জ্বলদর্চি

স্মরণ

শ্রদ্ধা ও স্মরণ  
 ____________
পি. কে. ব্যানার্জী


জ্বলদর্চি থেকে উজ্জ্বল উদ্ধার
-----------------------------------------    

আরও একটু ভালবাসতে হবে
 পি.কে. ব্যানার্জী
(১৯৩৬ - ২০২০)

পৃথিবী একটা অদ্ভুত জায়গা। এখানে রাগ আছে, দুঃখ আছে, যন্ত্রণা...। আমার স্নেহভাজন ব্যাটমিন্টন খেলােয়াড় দীপু ঘােষ আইসল্যান্ডে থাকে। সে বলছিল, ওখানে একবার গেলেই জীবনদর্শন সব বদলে যাবে। ওখানে একজনও না খেয়ে মরে না। হুনুমান ডট কম সিনেমার শুটিং-এ বুম্বারা (প্রসেনজিৎ) ওখানে শুটিং-এ গিয়েছিল। তা সে যাই হােক, আইসল্যাণ্ডকে দেখে পৃথিবী বদলে যাবে এমনটা নয়। সে দেশ মঙ্গলগ্রহের আলাদা পকেট দেখিয়ে দেবে এমনটাও নয়। কারণ এই পৃথিবীতে আইসল্যান্ড আছে, ব্রাজিল আছে। ব্রাজিলে বিতর্ক শুরু হয়েছে : কেন খেলা হবে— কেন খেলা হবে না— এই নিয়ে। অথচ বিশ্বকাপের জন্যই তো ব্রাজিলের এত সুনাম। বিশ্বকাপের জন্য কতাে পুঁজি আসার সম্ভাবনা! অথচ বিতর্ক!


আমাদের ১২০ কোটি জনসংখ্যার দেশে সাম্যবাদ বজায় রাখতে আমরা হিমসিম খাচ্ছি। গভীর ভক্তি করি আমি, সেই শ্রী শ্রী অরবিন্দ বলেছিলেন, ২০১৫ থেকে ২৫ সালের মধ্যে আমাদের দেশ পৃথিবীকে দৃষ্টান্ত দেখাবে। সেই আশায় আছি। স্বপ্ন দেখি।

আমরা প্রত্যেকে নিজের মতো জীবনযাপন করি। সন্ন্যাস ধারণ করি, প্রেম করি, দেশের কথা ভাবি। সকালবেলা উঠে ভাবি পৃথিবীর সবকিছু ভাল হােক। আমাদের দেশের ভাল হােক। এত বড় দেশ। এত বড় সংসারকে চালানাে খুব কষ্টের। ১৯৪২, মন্বন্তরের সময় আমার ঠাকুরমা দু-হাতা ফ্যান, দু-হাতা করে ভাত দিতেন, রােজ, না খেতে পাওয়া ২০০— ৩০০ মানুষকে। আমার ছােট ভাই প্রসূন এম পি হয়েছে। তাকে বলেছি রং দেখো না। না খেতে পাওয়া মানুষের জন্য দুমুঠো অন্নের ব্যবস্থা করাে। সমাজকে দেখাে। 
আমি আমার দেশকে ভালবাসি। কেউ যদি বলে ভারতবর্ষকে কচুকাটা করব,তাহলে আমি বলব, আমাকে মেরে ফেলাে। আমি জাতপাত বিশ্বাস করি না। বিবেকানন্দের ভক্ত আমি। তাঁর কথা ভাবলে চোখে জল চলে আসে।  ভাইবোন সম্বোধনে তিনি পৃথিবীকে দিয়েছেন নতুন দিশা। তার জীবনদর্শন আমাকে অনুপ্রাণিত করে। আমার বাবা আমাকে বলতেন, ভালবাসতে শিখতে হবে। মহাত্মা গান্ধী সমগ্র পৃথিবীতে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। আজ পৃথিবীর হাজারাে সমস্যা। আমাদের দেশেরও সমস্যা বহু । তবু আমরা অন্য কোনও দেশকে আক্রমণ করিনি। লাথি মারিনি। বিবেকানন্দ, মহাত্মা গান্ধীর এই দেশ পৃথিবীর সবাইকে আপন করে নেয়।


বহু টিমের হয়ে খেলেছি, গােল করেছি একসময়। সমাজকে কিছু দিতে চেয়েছিলাম। কিছুটা পেরেছি। অনেক কিছু অপূর্ণ থেকে গেছে। আজ আমি বৃদ্ধ, আমার শরীর অশক্ত। তবু এই শরীর নিয়েই আমি মানুষের কাছে থাকতে চেষ্টা করি, ভালবাসতে চাই মানুষকে। স্বপ্ন দেখি, নতুন প্রজন্ম দেশের দায়িত্ব নেবে। আত্মশক্তিতে বিশ্বাসী হবে। হেরে যাওয়া বলে কিছু হয় না। আসলে আমরা লড়াই করছি, জীবনকে ভালবাসতে চাইছি, দেশকে ভালবাসতে চাইছি, পৃথিবীর
মানুষকে ভালবাসতে চাইছি। আমার বাবা বলতেন, জন্তকে ভালবাস -সেও তােমাকে ভালবাসবে।

আমাদের দেশে কত ভাষা, কত বিপুল জনসংখ্যা! জ্বলন্ত সব সমস্যা। সমগ্র পৃথিবীরও সমস্যা বহু। হিংসা আক্রমণ নয়, আরও আরও ভালবাসার মধ্য দিয়েই আগামী পৃথিবী সুন্দর হবে। আরও একটু ভালবাসতে হবে মানুষকে। ভালবাসতে শিখতে হবে। আমি শুভ কামনায় বিশ্বাসী। মঙ্গল যা কিছু।


 শেষে বলব, জ্বলদর্চি মানে জ্বলন্ত শিখা। সেই শিখার আগুন যেন কোনওদিন না নেভে। আমি মনে করি নিভবে না। অলিম্পিকের অনির্বাণ শিখার মতো হোক ‘জ্বলদর্চি'। 

নিভতে পারে না। কারণ আমি বিশ্বাস করি, যে কোনও কাজই আমরা পারব - পারবই। আপনাদের এই বিশেষ সংখ্যার ভাবনা --জ্বলদর্চি-র স্ফুলিঙ্গে সর্বত্র আলাে জ্বালাবে — অন্ধকার দূর করবে। আমার কাছে মেদিনীপুরও এক জ্বলন্ত শিখা। আপনাদের এই বিশ্ববোধ আমাকে জাগিয়ে তুলল আবার। আমি আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লাম। সব মানুষ ভালো থাকুক। আপনারা ভালো থাকুন-- এটাই চাই। মানুষকে ভালোবাসতে চাই।


সংযোজন : দেশকে আমরা সবাই ভালবাসি। তবে আমি একটু বেশি উগ্র।  আমি চাই সবাই আনন্দে থাকুক। ছোট ছেলেমেয়েরা খেলাধুলার মধ্যে থাকুক।  খেলাধুলার মধ্য দিয়ে দেশে দেশে বন্ধন তৈরি হোক। 
(সেপ্টেম্বর ২০১৪ / জ্বলদর্চি বিশ্ববোধ বিশেষ সংখ্যা)