(চতুর্থ পর্ব )
চিত্রা ভট্টাচার্য্য
অনমনীয় দৃঢ়তার নতজানু না হওয়ার নামই কাজী নজরুল ইসলাম | চির উন্নত শির’ কবিকে যদি একক কোনো অভিধায় চিহ্নিত করতে হয় তাহলে নিশ্চয়ই তাঁকে বলতে হবে কবি কাজী নজরুল এক ' চিরবিস্ময় বিশ্ব বিধাত্রীর '! ‘বিদ্রোহী’ কবিতার শুরুতেই‘ কবি তাঁর উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেছেন বল বীর— বল উন্নত মম শির !
যিনি জন্মগ্রহণ করেছেন ব্রিটিশ শাসিত পরাধীন ভারতবর্ষের অত্যাচারে জর্জরিত বঙ্গভূমিতেএবং দুটি বিশ্বযুদ্ধের মধ্যে যাঁর আবির্ভাব ও বিকাশ, তিনি সেই বাস্তবতাকে এমনভাবে আত্মস্থ করেছেন যে তা একই সঙ্গে তাঁকে স্বদেশের মৃত্তিকায় গভীরভাবে প্রোথিত ও আন্তর্জাতিক চেতনায় ঋদ্ধ করেছে। যিনি নির্যাতীত পরাধীন জাতির মননে চিন্তায় আরোপ করেছেন পরাধীনতার নাগপাশ থেকে মুক্তি। ১৯২১ সালে তিনি কালজয়ী কবিতা ‘বিদ্রোহী’ লিখলেন এবং এর একবছর পর ১৯২২ সালে তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় অর্ধসাপ্তাহিক পত্রিকা ধূমকেতু। সেই হিসাবে এ বছর ধূমকেতু প্রকাশের শতবর্ষ পার হয়ে আরো তিনটি বছর অতিক্রান্ত।
এতদিন পর সুদূর অতীতের দিকে মুখ ফিরিয়ে তাকালে দেখা যাবে নজরুল নামাঙ্কিত ও সম্পাদিত ধূমকেতু পত্রিকাটি কবি কে কত ভাবে প্রভাবিত করেছিল। এই পত্রিকাটি প্রকাশের পর এর সাহসী পদক্ষেপ ও ভূমিকার জন্য এটি যেমন আলোচিত হয়, একইভাবে নজরুলও আলোচিত হন। পত্রিকাটি ব্রিটিশবিরোধী বাঙালির জীবনে যেমন, তেমনি নজরুলের সাহিত্য জীবনেও বিশাল প্রভাব ফেলেছিল।জীবদ্দশায় একই সঙ্গে পুষ্পমাল্যে অভিষিক্ত হওয়া আর সমালোচনার শরশয্যায় ক্ষতবিক্ষত হওয়ার ভাগ্য নিয়ে জন্মেছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। সমকালে কবিতার জন্য, প্রতীকী অর্থে বীরের অভিধা পেয়েছিলেন, আবার কবিতার জন্যই প্রায় নিঃশব্দে শহীদ হয়েছিলেন।
বিপ্লবীদের মুখপত্র ধূমকেতু পত্রিকাটি ('১৩২৯ বঙ্গাব্দের ২৬ শ্রাবণ (১১ আগস্ট ১৯২২) র প্রথম সংখ্যায় নজরুলের অনলবর্ষী দীর্ঘ কবিতা ‘ধূমকেতু’ আত্মপ্রকাশ করে । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একটি আশীর্বানী দিয়ে ধূমকেতুকে অভিনন্দন জানান, যা প্রতি সংখ্যায় পত্রিকার শিরোনামের নিচে ছাপা হতো।
🍂
‘আয় চলে আয় রে ধূমকেতু,
আঁধারে বাঁধ্ অগ্নিসেতু,
দুর্দিনের এই দুর্গশিরে
উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন!
অলক্ষণের তিলক রেখা
রাতের ভালে হোক্ না লেখা,
জাগিয়ে দেরে চমক্ মেরে,
আছে যারা অর্ধচেতন!’
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সহ অনেক দেশবরেণ্য ব্যক্তি এবং অমৃতবাজার পত্রিকা ধূমকেতুর আবির্ভাবকে উষ্ণ অভিনন্দন জানান। শরৎচন্দ্রের কিছু নিবন্ধও এতে প্রকাশিত হয়। বিপ্লব,কৃষক-মজদুর ও মধ্যবিত্তের জাগৃতি ছিল এর মূল লক্ষ্য।
'' ধূমকেতুর গদ্য, বিশেষ করে সম্পাদকীয়র তীব্র জ্বালাময়ী ভাষায় প্রথম গদ্যেই ধ্বংসের মধ্য দিয়ে নতুন সৃষ্টির কথা বলেছেন --: ‘মাভৈঃ বাণীর ভরসা নিয়ে “জয় প্রলয়ংকর” বলে ধূমকেতুকে রথ করে আমার আজ নতুন পথে যাত্রা শুরু হল। আমার কর্ণধার আমি। আমার পথ দেখাবে আমার সত্য। ধূমকেতু কোনো সাম্প্রদায়িক কাগজ নয়। মানুষ-ধর্মই সবচেয়ে বড়ো ধর্ম। হিন্দু-মুসলমানে মিলনের অন্তরায় বা ফাঁকি কোনখানে তা দেখিয়ে দিয়ে এর গলদ দূর করা এর অন্যতম উদ্দেশ্য। মানুষে মানুষে যেখানে প্রাণের মিল, আদত সত্যের মিল, সেখানে ধর্মের বৈষম্য, কোনো হিংসার দুশমনির ভাব আনে না। যার নিজের ধর্মে বিশ্বাস আছে, যে নিজের ধর্মের সত্যকে চিনেছে, সে কখনো অন্য ধর্মকে ঘৃণা করতে পারে না।’'
কবির অগ্নিঝরা ভাষা ও নির্ভীক বক্তব্যের জন্য আট পৃষ্ঠার পত্রিকাটি দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং বিক্রয়ের দিক থেকে সেকালের সকল পত্রিকাকে ছাড়িয়ে যায়। পত্রিকায় বিপ্লবী বক্তব্য প্রচারের কারণে নজরুল রাজদ্রোহের অভিযোগে অভিযুক্ত হন এবং ১৯২৩ সালের ২৩ জানুয়ারি এক বছরের জন্য কারারুদ্ধ হন। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ২৭ জানুয়ারি সংখ্যাটি ‘নজরুল সংখ্যা’ হিসেবে প্রকাশিত হয়।
পত্রিকাটি তরুণদের মধ্যে অভাবনীয় জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। এবং প্রকাশের সঙ্গেই মুহূর্তের মধ্যে তা নিঃশেষ হয়ে যেত। প্রতক্ষ্যদর্শী কবি বন্ধু অচিন্ত্য কুমার সেনগুপ্তস্মৃতি চারণায় লিখেছেন , ‘কালির বদলে রক্তে ডুবিয়ে লেখা’ হতো এর সম্পাদকীয় প্রবন্ধগুলো।
ধূমকেতুতে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রবন্ধ ও কবিতার মাধ্যমে নজরুল অকুতোভয়ে স্বরাজ ও স্বাধীনতার দাবি ঘোষণা করলে ১৯২৩ সালের ২৩ জানুয়ারি এক বছরের জন্য কারারুদ্ধ হলে ন। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ২৭ জানুয়ারি সংখ্যাটি ‘নজরুল সংখ্যা’ হিসেবে প্রকাশিত হয় এবং পরে কিছুদিনের জন্য বন্ধ থাকলে পত্রিকাটি বীরেন সেনগুপ্ত ও অমরেশ কাঞ্জিলালের সম্পাদনায় পুনরায় প্রকাশিত হলেও কিছুদিন অনিয়মিতভাবে চলে এবং ঐ বছরেরই মার্চ মাসে চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়।
নজরুল গবেষণায় অগ্রণী ব্যক্তিত্ব রফিকুল ইসলাম বলেছেন '' ধূমকেতু আসলে নজরুলের বিদ্রোহী চেতনার শিল্পরূপ ,ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের প্রতীক। তারমতে ধূমকেতু কবিতার শব্দ চয়ন ও ছন্দ প্রথাগত কবিতার কাঠামো ভেঙে দিয়েছিল। যা পরবর্তীতে নজরুলের অন্যান্য রাজনৈতিক কবিতার পথিকৃৎ , কবির বিদ্রোহী চেতনা ও বিপ্লবী আদর্শের এক উজ্জ্বল প্রকাশ। কবির মতে ধূমকেতু কেবল মহাজাগতিক বস্তু নয় বরং এক বিশাল বিপ্লবের চেতনা পরিবর্তন ও জাগরণ ,পুরাতন ব্যবস্থাকে ধ্বংস করার শক্তির প্রতীক। ঔপনিবেশিক শাসনের বিরোধিতা করে বিপ্লবী চেতনায় এক অগ্নিঝরা কবিতা।এটি শুধুই সাহিত্য কর্ম নয়। নজরুলের রাজনৈতিক আদর্শ ও সংগ্রামের একটি শক্তিশালী হাতিয়ার যার জন্য তিনি কারাবরণ করেছিলেন। ''
ইংরেজদের লক্ষ্য করে কবি নজরুল বললেন:
‘তোমারা ভয় দেখিয়ে করছ শাসন, জয় দেখিয়ে নয়;
/সেই ভয়ের টুঁটিই ধরব টিপে, করব তারে লয়!/
মোরা আপনি ম’রে মরার দেশে আনব বরাভয়,/
মোরা ফাঁসি প’রে আনব হাসি মৃত্যু-জয়ের ফল।।
’ শত্রুর বিপক্ষে এমন সাহসী উচ্চারণ!
নজরুলের পক্ষেই সম্ভব। ফলে বারবার জেলও খেটেছেন।
নজরুলের লেখাগুলো রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনে প্রবলভাবে আলোড়ন তোলায় কবির স্বদেশপ্রেমের প্রাবল্যে বাজেয়াপ্ত হয়েছিল ৫টি গ্রন্থ ---''
‘যুগবাণী’ নিষিদ্ধ হয়েছিল ১৯২২ সালে, এছাড়া তীব্র বিদ্রোহের আগুনে উত্তপ্ত ,কবির মনের তিক্ত ভাবনার ভাষারূপ পেয়েছে --বোধন, ,শিকল পরার গান,চরকার গান,জাতের বজ্জাতি,যুগান্তরের গান,বিদ্রোহীর বাণী, মুক্তি সেবকের গানের মত উল্লেখযোগ্য রচনায় ।
বাস্তবের নিদারুণ কর্কষ আঘাতের গভীর দহন জ্বালায় পুত্র শোকে কাতর কবি। কালব্যাধি বসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়ে সাড়েচার বছরের প্ৰিয় শিশু পুত্র বুলবুলের অকাল প্রয়ান--সন্তান হারা পিতৃ হৃদয় ,চোখে জল , বুকে অনির্বান আগুন। সেই আগুনের ফুলকি বিদ্যুৎ গতিতে সমগ্র বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে সাড়া জাগালো প্রলয় শিখার প্রতিটি পংক্তিতে ।
তৎকালীন পাবলিক প্রসিকিউটর রায়বাহাদুর তারকনাথ সাধু ‘প্রলয় শিখা’ সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করে সে সময়ের কলকাতা পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের ডেপুটি কমিশনারকে জানান, বইটি ভারতীয় পেনাল কোডের ১৫৩ এ ও ১২৪ এ ধারা ভঙ্গ করেছে। তাই বইটিকে অবিলম্বে নিষিদ্ধ ঘোষণার পরামর্শ দেওয়া হয় । অবশেষে গ্রন্থটি আনুষ্ঠানিকভাবে বাজেয়াপ্ত হয় ১৯৩১ সালে। শুধু তা-ই নয়,তাঁর সংবাদ সংগ্রহের জন্য সরকার থেকে গোপনে গুপ্তচর নিয়োগ করাহলো।
এরপর একেএকে নিষিদ্ধ হলো তাঁর বেশ কয়েকটি কবিতা ও প্রবন্ধের বইয়ের সাথে ‘প্রলয় শিখা’ও ‘চন্দ্রবিন্দু’কাব্যগ্রন্থ ও । যদিও চন্দ্রবিন্দু কাব্য গ্রন্থটিতে মূলত তৎকালীন সময়ের সমাজ ও রাজনীতির প্রতি ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ, শ্লেষপূর্ণ হাস্যরস ফুটে উঠেছে।
চন্দ্রবিন্দুর দুটি কবিতা
- ‘মসজিদ পানে ছুটিলেন মিঞা মন্দির পানে হিন্দু,/
আকাশে উঠিল চির জিজ্ঞাসা করুণ চন্দ্রবিন্দু।’
‘কাফ্রি চেহারা ইংরেজী দাঁত,/
টাই বাঁধে পিছে কাছাতে/
ভীষণ বম্বু চাষ করে ওরা অস্ত্র আইন বাঁচাতে।’
উল্লিখিত পাঁচটি গ্রন্থ ছাড়াও অগ্নিবীণা, ফণিমনসা, সঞ্চিতা, সর্বহারা, রুদ্রমঙ্গল প্রভৃতি বই ব্রিটিশ সরকারের কোপানলে পড়লেও শেষ পর্যন্ত বাজেয়াপ্ত হয়নি।
নজরুলের সর্বহারা ১৯২৬ সালে প্রকাশিত হয়। ‘সর্বহারা’ কবিতায় শেষের দিকের কবির আহ্বান: ‘...মাঝিরে তোর নাও ভাসিয়ে
মাটির বুকে চল!
শক্ত মাটির ঘায়ে হউক
রক্ত পদতল।
প্রলয়-পথিক চলবি ফিরি
দলবি পাহাড়-কানন-গিরি;
হাঁকছে বাদল ঘিরি ঘিরি,
নাচছে সিন্ধুজল।
চল রে জলের যাত্রী এবার
মাটির বুকে চল।।’ (সর্বহারা)।
শ্রমিকের রক্তে ঘামে তিলে তিলে গড়ে ওঠে নাগরিক সভ্যতা। কিন্তু তাদের সামান্য মূল্যায়ন ও কোথাও করা হয় না। এ বৈষম্যের অবস্থা সর্বকালেই বিদ্যমান এবং ভবিষ্যতে ও থাকবে । এ ব্যাপারে বজ্র গম্ভীর কণ্ঠে কবির আহ্বান এলো
‘...আমরা পাতাল খুঁড়ে খনি
আনি ফণীর মাথার মণি,
তাই পেয়ে সব শনি হ’ল ধনী রে।
এবার ফণি-মনসার নাগ-নাগিনী
আয় রে গর্জে মার ছোবল।
ধর হাতুরি, তোল কাঁধে শাবল..।.’ (শ্রমিকের গান)
তারুণ্যশক্তিকে সবাই ভয় পায়। অধিকার আদায়ে ছাত্রদের অগ্রণী করে বিপথে চালনা করে বারে বারে তাদের বলিদান করা হয়। মিথ্যা মুখোশের আড়ালে স্তোকবাক্যে ভুলিয়ে দাবি আদায় থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করা হয়। তাই সে কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে উল্লেখিত ছাত্রসমাজকেও একত্রিত হতে বলেছেন কবি। যুগযুগ ধরে আন্দোলন-ও সংগ্রামে ছাত্রসমাজ ও যুবশক্তিকে জেগে উঠতে দেখা যায় নিঃসংকোচে ---
সেদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে কবি লিখলেন:--
মোদের কক্ষ্যচ্যুত ধূমকেতু-প্রায়
লক্ষ্যহারা প্রাণ,
আমরা ভাগ্যদেবীর যজ্ঞবেদীর
নিত্য বলিদান।
যখন লক্ষ্মীদেবী স্বর্গে ওঠেন/
আমরা পশি নীলঅতল।
আমরা ছাত্রদল।।’
ছাত্রদের কল্যাণেই ইতিবাচক বিশ্ব দেখা সম্ভব। কবি ছাত্রদের প্রতিনিধি হিসাবে কবিতাটির শেষে বলেন-
‘আমরা রচি ভালোবাসার
আশার ভবিষ্যৎ,
মোদের স্বর্গ-পথের আভাস দেখায়
আকাশ-ছায়াপথ।
মোদের চোখে বিশ্ববাসীর
স্বপ্ন দেখা হোক সফল।
আমরা ছাত্রদল।‘..
.সর্বপ্রথম ধূমকেতু ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা চায়। কবি স্পষ্ট ভাষায় তেজস্বী ভঙ্গিতে লিখলেন স্বরাজ টরাজ মানি না। ভারতবর্ষের এক পরমাণু অংশও বিদেশির অধীনে থাকবে না। যারা এখন রাজা বা শাসক হয়ে এ দেশে মোড়লি করে দেশকে শ্মশানভূমিতে পরিণত করছেন, তাদের পাততাড়ি গুটিয়ে, বোঁচকা-পুঁটলি বেঁধে সাগরপারে পাড়ি দিতে হবে।’'‘.
কবির অন্তরঙ্গ বন্ধু মুজফ্ফর আহ্মদের পৃষ্ঠপোষকতায় .ধূমকেতু প্রকাশ পেয়েছিল। কিন্তু পরে কংগ্রেস ও গান্ধীর রাজনীতির প্রতি নজরুলের বিশেষ অনুরাগ তিনি লক্ষ্য করে বিস্ময়ান্বিত হয়ে চিঠিতে নজরুলের কী কর্তব্য, সে সম্পর্কে জানাতে চাইলেন। রাজনৈতিক নির্দেশনা দিয়ে মুজফ্ফর আহ্মদ চেয়েছিলেন, পত্রিকাটি তে ‘ভদ্দর লোকদের’ না হয়ে কৃষক–শ্রমিকের কথা বিশেষ ভাবে বলা হোক । কিন্তু নজরুল প্রত্যুত্তরে গান্ধীর পক্ষে সমর্থন জানালেন। আসলে মুজফ্ফর আহ্মদের শ্রমিক-কৃষক সর্বহারার সমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক দর্শনের পুরোপুরি অনুগামী নজরুল ছিলেন না। যদিও তাঁর সেই উপলব্ধির অনেকটাই ছিল ভাবালুতা ও আবেগতাড়িত। পরে ভারতবর্ষের স্বাধীনতার পক্ষে কথা বলার জন্য তাঁকে কারাগারে বাসে ,কবির নিজের কথায়, ‘আমার কারাশুদ্ধি হইয়া গেল।’ ধূমকেতুর ইতিহাসে এই কারাশুদ্ধির ঘটনা সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য।‘নির্যাতিতের জাতি নাই, জানি মোরা মজলুম ভাই’। অথবা সর্বহারা কাব্যের ‘ধীবরদের গান’ কবিতায় বলেছেন ,
‘ও ভাই নিত্য নতুন হুকুম জারি
করছে তাই সব অত্যাচারীরে,
তারা বাজের মতন ছোঁ মেরে খায়
আমরা মৎস্য পেলে।’
এমন আরও কিছু কবিতাংশ
-(১) ‘তোমার অট্টালিকা,/
কার খুনে রাঙা? ঠুলি খুলে দেখ, প্রতি ইটে আছে লেখা।’
(২) ‘বেতন দিয়াছ? চুপ রও যত মিথ্যাবাদীর দল!/
কত পাই দিয়ে কুলিদের তুই কত ক্রোর পেলি বল।’
কিংবা
(৩) ‘তুমি শুয়ে রবে তেতালার পরে আমরা রহিব নিচে
অথচ তোমারে দেবতা বলিব সে ভরসা আজ মিছে।’
‘পীড়িতের নাই জাতি ও ধর্ম,
অধীন ভারতময়, তারা পরাধীন,
তারা নিপীড়িত,এই এক পরিচয়’
বলে স্বাধীনতা চেয়েছেন। শোষণ-পীড়িতের অবসান চেয়েছেন। ‘একতাই বল’ হিসাবে অগ্রসর হতে বলেছেন। ধর্মকে কেন্দ্র করে কোনো বিভাজন তিনি কখোনো চাননি । বিভাজন থাকলে স্বাধীনতা বা অধিকার আদায় করা সম্ভব নয়।
কৃষকের চোখে নজরুল বলেছেন,
‘আজ জাগরে কৃষাণ সব ত গেছে, কিসের বা আর ভয়,
এই ক্ষুধার জোরেই করব এবার সুধার জগৎ জয়’ (কৃষাণের গান)।
এমন অভয় বাণী নজরুলের পক্ষেই দেওয়া সম্ভব। হাতুরি ও শাবল শ্রমিকের প্রতীক। এ দুটির মাধ্যমেই রুটি-রুজির ব্যবস্থা হয়। এ দুটি অনুষঙ্গ নিয়েই শোষণের বিরুদ্ধে শ্রমিকদে র রুখে দাঁড়ানোর মন্ত্র দিলেন নজরুল এভাবে,
‘ওরে ধ্বংস পথের যাত্রীদল!/
ধর হাতুরি, তোল কাঁধে শাবল...
মোদের যা ছিল সব দিইছি ফুঁকে,
এইবার শেষ কপাল ঠুকে!
পড়ব রুখে অত্যাচারীর বুকেরে!/
আবার নতুন করে মল্লভূমে
গর্জাবে ভাই দল-মাদল!
ধর হাতুরি, তোল কাঁধে শাবল।’
নজরুলের কবিতায় রয়েছে রুমি হাফেজ সাদির উত্তরাধিকার।তাঁর কবিতায় ফারসি শব্দ ছাড়াও রয়েছে এক সাংস্কৃতিক মিশ্রণ । নজরুল তাঁর সৃষ্টিকর্মে হিন্দু-মুসলিম মিশ্র ঐতিহ্যের পরিচর্যা করেন। কবিতা ও গানে তিনি এ মিশ্র ঐতিহ্যচেতনাবশত প্রচলিত বাংলা ছন্দোরীতি ছাড়াও অনেক সংস্কৃত ও আরবি ছন্দ ব্যবহার করেন। নজরুলের ইতিহাস-চেতনায় ছিল সমকালীন এবং দূর ও নিকট অতীতের ইতিহাস, সমভাবে স্বদেশ ও আন্তর্জাতিক বিশ্ব।তৎকালীন বাংলা আধুনিক কবিতার ধারা’ থেকে তিনি ছিলেন বেমানান । প্রায় সমসাময়িক জীবনানন্দকে আধুনিকতার যে বয়ানে আবিষ্কার করা যায়, নজরুলের কবিতা ঠিক সেইভাবে পড়া যায় না। নজরুলের সাম্যবাদী ও অসাম্প্রদায়িক রূপ: ‘মোরা একই বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মুসলমান’। মানুষ যদি অন্তরাত্মাকে না চেনে, অন্য ধর্মকে সম্মান করতে না শেখে, নিজেকে ‘সর্বশ্রেষ্ঠ’ প্রমাণের জন্য ব্যস্ত থাকে, তাহলে সমাজে ধর্মীয় সহিষ্ণুতা গড়ে উঠবে না। কবি মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই’। নজরুল স্বপ্ন দেখতেন একটি সুন্দর পৃথিবী ,অসাম্প্রদায়িক-সমাজ; শোষণমুক্ত বিশ্বগড়ে তোলার ।
0 Comments