জ্বলদর্চি

সিন্ধু দিল হিন্দু, ইংরেজ দিল গীতা / অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায়

মেসোপোটেমিয়া শিল্পকলা, ইশতার গেট, ব্যাবিলন, ইরাক

সিন্ধু দিল হিন্দু, ইংরেজ দিল গীতা

অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায়


ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি ভারতে এসে ব্যবসায় কিছুটা থিতু হলে নানা বিষয়ে কিছু অভিজ্ঞ ব্যক্তিকে, এবং কিছু শিক্ষিত ব্যক্তিকে একাধিক বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে সেনা কিংবা অন্য বিভাগে চাকরি দিয়ে পাঠাত ভারতীয় সম্পদ, সংস্কৃতি, যাপন ইত্যাদি বিভিন্ন তথ্য অনুসন্ধান ও তার বিস্তারিত বিবরণ পাঠানোর জন্যে। চার্লস ম্যাসন কোম্পানির-সেনা বিভাগের চাকরি ছেড়ে আলেক্সান্ডারের ভারত অভিযানের পথে পাঞ্জাব প্রদেশের কিছু ঐতিহাসিক স্থানে তথ্য সংগ্রহ করে বেড়াচ্ছিলেন। রাভি নদীর কাছে হরপ্পা এলাকায় তিনি পোড়া মাটির ইটের তৈরি পুরনো স্থাপত্যের সন্ধান পান। সেটা ১৮২৯ সাল। এরপর তিনি এ নিয়ে আরও তথ্য সংগ্রহ করে হাতে আঁকা ছবি সহ বই প্রকাশ করেন। পরবর্তীকালে সেই ইট চুরি এবং ইট দিয়ে রেলপথ তৈরির ইতিহাস আছে। ভারতের শাসনভার ব্রিটিশের হাতে আসার তিন বছর পর প্রতিষ্ঠিত আর্কিয়োলজিকাল সার্ভে অব ইণ্ডিয়ার তত্ত্বাবধানে হরপ্পায় নিয়মানুগ প্রত্নতাত্ত্বিক খনন ও অনুসন্ধান চলতে থাকে। প্রথমে বৌদ্ধস্তুপ ভাবা হলেও পরে মুদ্রা-সীল আবিষ্কারের পর বিংশ শতাব্দীর শুরুতে জন মার্শালের নেতৃত্বে প্রাক্‌-বুদ্ধযুগেরও এই জায়গায় কয়েকজন প্রত্নবিদ অনুসন্ধান চালান। ইতিমধ্যে সিন্ধু নদের দক্ষিণে সিন্ধুপ্রদেশে মহেঞ্জোদরো এলাকায় উঁচু ঢিবি পরীক্ষা করে একই ধরনের স্থাপত্য ও মুদ্রা-সীলের সন্ধান মেলে। ১৯২৩ সালে রাখালদাস ব্যানার্জী, বৎস ও ভান্ডারকারের গবেষণায় ভারতে এক প্রাচীন সভ্যতার দলিল উন্মোচন হয় এবং পরের বছর মার্শাল সেই তথ্য লিখিতভাবে জনসমক্ষে আনেন।
🍂
ad

মেসোপটেমিয়া এবং ইরানে প্রাপ্ত মুদ্রা-সীল ইত্যাদির সাথে হরপ্পা-মহেঞ্জোদরোর মুদ্রা-সীল মিল থাকায় ব্রোঞ্জযুগের সমকালীন এক প্রাচীন সভ্যতার ইতিহাস জানা যায়। পরবর্তী গবেষণা জানায় এই সভ্যতা সিন্ধু নদের দুপাশে আফগানিস্তান থেকে ভারতের উত্তর-পশ্চিম হয়ে উত্তরে গাঙ্গেয় উপত্যকা অবধি বিস্তৃত ছিল। দেশভাগের পর এই অনুসন্ধানের অনেকাংশ বর্তমান পাকিস্তান-বালোচিস্তানের অন্তর্গত। সিন্ধু-ঘাগর-হাকরা নদীর উপত্যকা ধরে পাঁচটা বড় শহরের ইঙ্গিত পাওয়া গেছে, হরপ্পা, মহেঞ্জোদরো, ধোলাভিরা, গানেরিওয়ালা ও রাখিগড়ি। ভারতে ঘাগর-হাকরা নদী-শাখানদী অঞ্চলে কাজ চলছে। সিন্ধু সভ্যতার উন্নয়ন তিন ধাপে হয়েছে তার মধ্যে মধ্যধাপে শিখরে পৌঁছয়। প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার বছর আগে শুরু হয়ে পূর্ণতা প্রাপ্ত হয় খ্রিস্টপূর্ব ছাব্বিশ শতকে। দীর্ঘ সাত শতাব্দী এই উচ্চতা ধরে রাখার পর ভাঙন শুরু হয়। বালোচিস্তানের মেহরগড় কচ্ছ সমতল এবং ভারতের ফতেহবাদে ভিরানা অঞ্চলে ন হাজার বছরের পুরনো প্রাক-সিন্ধু সভ্যতার নিদর্শন মাটির বাড়ি, শস্যখামার, চাষাবাদ-খেত পাওয়া গেছে; অনুমান এরই উন্নত সংস্কৃতি হরপ্পা-মহেঞ্জোদরোতে। সিন্ধু-সংস্কৃতিতে ব্যাপক নিপুণ নগর পরিকল্পনা এবং স্থাপত্যের চমৎকার নিদর্শন দেখা যায় যা সমকালীন মেসোপটেমিয়া-ইরানের থেকে উৎকর্ষের গুণে উন্নত। ছোট-বড় বসতবাড়ি, প্রাচীরঘেরা অট্টালিকা, বিশালকায় সংগ্রহশালা ও বিপণিঘর, ভাঁড়ারঘর, কার্যালয় ছাড়াও ইটের রাস্তা, ঢাকা দেওয়া নর্দমা, কুয়ো, ভূগর্ভস্থ জল বন্টন, স্বাস্থ্যসচেতন স্নানাগার ইত্যাদি প্রধান আকর্ষিত ব্যবস্থা। পয়ঃপ্রণালী এতই উন্নত যে আধুনিক অনেক শহরে দেখা যায়না। ইট ছাড়াও সুরকি ও জ্যামিতিক-আকারে পাথর কেটে ব্যবহার করা হত। কৃষি ও বাণিজ্য মূল অর্থনৈতিক ভিত্তি, বাণিজ্য চলত পশ্চিমের সভ্য দেশগুলোর সাথে। মিশর, ইরানের সাথে এখানেও সিন্ধুযুগের মুদ্রা সীল ও কিছু মাটিরপাত্রে ছবির মত স্ক্রিপ্ট পাওয়া গেছে যা খুব কমই পাঠ করা সম্ভব হয়েছে। হরপ্পা ও মহেঞ্জোদরো এবং অন্যান্য জায়গার জমির চরিত্র ছিল আলাদা অথচ কৃষি ও নগরোন্নয়নের মাত্রা প্রায় সমান প্রমাণ করে তাদের উন্নত যাপন। তামা, ব্রোঞ্জ, টিন, সীসা ধাতুর উন্নত ব্যবহারের প্রমাণ আছে। ওজোন ও অন্য মাপঝোকের নিখুঁত ব্যবহার আয়ত্তে ছিল, দাঁড়িপাল্লার ব্যবহার এবং ৫ঃ২ঃ১ অনুপাতে ওজোন করা হত। বিভিন্ন আকার ও আকৃতির মাটির পাত্র, শস্যভাণ্ডার ইত্যাদি পাওয়া গেছে। এছাড়াও শাসক-স্থানীয় মানুষের মূর্তি, নৃত্যরতা নারী, ষাঁড় ও অন্যান্য মানব ও পশুর মূর্তি ও পাথরের গায়ে আঁকা ছবি উপলব্ধ হয়েছে। স্থাপত্য, শিল্প, গণনায় এত উন্নত একটা সভ্যতা অথচ জানা যায় না তাদের মুখের ভাষা, লেখার ভাষা। এখানেই পৃথিবীর অন্য প্রাচীন সভ্যতার সাথে তফাৎ, তাদের অনেক ঐতিহাসিক তথ্য লিপিবদ্ধ।
সিন্ধুসভ্যতার নগর, মহেঞ্জোদারো

আনুমানিক ১৭৫০ খ্রিস্টপূর্বে সিন্ধুসভ্যতা শেষ হয়। সভ্যতার শেষের দিকে ক্রমশ প্রাচীরের উচ্চতা বাড়তে থাকে, বাড়ি আরও উঁচু হয়, নালা চওড়া। ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ, জলোচ্ছ্বাস, প্লাবন সম্ভবত কারণ যা নিয়ন্ত্রণ হয়েছিল জলবায়ু পরিবর্তন, বৃষ্টির চরিত্র পরিবর্তনের মত প্রাকৃতিক কারণে। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দের মাঝামাঝি মধ্য এশিয়া থেকে শ্বেতাঙ্গ এক শ্রেণির পশুপালক যাযাবরের আগমণ সিন্ধুসভ্যতা সমাপ্তির শেষ পেরেক পুঁতে দেয়। যুদ্ধে নির্বিচার হত্যা, নগর ভেঙ্গেচুরে আগুন জ্বালিয়ে ধ্বংস ইত্যাদির প্রমাণ নথিবদ্ধ আছে। বলা হয় তারাই সভ্যতার সব নিদর্শন নষ্ট করে। এই স্থাপত্যবিজ্ঞান তাদের জানা ছিল না, জানা ছিল না উন্নত নগরসভ্যতা। পরে সিন্ধুর লোকেদের সাহায্য নিয়েই তারা নগরসভ্যতা গড়ে তোলে।

প্রাক্‌-সিন্ধুসভ্যতা ধ্বংসের ইতিহাস আমরা জানিনা। সম্ভবত সেটাও প্রাকৃতিক, কারণ ৮০০০ বছর আগে পৃথিবী অত্যন্ত গরম হয়ে যাবার ভূতাত্ত্বিক প্রমাণ আছে। সম্ভবত সেইসময় কচ্ছের মত এলাকায় প্রচণ্ড তাপ ও বর্ষার চরিত্র বদল হয়ে যাওয়ায় মেহরগড়, ফতেহবাদ এলাকার চাষআবাদ বন্ধ করে তারা জায়গা বদলেছিল। নগর-সভ্যতার প্রাথমিক জ্ঞান চারিত হয়েছিল পরবর্তী প্রজন্মে যারা আরও উন্নত সিন্ধুসভ্যতার প্রতিষ্ঠাতা। আবার চার হাজার বছর আগেও বর্ষার চরিত্র বদল, সমুদ্র জলস্তরের উত্থান, হিমালয়ে হিমবাহ গলনের ফলে হিমবাহ-উৎস নদীগুলোয় জলোচ্ছ্বাস সিন্ধুসভ্যতা এলাকার মানুষদের বিপাকে ফেলে। জলনিষ্কাশনের আরও উন্নত ব্যবস্থা, চওড়া নর্দমা, প্রাচীরের উচ্চতা বৃদ্ধি, বাড়ি ও শস্যভাণ্ডার উঁচুতে স্থাপন ইত্যাদি পরিবর্তিত স্থাপত্য তারই ইঙ্গিত দেয়।

শ্বেতাঙ্গরা নিজেদের আর্য বলে আর বাকি সব অনার্য। যুদ্ধবাজ আর্যেরা অনার্যদের যুদ্ধে পরাস্ত করে বশ্যতা স্বীকার করিয়ে তাদের দিয়ে নিজেদের কাজ করাতো। এই শিক্ষিত আর্যদের ভাষা ছিল ‘সংস্কৃত’। তাহলে অনার্য কারা, তাদের ভাষাই বা কি ছিল? সাম্প্রতিক গবেষণায় ইঙ্গিত পাওয়া যায় অনার্যদের ভাষা ছিল দ্রাবিড় এবং এদের প্রোটো-দ্রাবিড় বলা হচ্ছে। এই প্রাচীন দ্রাবিড় ভাষার নিজেদের গণ্ডির বাইরে প্রচার ছিল না বলেই তার স্ক্রিপ্ট উদ্ধার করা অসম্ভব হয়ে গিয়েছে। ভাষাবিদদের মতে আজকের দ্রাবিড় ভাষা আর্যদের সংস্কৃতের সাথে মিলেমিশে তার প্রাচীনত্বের মর্যাদা হারিয়েছে। আফগানিস্তান থেকে ভারতবর্ষ অবধি এদের বসবাস ছিল। নগরসভ্যতা ও কৃষিতে উৎপাদিত শস্য নিয়ে শান্তিতে দিনযাপন করত। প্রাকৃতিক দুর্যোগে যথাসম্ভব নিজেদের রক্ষা করার শিক্ষা ছিল। গবেষকদের অনুমান এদের ভাষা আর্যরা নষ্ট করে দিয়েছে। হোমরের মহাকাব্যদ্বয়ের মতোই ভারতের দুটো মহাকাব্যে ও পুরাণে সেই ইতিহাসের কিছু কাব্যিক উল্লেখ আছে। আর্য ও অনার্যের নামান্তরে অসুরদের মধ্যে যুদ্ধের বর্ণনা তার অন্যতম। আর্যদের আক্রমণে ভারতের গোঁড়া প্রাচীন জনজাতি ভারতের দাক্ষিণাত্যে আশ্রয় নেয় এবং কিছু নানা প্রদেশে জঙ্গলে লুকিয়ে পড়ে।

স্থাপত্যবিদ্যা অধিগত থাকলেও সিন্ধুসভ্যতার অধিবাসীদের মধ্যে আলঙ্কারিক নিদর্শনের পরিচয় কমই পাওয়া যায় যেমন পাওয়া যায়না তাদের উন্নত আধ্যাত্মিক চিন্তার পরিচয়। গোষ্ঠীপতিরাই অসীম ক্ষমতার অধিকারী মনে করেই তাদের মূর্তি তৈরি হয়েছে। ঈশ্বর এবং ধর্মীয় বিশ্বাস বোধের কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না তাদের মধ্যে। পাওয়া যায় নি দেবতার গৃহ বা উপাসনাস্থল। ফলে কোনো আকৃতি বা মূর্তি দেখে আপন মনের মাধুরী ছড়ায় বেশিরভাগ গবেষক। তবে প্রকৃতির বিভিন্ন রূপকে ভয়ে বা ভক্তিতে তারা মানতো। গাছ, বিভিন্ন পশুর ছবি, শিকারের ছবি পাথরের গায়ে দেখা যায়। আফ্রিকার মাসাই জনজাতির মধ্যেও ঈশ্বরে বিশ্বাসের চেয়ে সর্বজ্ঞ এনকাইয়ের ওপরই ভরসা রাখত। এনকাই  মানবাকৃতি নয়। প্রকৃতিই একমাত্র আরাধ্য। সেইরকম কিছুটা ইঙ্গিত পাওয়া যায় প্রোটো-দ্রাবিড় অনার্যদের ক্ষেত্রেও। জনজাতিদের মধ্যে আজও প্রাচীন গোষ্ঠীপতি ‘অসুর’দের পুজোর চল আছে।

অনুশিলীত ধর্ম ও সংস্কার অনার্যদের মধ্যে ছিল না, আর্যদের প্রভাবেই তা ভারতে চারিত। বৈদিক যুগে প্রচলিত হিন্দু ধর্মই সনাতন ধর্ম যা সময়সীমিত। তা বলে কি সিন্ধু যুগে ধর্ম ছিল না? অবশ্যই ছিল, তা হোল চিরন্তন ধর্ম যা প্রকৃতি ধরে রাখে। প্রায় তিন হাজার বছরের বৈদিক সংস্কৃতির সনাতন ধর্মের চাপে হারিয়ে গেছে ভারতের প্রাচীন চিরন্তন ধর্ম যার অস্তিত্ব মাত্র কয়েক দশক আগে জানতে পারা যায়। হিন্দু ধর্ম প্রচারকেরা সনাতন ধর্মের কথাই বলেন। রাজনীতিতেও সনাতন ধর্মের কথা শোনা যায়। সিন্ধুসভ্যতা আবিষ্কারের শতবর্ষের সামনে দাঁড়িয়ে দেখি বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্রের বাইরে সাহিত্যে তার উপস্থিতি অপ্রতুল। সে কি অনার্য বা অসুরের সমগোত্রীয় বলে ‘অ-ধার্মিক’ ব্রাত্য নাকি গ্রহণযোগ্যতার সীমাবদ্ধতা?

গ্রিক কবি হোমারের দুই মহাকাব্য ইলিয়াড আর ওডিসি প্রাচীন পৌরাণিক কাহিনীর উপর নির্ভর করে রচিত। ভারতের রামায়ণ ও মহাভারত মহাকাব্য দুটির পেছনেও প্রাচীন লোক আখ্যান থাকার সম্ভাবনা। পৃথিবীতে সিন্ধু নদের উপত্যকা এবং মেসোপটেমিয়ার টাইগ্রিস ও ইয়ুফ্রেটস অববাহিকায় যে দুটো সভ্যতা গড়ে উঠেছিল বলে আমরা জেনেছি তারও আগে সভ্যতার বীজ বোনা শুরু হয়েছিল এগারো হাজার বছর আগে থেকে যার নিদর্শন ইরান ও ইরাকে পাওয়া গেছে। ভয়ঙ্কর শৈত্য প্রবাহ শেষে পৃথিবী গরম হতে শুরু করলে এই সভ্যতার শুরু যা টেনে নিয়ে চলেছে আজকের মানুষ।

সাড়ে তিন হাজার বছর আগে ইন্দো-ইরান সংস্কৃতি যে সমাজ ধারন করত তার থেকে গড়ে উঠেছিল এক ঈশ্বরবাদী জরথ্রুষ্ট ধর্ম যাদের অগ্নিই হচ্ছে মুখ্য উপাস্য। এই ধর্মই ইন্দো-ইরানীয় মানুষদের পরবর্তী ধর্মগুলোর উৎস বলে মনে করা হয়। হিন্দু ধর্মেরও মুখ্য উপাস্য অগ্নি। এই দুই ধর্মের ব্যবহারিক সংস্কৃতির মধ্যে অনেক মিল দেখা যায় যদিও পরবর্তিকালে ভিন্ন ভৌগোলিক পরিবেশে হিন্দু ধর্মের আচারে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। প্রাচীন ধর্মগুলোর একটা করে ধর্মগ্রন্থ আছে যেমন জরথ্রুষ্টদের অবেস্তা, হিব্রুদের তানাখ বাইবেল, খ্রিস্টানদের সংরক্ষণপন্থী ও প্রতিবাদীপন্থীদের বাইবেল দুটো- ওল্ড টেস্টামেন্ট আর নিউ টেস্টামেন্ট। পরে ইসলামিক ধর্মে কুরান। হিন্দু ধর্ম প্রাচীন হলেও নির্দিষ্ট কোনো ধর্মগ্রন্থ ছিল না। ছিল একাধিক শাস্ত্র। মহাভারতের যুদ্ধে ভীষ্মপর্বের অংশ হিসাবে ‘কৃষ্ণ ও অর্জুনের কথোপকথন’ অস্তিত্ব ছিল কিন্তু ধর্মগ্রন্থ বলে গুরুত্ব ছিল না। 

‘শ্রীমদ্ভগবদগীতা’র জন্মদাতা ব্রিটিশ ইংরেজ চার্লস উইলকিন্স ১৭৮৫ সালে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে চাকরি নিয়ে ভারতে এসে সংস্কৃত শেখেন। গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসের অনুরোধে মহাভারতের অনুবাদ শুরু করেন ইংরেজিতে কিন্তু শেষ করতে পারেন নি। ১৭৮৪ সালে তিনি হেস্টিংসকে আংশিক অনুবাদের খসড়া পাণ্ডুলিপির অনুলিপি দেখান। সেসময় আইন-আদালতে মুসলমানদের কুরান আর হিন্দুদের শাস্ত্র মানা হত। কিন্তু ১৭৮১ সালে সেটলমেন্ট অ্যাক্ট চালু হলে জমি ও সম্পত্তির উত্তরাধিকার ইত্যাদি আইনি মামলায় খ্রিস্টানদের যেমন বাইবেল শপথ করে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে কথা বলতে হয়, মুসলমানদের কুরান থাকলেও হিন্দুদের কোনো ধর্মগ্রন্থ না থাকায় তার অভাব বোধ হতে লাগল। শাস্ত্রগ্রন্থের প্রামাণ্য সাইজ আদালতে সহজ বহনযোগ্য ছিলনা। তখন উইলকিন্সের ওই আংশিক অনুবাদের কৃষ্ণার্জুনের কথোপকথনটুকু আলাদা করে বাছাই করার পরে একটা বই তৈরির পরিকল্পনা করা হয়। ১৭৮৪ সালে হেস্টিংস অনুবাদের ওই অংশটুকু কোম্পানির লন্ডনের প্রধান ন্যাথানিয়েল স্মিথকে পাঠান এবং কোম্পানির খরচে সেই অনুবাদটি প্রকাশ করার অনুরোধ জানান।

১৭৮৫র মে মাসে লন্ডনের থেকে ছাপা হয়ে বের হয় The Bhagvad-Geeta, or Dialogues of Kreeshna and Arjoon। বিশ্বের নানা ভাষায় প্রকাশ হল এই বই। ইংরেজের তথা খ্রিস্টানদের সৃষ্টি এই গীতাই আজ হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থ। বাংলায় শ্রীমদ্ভাগবদগীতার অনুবাদ করেছেন মালাধর বাসু ১৮৮৭ সালে। পরে বিবেকানন্দের উৎসাহে হরমোহন মিত্রের দ্বারা কালীপ্রসন্ন সিংহের মহাভারত থেকে গীতার অংশটা আলাদা করে নিয়ে মূল ও বাংলায় অনুবাদ সমেত ছাপা হয়। শুধুই কি আইনের প্রয়োজনে সামাজিক বৈষম্য সৃষ্টিকারী ইংরেজ হিন্দু ধর্মগ্রন্থ গীতার প্রয়োজন অনুভব করে নাকি এভাবেই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সংঘর্ষের বীজ বপন শুরু করে।

Post a Comment

0 Comments