জ্বলদর্চি

পাপুয়া নিউগিনি-র লোকগল্প / চিন্ময় দাশ

পাপুয়া নিউগিনি-র লোকগল্প

চিন্ময় দাশ

পাখির সাক্ষী

ছােটমতন একটা দ্বীপ-- নাম তার গিনি। আরাফুরা, বিসমার্ক আর সলােমন নামের তিন-তিনটা সাগর ঘিরে রেখেছে দ্বীপটাকে। তাছাড়া, এই তিন সাগরের বাইরে, একদিকে ভারত মহাসাগর, অন্যদিকে প্রশান্ত মহাসাগর তাে আছেই।

  সাত সমুদ্র আর তেরাে নদীর এই দেশ। পাহাড় আর জঙ্গলে ভরা। কত নামের কত জীবজন্তু। ক্যাঙ্গারু আর গাছ-ক্যাঙ্গারুই যে কত রকম, তার নাই ঠিক। আর আছে হাজারাে পাখপাখালি। হরেক রঙের, হরেক গড়নের পাখি সব।

  সেই তেরাে নদীর দেশে, একটা নদীর নাম মারখাম। পাহাড় থেকে নেমে, হুয়োঁ উপসাগরে গিয়ে পড়েছে। তাে, সেই নদীর তীরে একটা গ্রামে বাস করত দুটি ভাই। ছােটভাইটি যত সাধাসিধে, বড়টা ঠিক ততটাই চতুর। থাকবার মধ্যে দুটি জিনিষ ছিল বড়র-- মাথায় যত রাজ্যের বদবুদ্ধি, আর একটা পাখি। 
ছােটখাটো হলে কী হবে, দেখতে ভারি সুন্দর পাখিটি। গড়ন অনেকটা শালিক পাখির মত। পিঠের দিকটায়, ঘাড় থেকে একেবারে লেজ পর্যন্ত বাদামি-অলিভ রঙা পালকের ছাউনি। আর, নীচের দিকটায়, গলা থেকে নেমে বুক হয়ে পুরো লেজটা সােনার মত উজ্বল রলুদ রঙ। 
  ছিপছিপে এই পাখিটি (বােয়ার বার্ড) ভারি প্রিয় তার মালিকের। ওহ, হ্যাঁ। শুধু রূপই নয়, গুণও ছিল পাখির। মানুষের মত কথা বলতে পারত সেই পাখি।

  দুই ভাইয়ের দু’রকম স্বভাব। তাই খিটিমিটি লেগেই থাকত দুজনের। একদিন হয়েছে কী, জঙ্গলে কাঠ কাটতে গিয়েছিল বড়টি। ফেরার পথে দ্যাখে, ছোটর একটা ভেড়া চলে এসেছে এদিকে। লােভে চকচক করে উঠল বড়র চোখদুটো। কী নধর চেহারা! বড়র মনে হােল, কী সুস্বাদুই না হবে খেতে!

  দেরি নয়, যা করবার এখনই, এখানেই করতে হবে। হাতে কুড়ুল ছিল, ভেড়াটাকে কেটে ফেলল বড়। পুঁটলি বেঁধে কাঠের বােঝার ভিতর লুকিয়ে বাড়ি চলে এল। ঘরে বউকে বলল-- বুঝলে গিন্নি, ভালাে একটা দাঁও মেরেছি আজ। পেট ভরে মাংস খাওয়া যাবে দিন কয়েক।

  সব শুনে, বউ তাে আহ্লাদে ডগমগ। রান্নার জন্য খানিক মাংস তুলে নিয়ে, বাকিটা একটা সানকিতে রেখে, ভালাে করে কাপড় ঢাকা দিয়ে দিল।

  এদিকে ছােট গিয়েছিল শিকারে। বিকেলে ঘরে ফিরে এসে দেখল, তার একটা ভেড়া ফেরেনি। এদিক ওদিক অনেক খোঁজাখুঁজি করল, কিন্তু ভেড়ার দেখা নাই। যাই একবার, জিজ্ঞেস করে দেখি-- এই ভেবে, বড়ভাইয়ের ঘরে এসে বলল-- আমার একটা ভেড়া পাওয়া যাচ্ছে না। তুমি কোনও হদিশ দিতে পারবে?
বড় যেন আকাশ থেকে পড়ল-- তােমার ভেড়ার খবর আমি জানব কী করে? ভেড়া-ফেড়া আমি কিছু জানি না।

  তখনই ঘটল ঘটনাটা। একেবারে মাথায় বাজ পড়ার মত। বড়ভাইয়ের পাখিটা ছিল সেখানে। বড় সাধের পাখি তার। কত যত্ন-আত্তি করে সারাদিন। কিন্তু সে যে এমনটি করে বসবে, কে জানত?

  পাখি বলে উঠল-- জানাে না মানে? তুমিই তাে মেরেছ ভেড়াটাকে। কাল রাতে দুজনে মাংস খেয়েছ রান্না করে।

  ছােটভাই একথা শুনে চমকে উঠল। বড় ধমকে উঠল পাখিকে-- বাজে বকিস না তাে ? আমি কেন পরের ভেড়া মারতে যাবাে? কী যে বলিস তুই, তার নাই ঠিক।

  -- তুমিই তাে মেরেছ। বাকি মাংস ওই সানকিতে লুকিয়ে রেখেছে তােমার বউ। খুলে দ্যাখাে না কেন। পাখির কথা শুনে, ছােট গিয়ে ঢাকনা তুলে মাংস দেখতে পেল।

  বড় বলল-- ও মাংস তােমার ভেড়ার হতে যাবে কেন? দেশে কি ঐ একটাই ভেড়া নাকি ? কিছু সময় কথা কাটাকাটি হােল দু’জনে। শেষে মােড়লের কাছে গিয়ে হাজির হােল ছােটভাই। সব খুলে বলে, বিচার চাইল সে। 
  বিকেলে বিচার সভা ডাকা হয়েছে মােড়লের বাড়িতে। সেখানেও পাখি একই কথাই বলল-- আমার মালিকই ভেড়াটা মেরেছে। ঘরে এসে দুজনে বলাবলি করেছে, আমি শুনেছি। মাংস লুকিয়ে রেখেছিল, তাও দেখেছি আমি।

  তুমুল বিবাদ চলল সভায়। বড়ভাই বলল-- আগডুম-বাগডুম বকছে পাখিটা। পাখির মাথায় আবার মাথায় ঘিলু আছে নাকি ? একদিন সময় দাও আমাকে। কত সত্যি বলতে পারে হতভাগা, প্রমাণ করে দেব সবার সামনে।

  তার কথা মেনে নিল মােড়ল-- ঠিকআছে। কাল সকালে ফয়সালা হবে। তুমি পাখিটাকে নিয়ে এসাে কিন্তু।

  হাজারাে বুদ্ধি খেলা করে বড়ভাইয়ের মাথায়। আসবার পথেই ফন্দি এঁটে নিয়েছে সে। সেদিন আকাশে ছিল পূর্ণিমার গােল চাঁদ। ফুটফুটে জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে চারদিক। ঘরে ফিরে, একটা ঝুড়িতে পাখিটাকে ভরে, পুরু একটা চটের বস্তা ঢেকে দিল ভালাে করে। তারপর? তারপর একটা লাঠি দিয়ে সপাটে মারতে লাগল ঝুড়ির গায়ে। ঝুড়িটা কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগছে তাতে। ঝুড়ির ভিতরে ঘন অন্ধকার। পাখি ভাবল, ভারি ঝড় উঠেছে বাইরে, আর বাজও পড়ছে মুহুর্মুহু।

  লাঠি ফেলে, এবার জল এনে বস্তার উপর ছিটাতে লাগল বড়। সে জল চুইয়ে চুইয়ে পড়তে লাগল ঝুড়ির ভিতর। পাখি ভাবল, বজ্রপাত আর ঝড় থেমেছে বটে, এবার শুরু হয়েছে বৃষ্টি। ঝুড়ির ভিতর কোনরকমে গুটিসুটি মেরে বসে রইল বেচারা।

  পরদিনসকাল। মােড়লের উঠোনে বসেছে বিচার সভা। আজ ঝেঁটিয়ে লােকজন এসেছে।
 কে সত্যি বলছে-- পাখি, না কি তার মালিক, এটা দেখতে।

  মােড়লের কথায় ছােটভাই আবার তার ভেড়া হারানাের কথা বলল। বড়ভাইও যথারীতি গতকালের মত অস্বীকার করে বলল, সে কিছুই জানে না।

  তখন ডাকা হােল পাখিকে। গাঁয়ের লােকজন পাখির সাক্ষী দেখতেই এসে জড়াে হয়েছে এখানে। সবাই উদগ্রীব হয়ে আছে। পাখি একই কথাই বলে গেল, গতকাল যা বলেছিল-- আমার মালিকই মেরেছে ভেড়াটা। কাল দু'বেলা মাংস রেঁধে খেয়েছে। এখনও অনেকটাই জমা আছে বাড়িতে।

  সবাই হইহই করে উঠল। সবাই বলল-- হ্যাঁ, বড়ভাইই মেরেছে ভেড়াটা। ওকে উচিত শাস্তি দাও, মােড়ল।

  মােড়লের মনে আর কোন সন্দেহ নাই। কিন্তু দেখা গেল, বড়ভাই দাঁড়িয়ে আছে নির্বিকার। লজ্জা বা ভয় অনেক দূরের কথা। হাসি-হাসি মুখেই দাঁড়িয়ে আছে সে। মােড়ল ভারি রেগে গেল তার হাসি দেখে। বলল-- দোষ করে আবার হাসছে যে বড়? ব্যাপারটা কী ?

  -- ব্যাপার কিছু নয়। হাসছি তােমার বুদ্ধি দেখে। একটা বনের পাখি, সে বলবে সত্যি কথা। মানুষের কথার দাম নাই কোন? 
-- মানে, কী বলতে চাও তুমি? মােড়ল নয়, গাঁয়ের লােকেরাই চেঁচিয়ে উঠল এবার।

  বড় বলল-- আরে ভাই, একই কথার জবাবে, পাখি তাে একই বুলি কপচাবে। অন্য কোনাে বিষয়ে প্রশ্ন করে দেখাে ওকে। সঠিকটা বলতে পারে কি না, পরখ করে দেখা যায় তাহলে।


  -- অন্য কোনও নতুন প্রশ্ন! সেটা আবার কী ? ভেড়া পাওয়া যাচ্ছে না। পাখি বলে দিল, তুমিই দোষী। ব্যাপার তাে মিটেই গেল। আবার নতুন প্রশ্ন কীসের? প্রশ্ন করতে হয়, সে তুমিই করাে। একটা কেন, হাজারটা প্রশ্ন করাে। আমরা আর কিছু জানতে চাই না। 
  মােড়লও মাথা নেড়ে সায় দিয়ে দিল তাতে। বড় বলল-- একটা তুচ্ছ পাখির সাক্ষীতে মানুষের শাস্তি হয়ে যেতে বসেছে। কিন্তু পাখি কতটা সত্যি বলে, তা একবার যাচাই করে নিতে হবে না?

  -- ঠিক আছে, তুমিই করাে যাচাই। তবে যা করবে, তাড়াতাড়ি করাে। বেশি ধানাই- পানাই করাে না আর। 
-- একটা প্রশ্নই করছি আমি। মাত্র একটা। ঠিক আছে, একেবারে সাধারণ একটা কথাই বলি। এখানে যারা আছাে, সবারই জানা ব্যাপার। দেখি, সত্যবাদী পাখি কী বলে? 
  নিজেরই পােষা পাখি। খুব আদরেরও। গায়ে মাথায় নরম করে হাত বুলিয়ে, বড়ভাই পাখিকে বলল-- ঠিক করে বল তাে পাখি, গতকাল রাতটা কেমন কেটেছে। মানে, আবহাওয়া কেমন ছিল কাল রাতে? সত্যি কথাটাই বলিস কিন্তু, বাপু।

  পাখি বলল-- কেন গাে, ভারি দুর্যোগ গিয়েছে কাল রাতে। মােড়লের বাড়ি থেকে ঘরে ফিরে গেলাম আমরা। তারপরেই তাে ঝড় উঠল। সে কী তুমুল ঝড়! আর সেই সাথে প্রবলভাবে বাজ পড়তে লাগল।

  পুরাে জমায়েত থ' হয়ে গেল শুনে। কারও মুখে কথা নাই কোন। সবাই জানে, কাল ছিল পূর্ণিমার রাত। সাদা ওড়নার মত ফিনফিনে জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছিল চার দিক। বড় তখন বলল-- তাহলে সারা রাতই ঝড় চলল?

  পাখি বলল-- না তাে। খানিক বাদে ঝড় থেমে গেল যখন, তখন মূষলধারে বৃষ্টি পড়তে লাগল। বৃষ্টি কিন্তু অনেক্ষণ ধরে চলেছিল। আমি তাে ভিজে সপসপে হয়ে গেছলাম। 
  কারও মুখে কথাটি নাই। সবাই গম্ভীর। কেবল বড়ভাইর মুখে হাসি খেলে যাচ্ছে। সে মােড়লের কাছে এগিয়ে এসে বলল-- পাখির কথা ছাড়াে, মােড়ল। আমার কী শাস্তি হবে বলে দাও তাড়াতাড়ি। জঙ্গলে যেতে হবে আমাকে। দানাটিও নাই ঘরে।

  মােড়ল বলল-- সবাই শােন। সেই কবে থেকে বাপ-ঠাকুর্দারা বলে গিয়েছে, দশজন দোষীও যদি শাস্তি না পায়, কোন ক্ষতি নাই। কিন্তু একজনও নির্দোষী যেন সাজা না পায়। পাখির কথায় ভুল বিচার হতে যাচ্ছিল আজ। সেটা থেকে বাঁচা গেছে, এই অনেক। তবে বাপু, একটা কথা। মােড়ল বড়ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল-- আজ থেকে কেউ আর এই পাখি ঘরে পুষবে না। তুমিও এখানেই এটাকে উড়িয়ে দাও, বাপু। 
বড়ভাই নিজেও জানে, মােড়ল না বললেও, পাখিটাকে ছেড়েই দিত সে। ভবিষ্যতে আবার কখন কী ফ্যাসাদ বাধিয়ে বসে, তার কোনও ঠিক নাই। আপদ বিদেয় হলেই ভালাে। সে মােড়লকে বলল-- ঠিক আছে, তাই হােক। হােলই বা আমার এতদিনের পােষা পাখি। কিন্তু তুমি হলে মােড়ল। গােটা গ্রামের মাথা। তােমার কথা তাে মাথা পেতে মেনে নিতেই হবে। 
  সবার সামনে হাতের মুঠো আলগা করে, পাখিটাকে ছেড়ে দিল লােকটা। আকাশে ডানা মেলে উড়ে গেল পাখিটা। 
  ভাগ্যিস পাখিটা সব কথা সত্যি সত্যি বলেছিল। তাতেই তো এমন একটা ধুরন্ধর মানুষের হাত থেকে মুক্তি পেতে পারলাে কপাল গুণে।

পেজ-এ লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments