হিমালয়ের পথে চলতে চলতে // পর্ব -৬
দে ব ব্র ত ভ ট্টা চা র্য্য
ভীমবলির ব্রীজ কেদারনাথ ধাম যাত্রার পুরোনো এবং নতুন পথকে জুড়ে দিয়েছে। ভাবতে অবাক লাগে, এই ভীমবলি থেকে কেদারনাথের দূরত্ব আগে ছিলো মাত্র তিন /সাড়ে তিন কিলোমিটার। আর আজ সেটা হয়েছে দশ কিলোমিটার ! মন্দাকিনী তার বাম তীরের পায়ে হাঁটা পথ এবং পার্শ্ববর্তী জনপদকে ধুয়ে নিয়ে গেছে নিজের খেয়ালে। দক্ষিণ তীরে আজকের নতুন রাস্তাটি কেমন, কতটা চলার উপযোগী জানি না, তবে শুনেছি, এবারেই আসল দুর্গমতা শুরু।
কিন্তু বিরিজ তো পেরিয়ে এলাম, কৈ সেই বিরিজবাবুর 'দো ঘোড়ের ' তো পাত্তা নেই। পেছনে তাকালাম, কাউকে দেখলাম না। বন্ধুবর বললেন,
-আমরা আমাদের মত এগিয়ে চলি, ঘোড়া এলো তো ভালোই, তা না হলে এভাবেই চলতে হবে।
ঠিক তখনই পেছন থেকে ডাক শুনলাম -
-মালিক, আইয়ে। ঘোড়ে আ গয়ে ।
দেখলাম, দুটি লালচে রঙের ঘোড়া ঘাড় নিচু করে দাঁড়িয়ে। ঘোড়া দুটোর সাথে দুটো কম বয়সী ছেলে। এরাই এখন আমাদের সঙ্গী হবে
আরে! ওই ছেলেটি কে ? হীরু না? হীরু দামাই!
-তুমি হীরু না?
-ঠিক বলেছেন। আমি ও আপনাদের চিনেছি। সেই গুপ্তকাশী থেকে বাসে ছিলাম আমি।
মনটা আনন্দে ভরে গেল। সত্যিই পৃথিবীটা কত ছোট! হরিদ্বার থেকে সোনপ্রয়াগের পথে গুপ্তকাশীর পর হীরু বাসে আমাদের পাশের সিটে ছিল। ওর কাছেই শুনেছি উখীমঠের মাহাত্ম্য। চৌখাম্বা পর্বতের বিশালতা ওর চোখ দিয়েই অনুভব করেছি। class XII পাশ ছেলেটি বলেছিল, ও এখন পারিবারিক ব্যবসায়ে যুক্ত আছে। আজ জানলাম ওর সে ব্যবসায়টি কি ধরনের।
-হীরু, চলো তা হলে, আমরা বাবাকে প্রণাম করে আসি ।
আমি এগিয়ে গেলাম একটি ঘোড়ার দিকে। জীবনে কখনো ঘোড়ার সওয়ার হইনি।
-আইয়ে, বাঁয়া পায়ের পাদানি পর রাখিয়ে। উসকে বাদ ----
অনেক কসরৎ করার পর একসময় নিজেকে ঘোড়ার পিঠে আবিষ্কার করলাম। এই মরন বাঁচন সংগ্রামে ব্যস্ত থাকায় ভবেশদাকে দেখার কথা মনেই আসেনি। নিজে স্থির হয়ে বসে তাকিয়ে দেখলাম, পাশের ঘোড়ার উপর বসে ভবেশদা মিটিমিটি হাসছেন!
নিজেকে বেশ কোন রাজা -মহারাজা মনে হল। হাতের লাঠি হীরুকে সমর্পণ করলাম। হীরুর ভাই (পরে জেনেছি, ওর নাম জাবরু) নির্দেশ দিল -
-উও লোহে কো হান্ডেল জোরসে পাকড়ে রহিয়ে। কই দিক্কত নেহি হোগা।
এ অভয় বাণী মনে কতটা সাহস জোগালো বলতে পারবো না তবে ঘোড়ার চলার সাথে সাথে ব্যাপারটা অনেক সহজ হয়ে এলো।
পথ প্রকৃত পক্ষে বিপজ্জনক। বড় বড় পাথরগুলো আলগা বসানো হয়েছে। বালি মোরামের বাঁধনে তারা বিদ্রোহ করছে প্রতিনিয়ত। রাস্তার পরিসর ও অত্যন্ত সংকীর্ণ। ওঠা ও নামার যাত্রীদের মাঝে ফাঁক প্রায় থাকেই না। তার ওপর আমরা আছি নদী গর্ভের প্রান্তে। একটু বেসামাল হ'লেই দুশ ফুট গভীর খাদে। পাথরের ঠোক্কর খেতে খেতে মা মন্দাকিনীর কোলে শেষ বিশ্রাম নিতে হবে।
আমার ঘোড়ার লাগাম ধরে চলেছে হীরু। সে কেবল এ পথে আমাদের সঙ্গী নয়, এ যাত্রায় গাইড ও বটে। শিক্ষিত ছেলে। এ অঞ্চলের ভৌগলিক অবস্থান সব ওর নখদর্পণে। এ ছাড়া প্রচুর পৌরাণিক কাহিনী জানে ও। বাংলা ভালো বোঝে এবং বলেও। সে পরিচয় বাসেই পেয়েছিলাম। হীরুকে বললাম -
-হীরু, এবার কি শোনাবে বলো? আগে তো তুঙ্গনাথের পথের বর্ণনা শুনিয়েছ। এবার বাবা কেদারনাথের কাহিনী শুনবো।
হীরু বিনয়ী ছেলে। হাসতে হাসতে বলল,
-আপনারা সবই জানেন। পাঁচ কেদারের কথা জানেন তো?
পঞ্চ কেদারের গল্প আমি বাবার কাছে শুনেছিলাম বহু আগে। কিন্তু স্মৃতিতে তেমন পরিস্কার নেই। তা ছাড়া এ সব কাহিনী কখনও পুরোনো হয় না। এই নৈস্বর্গিক যাত্রা পথে পুণ্য সঞ্চয়ের আকাঙ্ক্ষাও কিছু কম নয়। তাই বললাম,
-হীরু, তুমিই বলো।
ও ওর মত করে গল্প শুনিয়ে গেল। কিছু হিন্দী কিছু বাংলায়। আমি আত্মস্থ করছিলাম মহেশ্বরের পূত কাহিনী।
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে বহু আত্মীয় জ্ঞাতি হত্যার পাপ লেগেছিল পঞ্চ পান্ডবের। শ্রী কৃষ্ণ তাঁদের উপদেশ দেন -
-তোমরা হিমালয়ে যাও। সেখানে দেবাদিদেব মহাদেব ধ্যানে সমাহিত আছেন। তাঁর চরণ বন্দনা করে জেনে নাও তোমাদের পাপস্খলনের উপায়।
পঞ্চপাণ্ডব চললেন হিমালয়ে। বহুদিন অনুসন্ধানের পর তাঁরা মহেশ্বরকে ধ্যানস্থ অবস্থায় দেখতে পান। সেই মুহূর্তে মহাদেবের ও ধ্যান ভঙ্গ হ'ল। তিনি দূর থেকে পঞ্চ পাণ্ডবকে দেখতে পেলেন। মহা পাপীদের মুখ দর্শন করবেন না বলে নিজেকে লুকিয়ে ফেলার জন্য মহিষ রূপ ধারণ করলেন। তবু পাণ্ডবেরা পেছন পেছন আসছেন দেখে মহেশ্বর আরও জোরে চলা শুরু করলেন। কিন্তু দ্বিতীয় পাণ্ডব ভীম অতি দ্রুত ছুটে মহিষের পেছনের পা দুটি চেপে ধরলেন। সঙ্গে সঙ্গে সেই মহিষ রূপ থেকে মহাদেব অন্তর্হিত হলেন আর মহিষ রূপটি প্রস্তরীভূত হ'য়ে পাঁচটি খণ্ডে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লো। তখনও ভীমের হাতে মহিষের পেছনের অংশ অর্থাৎ কুকুদ অংশ ধরা ছিল। সেই প্রস্তরীভূত কুকুদ অংশটিই আজকের কেদারনাথ মহাদেব।
বাকী চারটি অংশের একটি তুঙ্গনাথ। ওখানে মহাদেবের বাহু অংশ পতিত হয়েছে। মুখমণ্ডল রুদ্রনাথে পূজিত হন। মাঝের অংশ মধ্যমহেশ্বর এবং জটা অংশটি প্রস্তর রূপে কল্পেশ্বরে অধিষ্ঠিত।
এদিকে মহাদেব অদৃশ্য হ'লে যুধিষ্ঠির কাঁদতে কাঁদতে বললেন,
-মহেশ্বর, তবে কি আমাদের পাপক্ষয় কোন ভাবেই সম্ভব নয়?
তাঁর আকুল প্রার্থনায় মহাদেবের হৃদয় বিগলিত হ'ল। তিনি অদৃশ্যলোক থেকে বিধান দিলেন,
-তোরা মন্দাকিনীতে অবগাহন কর। তারপর আমার এই কুকুদ অংশকে ভক্তি ভরে পূজা কর। তোদের পাপক্ষয় হবে।
পান্ডবেরা সেই যে পূজা শুরু করলেন, আজও মহেশ্বর একই ভাবে বিশ্ববাসীর হৃদয় পদ্মের অর্ঘ নিয়ে চলেছেন।
সামনে দেখি একটি ছোট্ট জনপদ। চায়ের দোকান, বিস্কুট কেক। কিছু টুকিটাকি নেশার সামগ্রীও আছে দেখলাম। তা নেশাখোর বাবাকে দর্শনে চলেছেন আর একটু আধটু নেশা করবেন না, সে আবার হয় নাকি? এখানে দেখলাম, পাহাড়ের কোল ঘেঁষে বেশ বড় বড় জল ভর্ত্তি চৌবাচ্চা আছে। ঘোড়াদের তৃষ্ণা নিবারণের জন্য এই ব্যবস্থা। এ রকম সারা পথ জুড়ে আরও অনেক স্থানে এমন ব্যবস্থা রাখা আছে। ঘোড়া জল খাবে আর আমরা একটু চা খাবো না? চলো, এই সুযোগে গা হাত পায়ের ব্যাথাও খানিক কমানো যাবে। হীরু বলল,
-ভীমবলি থেকে আমরা সাড়ে চার কিলোমিটার চলে এসেছি। এ জায়গার নাম 'রামওয়াড়া'।
সে আবার কি? রামওয়াড়া তো আগের রাস্তায় ছিল। মন্দাকিনীর বাম তীরে একটি জনবহুল জনপদ। কিন্তু সে সব তো এখন ধুয়ে মুছে ইতিহাসের পাতায় আশ্রয় নিয়েছে। মা মন্দাকিনী তাদের কোথায় নিয়ে গিয়ে ফেলেছে কে জানে।
হীরুর কাছে জানলাম, এ পারের 'রামওয়াড়া' আগের টির দোসর। ঠিক বিপরীত তীরেই সে রামওয়াড়া ছিল। বাবার চরণে পৌঁছোনোর আগে শেষ জনপদ।
তাকিয়ে দেখলাম, কিছু দাঁত উঁচু করা পাথর এবং লাল কাঁকুরে অবশেষ ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ল না ।মন্দাকিনী এখন ঐ পাশের কুল ঘেঁষে ছুটছে। এ প্রান্তে পাথরের খন্ড উঁচু স্তুপ হ'য়ে জমে আছে ইতিহাসের সাক্ষী হ'য়ে। হয়তো পাথরের বুকে কান পাতলে কত হারিয়ে যাওয়া মানুষের কান্না শুনতে পাব। একটা গোটা বসতি এক লহমায় অদৃশ্য হয়ে গেছে। সারাদিনের পরিশ্রমের পর শান্তির বিশ্রাম আর প্রভাত হয় নি।
রামওয়াড়া থেকে কেদারনাথ যাত্রার সামনের পাঁচ কিলোমিটার ঘোড়ায় যাবো। পরের দেড় কিলোমিটার হাঁটা পথ। সুতরাং আর দেরী নয়। হীরু, জাবরু ও ঘোড়া নিয়ে তৈরী। কেবল "জয় বাবা কেদারনাথ "বলে এগিয়ে গেলেই হ'ল। বেশ লড়াই করে উঠে পড়লাম ঘোড়ার পিঠে। হীরুর কাছে পরে জেনেছি, আমাদের বাহন দুটি ঘোড়া ছিল না। ওরা সংকর জীব 'খচ্চর '।নড়বড়ে পাথরের ওপর শক্তপোক্ত পা ফেলে এগিয়ে চলল আমাদের পরিত্রাতা চতুষ্পদ বন্ধু।
-জয় বাবা কেদারনাথ ----।(চলবে)
-------
1 Comments
সুন্দর বর্ণনা।
ReplyDelete