জ্বলদর্চি

স্টিফেন ব্ল্যাকহোল হকিং এবং তাঁর বিকিরণ /পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা

বিজ্ঞানের অন্তরালে বিজ্ঞানী ।। পর্ব ― ০৬
পূর্ণ চন্দ্র ভূঞ্যা

স্টিফেন ব্ল্যাকহোল হকিং এবং তাঁর বিকিরণ 

দিনটা ছিল ১২-ই আগস্ট ২০০৯ খ্রিস্টাব্দ। বুধবার। স্থান বিখ্যাত হোয়াইট হাউসের সুসজ্জিত ইস্ট রুম (East Room)। একঝাঁক হেভিওয়েট ব্যক্তি কক্ষে অপেক্ষারত সেদিন। অল্প ক্ষণ পরে উপস্থিত হবেন আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সম্মাননীয় প্রেসিডেন্ট। স্ট্যাচু অব লিবার্টি'র সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান 'দ্য প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম' (The Presidential Medal of Freedom) প্রদান অনুষ্ঠানে। দেওয়া হবে এক কিংবদন্তি বিদেশী তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানীকে। আইজাক নিউটন ও আলবার্ট আইনস্টাইনের পর বিজ্ঞানের এক জীবন্ত জিনিয়াস তিনি। ইতিমধ্যে কেবল বৈজ্ঞানিক চিন্তাভাবনায় নয়, অসম জীবনযুদ্ধে মোটিভেশনের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তিনি। 
 
  তো, অনুষ্ঠান কক্ষে প্রবেশ করলেন আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম ও একমাত্র কৃষ্ণাঙ্গ রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামা। যিনি নিজেই জীবন সংগ্রামে গগনসম প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে সাফল্যের জলজ্যান্ত এক প্রমাণ। উঠে দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানাল হলভর্তি সেলিব্রেটি। কিন্তু, এ কী! সেই বিদেশি অতিথি সৌজন্যবশত উঠেও দাঁড়ালেন না! 
           

  সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে প্রেসিডেন্ট ওবামা মঞ্চে উঠে কি-না হাসিমুখে তাঁর গুণকীর্তন শুরু করে দিলেন!― 'এই মহান বিজ্ঞানী তাঁর বিখ্যাত হুইলচেয়ার থেকে এই অপরূপ মহাবিশ্বের অপরিচিত দূরতম কিনারে বিষ্ময়কর ভ্রমণের সুযোগ করে দিয়েছেন আমাদের। তা করতে গিয়ে তিনি আমাদের কল্পনাশক্তি আলোড়িত করে দিয়েছেন এবং পৃথিবীতে মনুষ্য শৌর্যের অন্তর্নিহিত শক্তি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন।' তারপর অতিথি বিজ্ঞানীর ভাষণ। জীবনের প্রতি পদে সবকিছু ছাপিয়ে তাঁর সফলতার কাহিনী। তাঁর সে-বক্তব্য প্রথমবার হোয়াইট হাউসের পক্ষ থেকে বিশ্বের জনসমক্ষে লাইভ টেলিকাস্ট দেখানো হয় ২০১৩ সালের ৮-ই জানুয়ারি। শ্রদ্ধেয় বিজ্ঞানীর ৭১-তম জন্মদিনের সম্মানে। 

  কিন্তু কে সেই বিজ্ঞানী? বিদেশি হলেও যাকে আমেরিকার সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান প্রদান করা হল! সেদিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার আগমনে অন্যান্য অতিথি অভ্যাগতের ন্যায় যিনি নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন না! বরং প্রেসিডেন্ট ওবামা হাসি মুখে তাঁকে মেডেল পরিয়ে দিলেন! 

  তিনি আর কেউ নন, বিশ্ববিখ্যাত ব্রিটিশ তাত্ত্বিক পদার্থবিদ, মহাকাশবিজ্ঞানী ও বিজ্ঞান লেখক স্টিফেন হকিং। অসুস্থতার কারণে নিজে জীবনের অধিকাংশ সময় হুইলচেয়ারে বন্দি থাকলেও পৃথিবীতে মানবজাতির কল্যাণে সর্বদা নিয়োজিত এক প্রাণ। ২০০৬ সালে তিনি প্রশ্ন তুলেছিলেন― "রাজনৈতিক, সামাজিক ও পরিবেশগতভাবে বিশৃঙ্খল এই পৃথিবীতে মানবজাতি কীভাবে আরও ১০০ বছর টিকে থাকবে? আমি এর উত্তর জানি না। এজন্যই আমি এই প্রশ্নটি করেছি, যাতে মানুষ এই বিষয় নিয়ে ভাবে এবং এখন আমরা যে সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছি তা সম্পর্কে সতর্ক থাকে।"

  হকিং উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন হঠাৎ পারমাণবিক যুদ্ধ, ভাইরাস, বিশ্ব-উষ্ণায়ন বা মানুষ যা ভাবেনি এমন বিপদ (গ্রহাণু বা উল্কা পতন, এলিয়েন আক্রমণ ইত্যাদি) থেকে পৃথিবীতে মানুষ ও অন্যান্য প্রজাতির জীবন ঝুঁকিতে রয়েছে। আসলে পৃথিবীতে এ হেন বিজ্ঞানীর আগমন হয়েছিল এক কঠিন সংকটাপন্ন সময়ে।

  সময়টা ১৯৪১-১৯৪২ সাল। জোরকদমে চলছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। যে কোনো সময় লন্ডনে জার্মান বোমা পড়ার আশঙ্কা। লন্ডনে তখন প্রায়শই সাইরেন বাজে; "বোমারু বিমান আসছে"। সে-সময় স্টিফেন মাতৃগর্ভে। তাঁরা তখন সপরিবার থাকতেন উত্তর লন্ডনের হাইগেট অঞ্চলে। স্টিফেন-এর পিতা চিকিৎসক অধ্যাপক ফ্রাঙ্ক নিরাপত্তার কথা ভেবে স্ত্রী ইসোবেলা-কে অক্সফোর্ডে পাঠিয়ে দেন। সেখানেই স্টিফেন জন্মান ১৯৪২ সালের ৮-ই জানুয়ারি। এ হেন তারিখটার কী অদ্ভূত সমাপতন! আজ থেকে ৩০০ বছর আগে এই দিনেই (৮-ই জানুয়ারি) আধুনিক বিজ্ঞান নির্ভর চিন্তাধারার সফল রূপকার গ্যালিলি গ্যালিলিও প্রয়াত হয়েছিলেন। আর সেদিনই জন্ম হল বিংশ শতাব্দীর একজন জনপ্রিয় বিজ্ঞান চরিত্রের।

  তো, যুদ্ধের অবস্থা কিছুটা পরিবর্তিত হলে মা-ছেলে পুনরায় হাইগেটে ফিরে আসেন। সেখানকার 'বাইরন হাউস স্কুল'-এ ছোট্ট স্টিফেনের লেখাপড়ায় হাতেখড়ি হয়। কিন্তু ১৯৫০ সালে সিনিয়র হকিং National Institute for Medical Research-এর প্যারাসিটোলজির বিভাগীয় প্রধান নিযুক্ত হলে তাদের পুরো ফ্যামিলি হার্টফোর্ডশায়ারের সেন্ট অ্যালবানস-এ চলে আসে। সেখানে সেন্ট অ্যালবানস হাইস্কুল ফর গার্লস-এ ভর্তি হয়ে যান ছোট্ট স্টিফেন। সেখানে ছেলেরা ১০ বছর পর্যন্ত পড়ার সুযোগ পেত। ১০ বছর পেরিয়ে গেলে হকিং সেখান থেকে প্রথমে রেডলেট স্কুলে ও পরে ১৯৫২ সালের সেপ্টেম্বরে সেন্ট অ্যালবানস স্কুলে ভর্তি হন। লেখাপড়ার ব্যাপারে তাদের পরিবার খুব সচেতন। সিনিয়র হকিং ছেলেকে ওয়েস্টমিনস্টার স্কুলে পড়াতে চান। কিন্তু স্কলারশিপ পরীক্ষার দিন তেরো বছরের কিশোর হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে। বাধ্য হয়ে সেন্ট অ্যালবানস স্কুলে পঠনপাঠন চলতে থাকে তাঁর। গণিতে অত্যন্ত মেধাবী সে। স্কুলের বন্ধুরা তাকে 'আইনস্টাইন' বলে খ্যাপাত। খুব স্নেহ করেন অংকের টিচার ডিকরান ট্যাহতা। অংকের এই মাস্টারমশায় তাকে বিজ্ঞানের প্রতি অনুরক্ত করে তোলে। দুজনে মিলে কম্পিউটার, টেলিফোন সুইচবোর্ডসহ আরও অনেক জিনিস ইতিমধ্যে বানিয়ে ফেলেছে। হকিং অবশ্য বন্ধু পরিমণ্ডলে খেলাধুলা, বোটিং, মজার গেম উপভোগ করতে খুব ব্যস্ত। 

  এদিকে বাবা-মা চায় ছেলে বড়ো হয়ে ডাক্তার হোক। ছেলের পছন্দ ফিজিক্স-কেমিস্ট্রি। যদিও ছেলের জেদের কাছে হার মানে মা-বাবা। তারা দুজনেই অক্সফোর্ডে ইউনিভার্সিটি কলেজে পড়াশোনা করেছেন। তাদের একান্ত ইচ্ছা― ছেলে এখান থেকে গ্র্যাজুয়েট হোক। শেষমেশ সেখানে পদার্থবিদ্যায় গ্র্যাজুয়েশন পঠনপাঠন শুরু হয় ১৯৫৯ সালের অক্টোবরে। ১৯৬১ সালে প্রথম শ্রেণিতে বি.এ. ডিগ্রি পরীক্ষা পাস করেন তিনি। যদিও অক্সফোর্ডে শিক্ষাদান পদ্ধতি তাঁর মনঃপূত ছিল না। তাই অক্সফোর্ড ছেড়ে কেমব্রিজে গবেষণা শুরু করলেন তিনি। প্রিয় বিষয় সাধারণ অপেক্ষবাদ ও বিশ্বতত্ত্ব। গাইড হিসেবে বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ ফ্রেড হয়েল'কে চেয়েও পেলেন না। অগত্যা আধূনিক কসমোলজি'র একজন স্থপতি অধ্যাপক ডেনিস উইলিয়াম স্কিয়ামা'র অধীনে গবেষণা তাঁর পক্ষে শাপে বর হল।

  ১৯৬২ থেকে তিনি শারীরিক অসুস্থতা অনুভব করতে থাকেন। ১৯৬৩ সালের গোড়ায় দু'সপ্তাহ হাসপাতালে ভর্তি থেকে নানারকম পরীক্ষা নিরীক্ষার পর এটা নিশ্চিত হয় যে তিনি দূরারোগ্য মোটর নিউরন রোগ 'অ্যামিওট্রফিক ল্যাটার‍্যাল স্কেলেরোসিস  (Amyotrophic lateral sclerosis বা ALS)-এ আক্রান্ত। যা একটি বিরল স্নায়ুঘটিত রোগ। সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। ডাক্তার জবাব দিলেন, 'বেশিদিন বাঁচবেন না তিনি'। খুব বেশি হলে দু'বছর! তার মধ্যে পিএইচডি শেষ করতে পারবেন কি-না সন্দেহ। গভীর হতাশ হয়ে পড়লেন হকিং। 
          
  এ সময় এক মজাদার ঘটনা ঘটে। ১৯৬২ সালের শেষের দিকে তাঁর জীবনে আসেন জেন ওয়াইল্ড। জেন-এর সান্নিধ্যে এসে বাঁচার রসদ খুঁজে পায় যুবক হকিং। পিএইচডি সমাপ্ত করে চাকরির চেষ্টা করেন তিনি। ১৯৬৬-তে ডক্টরেট হন ও সে-বছরই অক্সফোর্ড গনভিল অ্যান্ড কেয়াজ কলেজে গবেষক নিযুক্ত হন। ক'মাস পরেই জেন'কে বিয়ে করে ফেলেন। তাদের তিন সন্তান। বড় ছেলে রবার্ট জন্মায় ১৯৬৭ সালে, মেয়ে লুসি ১৯৭০ সালে এবং ছোট ছেলে ১৯৭৯ সালে। আনন্দের কথা এদের কেউ প্রতিবন্ধী নন। বাবার মতন মারণব্যাধির শিকার হয়নি কেউ। 

  এদিকে তাঁর নিরবচ্ছিন্ন গবেষণা চলছে সমানতালে। ১৯৬৫ থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত বিজ্ঞানী রজার পেনরোজের সঙ্গে সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ অনন্যতা (Singularities) বিষয়ে গবেষণা শুরু করেন। পরে এই অনন্যতা ব্ল্যাকহোলের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হয়। প্রিয় পাঠক, আপনার অবগতির জন্য জানাই― এই ব্ল্যাকহোল তত্ত্বের জন্য গতবছর (২০২০) পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার জেতেন বিজ্ঞানী পেনরোজ। ১৯৭০ পর্যন্ত হকিং বিশ্বতত্ত্ব (Cosmology) গবেষণায় মেতে ছিলেন। এরপর তিনি কৃষ্ণগহ্বর নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। কিন্তু কৃষ্ণগহ্বর কী? খায়, না মাথায় মাখে? ব্রম্ভাণ্ডে তার বাস্তব অস্তিত্ব আছে কি? যদি থাকে, কোন ধারণার ভিত্তিতে পণ্ডিতদের মনে প্রথম এমন ঘটনার উদ্রেক হয়? যদি সবকিছু আস্ত গিলে খায় সে, কোনকিছু ফেরায় না; তবে কীভাবে তার অস্তিত্ব বিজ্ঞানীদের গোচরে আসে? এমন হাজারো প্রশ্নে ফালা ফালা হয়ে যায় অনুসন্ধিৎসু সাধারণ মন।

  কৃষ্ণগহ্বর হল শূন্যস্থানের এমন এক অঞ্চল যা গিলে খায় তার আশপাশে থাকা সবকিছু– কলাটা, মুলোটা, গাছপালা, পাহাড়, পর্বত, গ্রহ, উপগ্রহ, নক্ষত্র, এমনকি তড়িৎচুম্বকীয় বিকিরণ তথা আলো। স্থান-কালের অসীম বক্রতা ও অনন্ত মহাকর্ষ টানের জন্য কৃষ্ণগহ্বরের মুক্তিবেগ শূন্যস্থানে আলোর বেগের চাইতে অনেক বেশি হয়। তাই সমস্ত পদার্থ ও আলোককে ব্ল্যাকহোল গিলে খায়। কোন কিছু উগরে বের করে দেয় না। কৃষ্ণগহ্বরের বাইরের চারপাশে পরিধি বরাবর একটি আলোকোজ্জ্বল অঞ্চল দেখা যায়। এই অঞ্চলটিকে 'ইভেন্ট হরাইজন' বা 'ঘটনা দিগন্ত' বলা হয়। ১৯৬৪ সালে মহাকাশে হংসমণ্ডল নক্ষত্রমণ্ডলী (Cygnus)-তে একটা শক্তিশালী এক্স রশ্মির সন্ধান পাওয়া যায়। এই এক্স রশ্মির উৎস কৃষ্ণগহ্বর কি-না ১৯৭৫-এ এমন বাজি ধরে ১৯৯০-তে ক্যালিফোর্নিয়া ইন্সটিট্যিট অব টেকনোলজি'র কিপ থর্ন-এর কাছে হেরে যান স্টিফেন হকিং। যদিও তিনি ৯৫ শতাংশ নিশ্চিত ছিলেন যে ওটা একটা কৃষ্ণগহ্বর। আসলে ইচ্ছে করেই বাজি হেরেছিলেন তিনি। 
          

  প্রতীয়মান একটি ব্ল্যাকহোল কি শুধু কুম্ভকর্ণের মতো খায়-দায়-ঘুমায়, কোনকিছু নির্গমন করে না? ১৯৭০-এ মেয়ে লুসির জন্মের ক'দিন পর এক সন্ধ্যায় তিনি ঘুমোতে যাবেন। এমন সময় ঘটে গেল এক আশ্চর্য ঘটনা। তাঁর মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে একটি সমাধান। অবশ্যই কৃষ্ণগহ্বরের বিকিরণ সংক্রান্ত। উত্তেজনায় সারারাত চোখের পাতা এক করতে পারেননি তিনি। এই সমাধানই তাঁর শ্রেষ্ঠ আবিষ্কার। সেই কণাবাদী তত্ত্বের ভিত্তিতে কণাবিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং ১৯৭৪ সালে ব্ল্যাকহোল সমস্যার একটি যুগান্তকারী ঘটনা আবিষ্কার করেন। 'ব্ল্যাকহোল রেডিয়েশন'। কৃষ্ণগহ্বর বিকিরণ। যা হকিং রেডিয়েশন নামেও বিখ্যাত। 

  হকিং বিকিরণ কী? কীভাবে জন্মায় এ হেন রেডিয়েশন?

  তার আগে জানা প্রয়োজন― শূন্যস্থান কী? শূন্যস্থান একদম শূন্য (Empty― ফাঁকা বা অন্তসারশূন্য) নয়, বরং বিকিরণের (ফোটোন কণা) আধার; যা থেকে ক্ষণিকে জন্ম নেয় একজোড়া পারটিক্যাল― একটি কণিকা ও অপরটি তার বিপরীত কণিকা। পরক্ষণেই কণিকা―বিপরীত কণিকা সংযুক্ত হয়ে একজোড়া ফোটোন কণিকা ওরফে আলোক স্ফুলিঙ্গ (বিকিরণ) তৈরি করে। চক্রবৎ বিকিরণ থেকে কণিকা ও কণিকা থেকে বিকিরণে পরিবর্তন প্রতি মূহুর্তে ঘটছে শূন্যস্থানের ভেতরে। 

  এই একজোড়া কণিকার একটি পরা (ধনাত্মক) শক্তি সম্পন্ন ও অপরটি অপরা (ঋণাত্মক) শক্তি সম্পন্ন। অপরা শক্তির কণিকা স্বল্পায়ু হয়। কারণ বাস্তব সব কণাই স্বাভাবিক অবস্থায় ধনাত্মক শক্তি সম্পন্ন। এখন কৃষ্ণগহ্বরের ঘটনা দিগন্তের খুব নিকটস্থ শূন্যস্থানে বিকিরণ থেকে একজোড়া কণিকা তৈরি হলে তার তিনটি সম্ভাবনা থাকে―

  এক, কণিকাদুটি তৈরি হল ও সঙ্গে সঙ্গে জোড়া লেগে বিকিরণ উৎপন্ন করে পুনরায় ধ্বংস হয়ে গেল।

  দুই, কণিকাদুটি তৈরি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্ল্যাকহোলের অসীম মহাকর্ষজনিত টান তাদের দুটিকে জোরপূর্বক টেনে কৃষ্ণগহ্বরের ভেতরে ঢুকিয়ে দিল। তারা আর বাইরে বের হতে পারল না। অর্থাৎ তাদের সলিলসমাধি ঘটল।

  তিন, একজোড়া কণিকার মধ্যে অপরা শক্তির কণিকাটিকে ব্ল্যাকহোল তার ঘটনা দিগন্তে ঢুকিয়ে নিল। কিন্তু পরা শক্তির কণিকাটিকে সে ধরতে পারল না। এই পরা শক্তি সম্পন্ন কণিকা তীব্র বেগে ব্ল্যাকহোলের ঘটনা দিগন্ত থেকে ছুটে দূরে পালিয়ে গেল। আর পালানোর সময় সে যতটা বেশি সম্ভব ব্ল্যাকহোলের শক্তি ঘটনা দিগন্ত থেকে চুরি করে নিয়ে গেল। ব্ল্যাকহোলের বাইরে অবস্থিত কোন পর্যবেক্ষক দেখবে কণিকাটি যেন কৃষ্ণগহ্বর থেকে নির্গত হল। এ হেন কণিকা (ফোটোন কিংবা বাস্তব কণিকা)-র স্রোত হল কৃষ্ণগহ্বর বিকিরণ বা হকিং রেডিয়েশন। আইনস্টাইনের {E = mC^2} সমীকরণ মেনে এই নিঃসৃত বিকিরণ ব্ল্যাকহোলের ভর ও ঘূর্ণন ক্ষমতা ক্রমশ কমিয়ে দেয়। এই ঘটনা 'ব্ল্যাকহোল এভাপোরেশন' (কৃষ্ণগহ্বর বাষ্পীভবন) নামে পরিচিত। যা তিনি ১৯৮১ সালে প্রস্তাব দেন। এর ফলস্বরূপ ভর কমতে কমতে একসময় কৃষ্ণগহ্বরটি ভ্যানিশ হয়ে যাবে। অবশ্য এর জন্য কৃষ্ণগহ্বরের ১০^৬৬ (Ten to the power 66 বা দশের ঘাত ৬৬, যেমন দশের ঘাত ৩ = ১০০০) বছর সময় লাগবে। এখন ব্রম্ভাণ্ডের বয়স সবেমাত্র (১৩.৮ ×১০^০৯) বছর বা (১৩.৮ × ১,০০০,০০০,০০০) বছর। তাই সে-ক্ষণ আসতে এখনও অনেক দেরী। তার আগে মহাজগতে গ্রহ-উপগ্রহ-নক্ষত্র-গ্যালাক্সি ইত্যাদি সব ধ্বংস হয়ে যাবে। পড়ে থাকবে কিছু ব্ল্যাকহোল। সেটা 'ব্ল্যাকহোল যুগ' (১০^৪০ ― ১০^১০০ বছর সময়কাল) নামে অভিহিত হবে। 

  ১৯৮৫ সালে তিনি একবার সুইজারল্যান্ডের জেনেভা শহরে 'সার্ন'-এর ল্যাবরেটরি ঘুরে দেখেন। সেখানে তিনি নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে পড়েন। সংক্রমণ এড়াতে অপারেশন করে তাঁর শ্বাসনালী কেটে বাদ দিতে হয়। বসানো হয় কৃত্রিম টিউব। এর ফলে বাকশক্তি সম্পূর্ণ হারিয়ে যায়। অবশ্য এর অনেক আগে থেকেই তিনি তাঁর জন্য বিশেষ ভাবে তৈরি হুইলচেয়ারে বন্দি। সে-সময় তিনজন সন্তান এবং নিজের জন্য খরচ আকাশ ছোঁয়া। ভাবলেন সাধারণের জন্য লিখবেন বিজ্ঞান নির্ভর পুস্তক। বই লিখে যদি কিছুটা আর্থিক সুরাহা পাওয়া যায়। যেই ভাবা, অমনি কাজ। ১৯৮৮-তে বের হল তাঁর 'কালের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস' (A Brief History of Time)। অল্প সময়ের মধ্যে বইটি বেস্ট সেলার! শুধু তাই নয়, এই বইটি তাঁকে খ্যাতির শিখরে পৌঁছে দেয়। তাঁর লেখা আরও কতগুলি বই হল― The Grand Design (2010), Brief Answers to the Big Questions (2018), My Brief History, Black Holes and Baby Universe and other essays, The Universe in a Nutshell প্রভৃতি।

  এত কিছুর পরেও তিনি স্বপ্ন দেখেন। অন্তরের অন্তরালে লালন করেন সে-স্বপ্ন। দীর্ঘ দিনের তাঁর সুপ্ত বাসনা ছিল মহাশূন্যে ওজনহীনতা অনুভব করা। সার্থক রূপ পেল তাঁর জীবনভরের অধরা স্বপ্ন, ২০০৭ সালে। সেদিন একটি বিমান 'বোয়িং ৭২৭' তাঁকে নিয়ে মহাকাশে রওনা হল ফ্লোরিডার কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে। বিমানের স্ক্রু মেম্বারদের সহযোগিতায় মহাশূন্যে চার মিনিট সময় কাটালেন তিনি। তার মধ্যে আট বার ডিগবাজি মারেন। দু'ঘন্টা পর অবতরণ করে বিমান। চূড়ান্ত ঝুঁকিপূর্ণ ছিল তাঁর এই 'জিরো গ্র্যাভিটি' যাত্রা। এমনকি মৃত্যু হতে পারত তাঁর। কিন্তু না! মৃত্যু ভয়ে তিনি ভীত সন্ত্রস্ত নন। কারণ তাঁর সমাধিতে লেখা সমীকরণই এর জলজ্যান্ত প্রমাণ।
            
  তিনি জন্মেছিলেন গ্যালিলিওর মৃত্যুবার্ষিকীতে। আর মৃত্যুবরণ করলেন আইনস্টাইনের ১৩৯-তম জন্মবার্ষিকীতে। ২০১৮ সালের ১৪ই মার্চ, স্টিফেন হকিং ইংল্যান্ডের কেমব্রিজে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর শেষ ইচ্ছা অনুসারে তাঁর সমাধির ওপর স্বর্ণাক্ষরে এখনও জ্বল জ্বল করছে একটি সমীকরণ।
              

  এ হেন সমীকরণটি বিখ্যাত 'হকিং বিকিরণ'-এর সমীকরণ হিসাবে। শুধু এই সমীকরণ নয়, জীবনের পর তাঁর "এপিটাফ" (সমাধিস্তম্ভ-লিপি) যেন মৃত্যুর চোখে চোখ রেখে সদর্পে ঘোষণা করছে, "অবশেষে তুমি আমাকে অধিকার করেছ, হারাতে পারনি!"

  তাঁর এ হেন ঘোষণায় স্পষ্ট, মৃত্যু তাকে এখনও গ্রাস করতে পারেনি। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, "বিগত ৪৯ বছর ধরে আমি অকালমৃত্যুর সম্ভাবনা নিয়ে বেঁচে আছি। আমি মৃত্যু ভয়ে ভীত নই।"

  তিনি আরও বলেন, "আবার মৃত্যুর ব্যাপারে আমার কোনও তাড়া নেই। আমার আরও অনেক কাজ আছে যেগুলো আমি করতে চাই।" তাই মৃত্যু নয়, আসলে মানুষটি যেন অজ্ঞাত কোনও 'কৃষ্ণগহ্বর'-এর গোপন আস্তানায় এখন আত্মগোপন করে আছেন। 

  সাক্ষাৎ মৃত্যুরূপী দুরারোগ্য মোটর নিউরন ডিজিজের মতো একটি জটিল বিরল অসুখও তাঁর মনন, চিন্তন, গবেষণার পথে অন্তরায় হতে পারেনি। এখানেই তাঁর অমরত্ব। সেজন্যই তিনি মহান। তিনি কিংবদন্তি।

জ্বলদর্চি পেজ- এ লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

1 Comments