মধ্যেই কনুই ধীরে ধীরে চেপে দিয়েছে মেয়েটির গলায়। আসলে শিকার ধরার জন্য শিকারী পাতে ফাঁদ। শিকার ফাঁদকে নিজের শিকার ভাবে। অথচ বেচারা শিকার জানে না যে,তাকেও লক্ষ্য রাখছে শিকারী। এখানে মেয়েটি শিকার। যুবকটি শিকারী। এটাই হচ্ছে 'বিবর' উপন্যাস। যাকে অশ্লীলতার দায়ে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। আর এই অশ্লীলতা বিষয়ে সমরেশ বসু বলেন, "আসলে সাহিত্যে অশ্লীলতা খুঁজে যারা বিচলিত, শুচি শুচি করে মরছে, তারা জীবনের ক্ষেত্রে পাপসৃষ্টির প্রতি চোখ ফিরিয়ে রাখতে চাইছে। তারাই সেই স্বাধীনতা অর্জন করেছে, যে তারা জীবনে যা খুশি করবে আর পাপবোধের কথাও দিনান্তে একবার মনে স্থান পাবে না। সেই জন্ম পুণ্যবানেরা এমনকি সত্যের চেহারাকেও ভয় পায়। আর এটাই হচ্ছে আত্মদর্শনের আতঙ্ক।"

তাঁর লেখা উপন্যাসের সংখ্যা ১০০ টি এবং ২০০ টি গল্প। আরও ছোটোদের জন্য এবং অনেক প্রবন্ধ লেখেন। তিনি লেখেন 'প্রজাপতি ' -১৯৬৭, 'বিবর'-১৯৬৫, 'অমৃতকুম্ভের সন্ধানে'-১৯৫৪ ইত্যাদি। ছোটোদের জন্য 'গোগোল অমনিবাস'। তাঁর সমগ্র রচনার ২৪ টি ছায়াছবি হয়েছে। সাহিত্যে অবদানের জন্য সমরেশ বসু ১৯৫৯ সালে আনন্দ পুরষ্কার। আর 'শাম্ব'-১৯৭৮, উপন্যাসের জন্য সাহিত্য আকাদেমি -১৯৮০ তে পান।

মাত্র ৬৩ বছর বয়সে সমরেশ বসু ১৯৮৮ সালের ১২ই মার্চ মারা যান। মৃত্যুকালে তাঁর লেখার টেবিলে ছিল ১০ বছরের অমানুষিক পরিশ্রমের অসমাপ্ত ফসল চিত্রশিল্পী রামকিঙ্কর বেইজের জীবনী অবলম্বনে উপন্যাস 'দেখি নাই ফিরে'। এই উপন্যাসের চিত্রাঙ্কন করেন শিল্পী বিকাশ ভট্টাচার্য। 

তিনি এখন আলোর বাসিন্দা। নিজে তো অনেক আগেই বলেছেন,"জীবনে যদি অন্ধকার থাকে,তাকে অন্ধকারেই রাখতে হবে কেন? আলোয় আনতে গেলে পেচক শৃগাল চিৎকার করবে।করুকই না। তবু যেন অন্ধকারে থাকতে না হয়।"

জ্বলদর্চি পেজ- এ লাইক দিন👇


আরও পড়ুন 

Post a Comment

2 Comments

  1. আজ আমার অন্যতম প্রিয় লেখকের স্মরণের বিশেষ দিনে পড়ে মন ভরে গেল।আপনার লেখার জন্য থাকল অনেক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।

    ReplyDelete
  2. সমৃদ্ধ হলাম। ভীষণ ভালো লেখা।

    ReplyDelete