জ্বলদর্চি

সমারসেট মম্ : ইংরেজি সাহিত্যের মপাসাঁ/মুক্তি দাশ


সমারসেট মম্ : ইংরেজি সাহিত্যের মপাসাঁ

মুক্তি দাশ

ডাকসাইটে এক ডাক্তার কালক্রমে ইংরেজি সাহিত্যের বহু তারকাখচিত আকাশে নিজের আসনটি চিরকালের জন্যে পাকা করে নিলেন – উইলিয়াম সমারসেট মম্ (William Somerset Maugham / 1874 - 1965) এরকমই একজন ব্যতিক্রমী সাহিত্য-ব্যক্তিত্ব। সাহিত্যের সবক’টি শাখাতেই তাঁর অবাধ অনায়াস বিচরণ। একাধারে তিনি ছিলেন সুদক্ষ এবং সফল ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার এবং ছোটগল্পকার। ফরাসী সাহিত্যের একচ্ছত্র সম্রাট ও পৃথিবীর সর্বযুগের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ছোটগল্পকার গী দ্য মপাসাঁ (Guy de Maupassant / 1850 – 1893)-র অনিবার্য প্রভাব সমারসেট মম্-এর যাবতীয় সাহিত্যকর্মে, বিশেষত তাঁর ছোটগল্পগুলিতে, লক্ষণীয়। তবে মানতেই হবে, এই প্রভাব কোনোক্ষেত্রেই সমারসেট মম্-এর স্বকীয়তাকে ক্ষুণ্ণ করেনি। এবং এখানেই তাঁর স্বাতন্ত্র্য।

আজ  থেকে অনতিকম দেড়শো বছর আগে ১৮৭৪ খৃষ্টাব্দের ২৫শে জানুয়ারি প্যারিসে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে সমারসেট মম্-এর জন্ম। বাবা ওরমন্ড মম্ ছিলেন অত্যন্ত অমায়িক ও মার্জিত রুচিসম্পন্ন ব্যক্তি। এবং পুত্রবৎসল। মা-ও ছিলেন স্নেহশীলা এবং প্রখর ব্যক্তিত্বসম্পন্না। সমারসেট মম্‌কে নিয়ে মোট তিনজন পুত্রসন্তানের জনক-জননী এঁরা। কোনো কন্যাসন্তান ছিল না।

দুর্ভাগ্যের বিষয়, দশ বছর বয়সে মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে মা ও বাবাকে চিরদিনের মতো হারান সমারসেট মম্। বাবা-মায়ের আকস্মিক মৃত্যুতে বালক সমারসেট খুবই মুষড়ে পড়েন। এই অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু তাঁর শিশুমনে এক গভীর ছাপ রেখে যায়।

পরবর্তীকালে ভাগ্যবিড়ম্বনার শিকার হয়ে সমারসেট মম্ ইংলন্ডের কেন্ট শহরে তাঁর কাকার কাছে প্রতিপালিত হতে থাকেন। কাকা ছিলেন ধর্মপরায়ণ পাদ্রী। সমারসেট মম্-এর হৃদয়ে এই নিঃস্বার্থ ধার্মিক সেবাপরায়ণ কাকার প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার আসনখানি ছিল বাবার ঠিক পরেই। কাকার পৃষ্ঠপোষকতায় তিনি কেন্ট শহরের কিংস স্কুলে ভর্তি হন। তারপর একসময় সেখানকার পড়াশুনোর পাট চুকিয়ে তিনি ডাক্তারি পড়ার জন্যে পাড়ি দিলেন জার্মানির হেডেলবার্গ ইউনিভার্সিটির উদ্দেশে। এবং ছ’বছরের ডাক্তারি কোর্স অভূতপূর্ব সাফল্যের সংগে শেষ করেন। তারপর পুরোদমে নেমে পড়েন প্র্যাকটিসে। অল্পকালের মধ্যেই চিকিৎসাশাস্ত্রে প্রভূত সুনাম অর্জনে তিনি সমর্থ হন। তিনি ছিলেন গরীব, বঞ্চিত, অবহেলিত মানুষের চিকিৎসক। মানুষের দারিদ্র্যজনিত দুঃখ-কষ্ট-ক্লেশ তাঁকে যৎপরোনাস্তি বিচলিত করতো। শহরের বস্তি এলাকাগুলিতে ঘুরে ঘুরে দারিদ্র্যপীড়িত মানুষের বিনে পয়সায় বা নামমাত্র দক্ষিণার বিনিময়ে চিকিৎসা ও সেবা করা এবং বিপদে-আপদে তাদের পাশে দাঁড়ানোই তখন সমারসেট মম্-এর জীবনের একমাত্র ব্রত। 

এইসময় তিনি বস্তি অঞ্চলের দারিদ্র্যজর্জর সমাজের নিম্নবর্গীয় দলিত মানুষের জীবনের দুঃখ-কষ্ট, লাঞ্ছনা ও বেদনাকে উপজীব্য করে লিখে ফেললেন এক অনবদ্য উপন্যাস – ‘লিজা অফ ল্যামবেথ’ (Liza of Lambeth)। তাঁর প্রথম উপন্যাস। প্রকাশিত হলো ১৮৯৭ সালে। অন্যভাবে বলতে গেলে, বিশ্বসাহিত্যে দ্বিতীয় মপাসাঁর জন্মলগ্ন। যেন নতুনভাবে তিনি আবিস্কার করলেন নিজেকে – সাহিত্যরসে জারিত এক সম্পূর্ণ নতুন উইলিয়াম সমারসেট মম্‌-কে। উপন্যাসখানি প্রকাশ পাওয়ার সংগে সংগে সারা ইংল্যান্ডে এমন সাড়া ফেলে দিয়েছিল যে, তাতে অনুপ্রাণিত হয়ে সমারসেট মম একসময় স্থির সিদ্ধান্তই নিয়ে ফেললেন যে, এরপর তিনি ডাক্তারি ছেড়েছুড়ে সাহিত্যসাধনাকেই সর্বতোভাবে পেশা হিসেবে গ্রহণ করবেন। হলোও তাই। ডাক্তারি করতে গিয়ে যে-হাতে ছুরি-কাঁচি নিয়ে তিনি মানুষের হৃৎপিন্ড কাটাছেঁড়া করেছেন, সেই হাতেই ধরলেন কলম। এবার আর হৃৎপিন্ড নয়, মানুষের হৃদয় নিয়েই শুরু হলো অদৃশ্য কাটাছেঁড়া। তাঁর যুগান্তকারী কলমের মুখ থেকে একে একে নিঃসৃত হতে থাকলো ‘মিসেস ক্র্যাডোক’ (১৯০২), ‘দ্য ম্যাজিসিয়ান’ (১৯০৮), ‘অফ হিউম্যান বন্ডেজ’ (১৯১৫), ‘দ্য মুন অ্যান্ড সিক্সপেন্স’ (১৯১৯), ‘দ্য পেইন্টেড ভেইল’ (১৯২৫), ‘কেকস অ্যান্ড অ্যালে’ (১৯৩০), ‘দ্য ন্যারো কর্ণার’ (১৯৩২), ‘থিয়েটার’ (১৯৩৭), ‘আপ অ্যাট দ্য ভিলা’ (১৯৪১), ‘দ্য রেজর’স এজ’ (১৯৪৪), ‘দেন অ্যান্ড নাউ’ (১৯৪৬), ‘ক্যাটালিনা’ (১৯৪৮)-এর মতো যুগান্তকারী সাড়া জাগানো উপন্যাস। এর মধ্যে ‘অফ হিউম্যান বন্ডেজ’-এ তাঁর লেখক জীবনের প্রথমদিককার কথাই বিধৃত হয়েছে। তাঁর গল্প-উপন্যাসের কাহিনী  অবলম্বনে নির্মিত সাড়া জাগানো সফল চলচ্চিত্রের সংখ্যাও নেহাৎ কম নয়।

সমারসেট মম-এর বিখ্যাত ছোটগল্প সংকলনগুলির মধ্যে ‘দ্য ক্যাজুয়ারিনা ট্রী’, ‘অ্যাশেনডন’, ‘আহ্‌ কিং’, ‘দ্য মিক্সচার অ্যাজ বিফোর’, দ্য ট্রেম্বলিং অফ আ লিফ’, ‘ফার্ষ্ট পার্সন সিঙ্গুলার’ ‘ক্রিয়েচার অ্যান্ড সারকামস্টেন্স’ প্রভৃতির নাম সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। ‘আ্যাশেনডন’ গল্পসংকলনটি আসলে বেশ কিছু চমকপ্রদ গোয়েন্দাকাহিনীর সমষ্টি। একসময় কিছুকাল রাশিয়ার ইন্টেলিজেন্স ডিপার্টমেন্ট-এ ‘সিক্রেট সার্ভিস এজেন্ট’ পদে তিনি বহাল ছিলেন। সে সময়কার বিচিত্র সব অভিজ্ঞতারই প্রতিফলন ঘটেছে ‘অ্যাশেনডন’-এ। মূলত, এইসব ধ্রুপদী ছোটগল্পগুলির জন্যেই তিনি ‘ইংরেজি সাহিত্যের মপাসাঁ’ নামে অভিহিত হয়েছিলেন। যদিও রচনাশৈলী এবং কাহিনীবিন্যাসে তাঁর মুন্সিয়ানা ছিল সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ঘরানার। 

নাট্যসাহিত্যেও সমারসেট মম এক অবিসংবাদিত নাম। সমাজের নিপীড়িত শোষিত মানুষের মর্মস্পর্শী দুঃখবেদনার করুণ ইতিহাস কখনো বা নির্মল নির্দোষ হাসির মোড়কে, কখনো বা শ্লেষাত্মক ব্যঙ্গ-কৌতুকের ছদ্মবেশে উপস্থিত হয়েছে তাঁর ‘দ্য সার্কেল’, ‘আওয়ার্স বেটার’, ‘দ্য ল্যান্ড অফ প্রমিস’, ‘সিজার’স ওয়াইফ’, ‘দ্য কন্সট্যান্ট ওয়াইফ’, ‘দ্য লেটার’, ‘দ্য ব্রেড উইনার’ প্রভৃতি নাটকগুলিতে। প্রত্যেকটিই মঞ্চসফল নাটক। ১৯০৭ খৃষ্টাব্দে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে ‘লেডি ফ্রেডরিক’ নাটকটি তো সেসময় যথেষ্ট আলোড়ন তুলেছিল।

প্রবন্ধ রচনার ক্ষেত্রেও সমসরসেট মম অদ্বিতীয়। বিভিন্ন বিষয় ও সমস্যাবলীর ওপর তাঁর মননশীল তত্ত্বভিত্তিক মৌলিক আলোচনা, বিশ্লেষণ ও সমাধান ইংরেজি প্রবন্ধ-সাহিত্যে এক যুগান্তকারী সংযোজন।

এছাড়া একটি চমৎকার আত্মজীবনীও লিখেছেন সমারসেট মম। নাম, ‘স্ট্রিক্টলি পারসোন্যাল’। নামেই বোঝা যায়, বইটি সমারসেট মম-এর ব্যক্তিজীবনের একান্ত কাহিনী। বস্তুত, এতে তাঁর চিকিৎসক ও লেখক হিসেবে খ্যাতি ও যশের প্রখর আলোকে উজ্জ্বল ঝলমলে দিকটি যত না উন্মোচিত হয়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশি ভাবে প্রকটিত হয়েছে প্রদীপের স্নিগ্ধ অনুজ্জ্বল আলোয় আলোকিত তাঁর ঘরোয়া ব্যক্তিজীবনের অন্তরঙ্গ রূপটি। পাঁচ বছরের বড় শেরি মম-এর সংগে তাঁর ১৩ বছরের বিবাহত জীবনের ব্যর্থতার বেদনাঘন করুণকাহিনীও ব্যক্ত হয়েছে এই ‘স্ট্রিক্টলি পারসোন্যাল’-এ। ১৯১৫ খৃষ্টাব্দে তিনি বিয়ে করেন ধনকুবের টমাস জন বার্নার্ডো-র কন্যা শেরি ওয়েলকাম (বার্নার্ডো)-কে। আসলে তখন শেরি বার্নাডো ছিলেন একজন ডিভোর্সী। প্রথমে তাঁর বিয়ে হয় হেনরি ওয়েলকাম-এর সাথে। হেনরি ওয়েলকাম-এর সংগে ১৪ বছরের বিবাহিত জীবন থেকে বিচ্ছেদ ঘটে ১৯১৫ সালে। এবং সেই ১৯১৫ সালেই তিনি বিয়ে করেন সমারসেট মম-কে। এই বিয়েও সুখের হতে পারেনি। মাত্র ১৩ বছরের অব্যক্ত বেদনায় ভরা হতাশাপূর্ণ অসফল বিবাহিত জীবন। অবশেষে আইনগত বিচ্ছেদের মাধ্যমে সেই বিষময় দাম্পত্যজীবনের পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে অব্যাহতি পেলেন সমারসেট মম – ১৯২৮ সালে। হৃদয়স্পর্শী ভাষার বুননে সমারসেট মম পাঠককুলকে উপহার দিয়ে গেলেন তাঁর নিজস্ব জীবনের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার মুহূর্ত দিয়ে গাঁথা একটি মনোজ্ঞ আত্মজীবনী। 

দীর্ঘ একানব্বইটি বছর এই পৃথিবীর আলো-বাতাসে বেঁচে ছিলেন উইলিয়াম সমারসেট মম। অবশেষে এক অতীব তুচ্ছ সামান্য দুর্ঘটনায় তাঁর অন্তিমকাল ঘনিয়ে এল একেবারে অপ্রত্যাশিত ভাবে। মেঝেতে পাতা কার্পেটে হঠাৎ হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলেন একানব্বই বছরের অশীতিপর বৃদ্ধ। আর উঠলেন না। সেটা ছিল ১৯৬৫ খৃষ্টাব্দের ১০ই ডিসেম্বর। তারপর টানা ৬ দিন কোমায় আচ্ছন্ন হয়ে রইলেন। এবং ডিসেম্বরের ১৬ তারিখে ইংরেজি সাহিত্যে এক অসীম শূন্যতা সৃষ্টি করে লোকান্তরিত হলেন উইলিয়াম সমারসেট মম।

মৃত্যুর অর্ধশতাব্দী পরেও বিশ্বসাহিত্যে উইলিয়াম সমারসেট-এর স্মৃতি আজও অম্লান।

              
জ্বলদর্চি পেজ- এ লাইক দিন👇

আরও পড়ুন

Post a Comment

1 Comments

  1. চমৎকার লেখা, সমৃদ্ধ হলাম।

    ReplyDelete