জ্বলদর্চি

তিব্বতের লোকগল্প (বাঘের বােকামি)/চিন্ময় দাশ

দূরদেশের লোকগল্প (তিব্বত)
চিন্ময় দাশ

বাঘের বােকামি

বাঘিনী আর তিনটি বাচ্চা নিয়ে বাঘের সংসার। একদিন বাঘিনী আর ছেলেদের ডেকে, বাঘ বলল-- আমার মরবার সময় হয়েছে। একটা কথা বলে যাই তােমাদের। বাঘ হল বনের রাজা। তার গর্জনে সবাই থরহরি কাপে। কিন্তু ভুলেও কোনদিন মানুষ শিকার করতে যেও না। মানুষের গায়ে জোর নাই। দাঁত নাই, নখ নাই। কিন্তু মাথায় মগজ আছে। সেটাই তার জোর। আমরা বনের রাজা। কিন্তু দুনিয়ার সব জীবের রাজা হােল মানুষ। মানুষকে কোনদিন ঘাঁটাতে যেও না।

বাঘ একদিন মারা গেল। বাচ্চা তিনটিও বড় হােল দেখতে দেখতে। এখন তারাই শিকার করে।

বড় দুটো বাচ্চা বাপের কথা ভােলেনি। হরিণ, শূকর বা ছােট ছােট জীবই শিকার করে বেড়ায়। কোনও কারণে মানুষের সামনা সামনি হয় না।

কিন্তু ছােটটা যেমন অবাধ্য, তেমনি গোঁয়ার। ভূত চাপল তার মাথায়। কেন আমি মানুষকে শিকার করতে পারব না? বুদ্ধি দিয়ে আমার শক্তির মােকাবিলা করবে সে? ফুঃ। জেদ ধরল, মানুষ মেরেই খাবে সে। কারাে বারণ না শুনে, বেরিয়ে পড়ল ছোটটি।

জঙ্গল থেকে বেরিয়েই, ঘাসজমিতে একটা গরুর সাথে দেখা। বাঘ বলল-"তুমি কোন জীব হে? মানুষ না কি?”

গরু বলল-- "আমি কী করে মানুষ হব १ আমি তো একটা বুড়াে বলদ।”

বাঘ বলল-- "মানুষের দেখা কোথায় পাব, বলতে পারাে?"

“কেন বল তাে?” বলদ অবাক হয়ে জানতে চাইল-- “মানুষ দিয়ে কী করবে?"

বাঘ বলল-- “কী আর করব? মারব, আর চিবিয়ে খাব!”

বলদ আঁতকে উঠে বলল-- "খবরদার নয়। নিজেই বেঘােরে মারা পড়বে।"

'আমি মারা পড়ব ? চোখে পড়লে, হাতিকেও কাবু করতে পারি আমি, তা জানাে ?"

"মানুষ হল আরও ভয়াণক জীব।” বলদ বলল-- “আমার পিঠে লাঠির দাগ দেখতে পাচ্ছাে ? সারা জীবন চাবুক মেরে খাটিয়েছে আমাকে। ভালাে কথা বলছি, মানুষের মুখােমুখি না হওয়াই ভালাে।”
বলদের কথা কানে না তুলে, বাঘ এগিয়ে চলল।

এবার সামনে এক বুড়াে হাতি। চেহারা বড়সড়, কিন্তু হাড়-পাঁজরা বার করা।। চামড়া ঝুলে পড়েছে। বাঘ তাকে বলল-- “তুমি আবার কোন জীব গাে? তুমিই কি মানুষ ?”

হাতি ঘাস খাচ্ছিল। বাঘ এসেছে, খেয়াল করেনি। সে বলল-- "মানুষ হব কোন সৌভাগ্যে ? আমি তাে একটা বুড়াে হাতি।”

বাঘের একই কথা-- "মানুষের দেখা পাবাে কোথায়, বলতে পারাে ?”

ছােট্ট আর কুতকুতে দুটো চোখ তুলে, অবাক হয়ে বাঘকে দেখতে লাগল হাতি-- "কেন গাে, এমন দুর্মতি কেন হােল তােমার ? মরবার সাধ জেগেছে বুঝি ?"

“মরতে যাব কোন দুঃখে? আমিই তাে মারব মানুষকে।"

হাতির মুখে কথা সরে না। বাঘ তাকে মনের সাধ খুলে বলল। হাতিও তাকে নিজের দুর্ভাগ্যের কথা বলল। অত বড় চেহারা হলেও, সারা জীবন তাকে অঙ্কুশের খোঁচায় খাটিয়ে মেরেছে মানুষ। যেই বুড়াে হয়েছে, দূর-দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছে। হাতি বলল-- "জোয়ান বয়স তোমার। কেন বেঘােরে জানটা দেবে? ফিরে যাও।"

কিন্তু বাঘ তাে উপদেশ শুনতে আসেনি। সে এগােতে থাকল। এবার এক পাল বানরের সাথে দেখা। পূঁচকেগুলাোেকে দেখে বাঘ হাঁক পাড়ল-- "অ্যাই, শােন এ দিকে।"

পালের গােদাটা এগিয়ে এল খানিকটা। এক লাফে সরে পড়তে পারে, ততটা দূরত্ব রেখে দাঁড়াল। বাঘ বলল- “হ্যাঁরে, তােরা কি মানুষ?"

বানর একটু হতভম্ব। এদিক ওদিক তাকিয়ে, কাছাকাছি কোনও মানুষ আছে না কি, দেখে নিল চট করে। তারপর বলল-- "না, না। আমরা তাে বানর। দুটো করে হাত আর পা থাকলেও, মানুষ হতে এখনও ঢের দেরি আমাদের।"

অত তত্ত্বকথা বাঘের মাথায় ঢুকল না। সে বলল-- "মানুষ কেমন জীব, বলতে পারিস?”

বানর সাবধানি গলায় বলল-- "ভারি ধুরন্ধর জীব এই মানুষ। তার সামনা-সামনি না পড়াই ভালাে। আমি চললাম।” বলেই এক লাফ। চোখের নিমেষে পুরো পালটাও উধাও।

আরও খানিক এগােবার পর, একটা বন। ভিতর থেকে একটা শব্দ ভেসে আসছে। সেদিকে এগিয়ে বাঘ দেখল, কুড়ল দিয়ে মােটা একখানা গাছে কোপ মারছে কে একজন।

বাঘ তাকে বলল-- "তুমি কোন জীব হে?”

কাঠুরিয়া বিরক্ত হয়ে বলল-- "কেন, দেখতে পাচ্ছ না, আমি একজন মানুষ ?”

ভারি আহ্লাদ হল বাঘের। বলল-- “আহা, কী সৌভাগ্য আমার। মানুষ শিকার করে খাবার সাধ পূরণ হবে এতক্ষণে।

বাঘের কথা শুনে সে কী হাসি কাঠুরিয়ার। থামতেই চায় না। বাঘ তাে হতভম্ব। বলল-- "এত হাসির কী হল তােমার ? মরবে তাে এখুনি।"

"অমনি অমনি হাসছি না কি? হাসছি তােমার বুদ্ধুমি দেখে। কেউ সাবধান করে দেয়নি তােমাকে, মানুষ হল সবচেয়ে বুদ্ধিমান জীব ? তাকে শিকার করা যায় না?" 
বাঘ বলল- “তা অবশ্য অনেকে বলেছে। কিন্তু আগে জানতে হবে, এই বুদ্ধিটা ঠিক কী জিনিষ ?"

কাঠুরিয়া হেসে বলল-- " ওহ্ এই কথা ? ঠিক আছে, একটু কষ্ট করে এসাে আমার সাথে। মানুষের বুদ্ধি, ক্ষমতা, কৌশল-- সব দেখিয়ে বুঝিয়ে দেব তােমাকে।”

বাঘ তাতে রাজি। রইল গাছ কাটা। কুড়ুল নিয়ে বাড়ি চলল লােকটা। মনে মনে ফন্দি এঁটে নিয়েছে। উচিত শিক্ষা দেবে আজ ব্যাটাকে। বাঘ চলল তার পিছন পিছন।
কাঠের মােটা মােটা গুঁড়ি দিয়ে বানানাে ভারি মজবুত বাড়ি কাঠুরিয়ার। এমন জিনিষ বাঘ কখনাে দেখেনি। সে বলল-- “এটা কী ?”

উপহাসের হাসি হেসে, কাঠুরিয়া বলল-- "এর নাম-- ঘর। তােমরা থাকো পাহাড়ের গর্তে। তার মতো গরমে পুড়ে মরা, বর্ষায় ভেজা বা শীতে কাবু হতে হয় না এই ঘরে। মানুষ থাকে এখানে। তােফা আরামে এই ঘরে থাকি আমি ”

বাঘমশাইর তাে লােভে চোখ পিটপিট করছে। কাঠুরিয়া আড় চোখে তা দেখে বলল-- "এবার তোমাকে দেখাচ্ছি, কী করে ঘরটায় থাকতে হয়।" গট গট করে গিয়ে ঘরে ঢুকে, খিল তুলে দিল কপাটের। জানালা খুলে মুখ বাড়িয়ে বলল-“এবার দ্যাখাে, ঘর কাকে বলে। গরম, বৃষ্টি বা ঠাণ্ডার ভয় নাই। ভয় নাই বাঘ, ভালুক, সিংহেরও। যেমন আরাম, তেমনি নিরাপদ। এবার বুঝেছ তাে, হাঁদারাম।"

দেখে শুনে, বাঘের যেমন লােভ হােল, রাগ তার চেয়েও বেশি। গরগর করে বলল-- "তুই হতভাগা ওখানে থাকবি কোন সাহসে? আমি দেখতে যেমন সুন্দর, তেমনি আমার গায়ের জোর। জানিস, এখনি ছিড়ে খেয়ে ফেলতে পারি তােকে ? বেরিয়ে আয় হতভাগা!"

কাঠুরিয়া বুঝল, তার ফন্দিতে কাজ হয়েছে। সে ভয়ের মুখ করে বল-- "না রাজামশাই। আমি বেরুই, আর তুমি ছিড়ে খেয়ে ফেলাে ? ওটি হচ্ছে না।"
বাঘ ভাবল, তাই তাে। লােকটা না বেরুলে, ঘরটা আমি পাবাে কী করে? সে বলল-- “এখুনি খাব কেন? আগে ঘরটায় থাকবার হাল-চাল, কায়দা-কসরত বুঝে নিই। খাওয়ার কাজটা তাে? সে পরে হবে এখন।"

জানালার খিল এঁটে, হাসি লুকিয়ে, মুখ শুকনাে করে, বেরিয়ে এল লােকটা। বাঘের যেন তর সয় না। তড়িঘড়ি গিয়ে ঢুকে পড়ল ঘরের ভিতর। অমনি বাইরে দরজায় শিকল তুলে দিল কাঠুরিয়া। চেঁচিয়ে বলল-- "আরাম করে থাকুন, রাজামশাই। যত দিন বাঁচবেন, এ ঘর আপনারই। তবে, গরীব কাঠুরিয়ার ঘর কি না, খাবার-দাবার বলতে কিছুই নাই। বাতাস খেয়ে যে কটা দিন কাটাতে পারেন। বোকার বেহদ্দ কোথাকার!

হাসতে হাসতে চলে গেল কাঠুরিয়া। গাছ কাটার কাজটা বাকি পড়ে আছে তার।

জ্বলদর্চি পেজ- এ লাইক দিন👇

আরও পড়ুন 

বাড়িতে বসেই মানসভ্রমণ! 
চলুন রাশিয়া। পড়ে নিন, দেখে নিন ভিডিও। অপরূপ প্রকৃতির ইতিহাস ও বর্তমান পরিস্থিতি।
⛱️ 
রাশিয়ার দুবনা, দুবনার ভাবনা/ তথাগত বন্দ্যোপাধ্যায়। 

Post a Comment

0 Comments