(একটি খুনের রহস্যগল্প)
সল্টলেকের ৮তলার ওই ফ্ল্যাটে রাত তখন প্রায় একটা। বাইরে টিপটিপ বৃষ্টি, গাছে হালকা বাতাসে কাঁপছে পাতাগুলো, আর ভিতরে নিঃশব্দ এক মৃত্যুর গল্প লিখে ফেলে এক অদৃশ্য খুনি।
সুদেষ্ণা সেন, অবসরপ্রাপ্ত ইংরেজির অধ্যাপিকা, মৃত অবস্থায় পাওয়া গেলেন ডাইনিং টেবিলের পাশে। গলায় সিল্কের স্কার্ফ পেঁচানো, চোখ খোলা, মুখে অদ্ভুত এক বিস্ময়ের ছায়া। ঘরের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ, জানালাগুলোও বন্ধ—সব মিলিয়ে যেন এক ক্লাসিক "লকড রুম" কেস।
পুলিশ প্রথমেই ঘটনাটিকে আত্মহত্যা বলে ধরে নেয়। আত্মীয়স্বজনও খুব বেশি বাধা দেয় না, কারণ সুদেষ্ণার বয়স হয়েছিল এবং গত কয়েক মাসে তিনি কিছুটা অস্থির আর ভীত ছিলেন। কিন্তু গোটা কাহিনিতে কিছু একটা অদ্ভুত খটকা লেগে ছিল। যেমন—ঘরের মাঝখানে রাখা টেবিলে আধখাওয়া আপেল, পাশে খোলা বই—Agatha Christie's Curtain।
গল্পের কেন্দ্রে আসে নির্ঝরা মিত্র। বাইরের পরিচয়ে সে একজন কলেজের ইংরেজির শিক্ষিকা। শান্ত, সজ্জন, নরম স্বভাবের। কিন্তু এর বাইরেও তার আরেকটি পরিচয় আছে—সে সেন্ট্রাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্টের গোপন ইউনিট 'চতুরী'-র সদস্য। অদৃশ্য ছায়ার মতো কাজ করাই যার অভ্যাস।
নির্ঝরা আসে পরিচিতির অজুহাতে, বই সংগ্রহের ছুতোয়। পুলিশ সন্দেহ করে না। সে ঘরে ঢুকে পড়ে। প্রথমেই তার নজরে পড়ে আপেলটি। কোনো সাধারণ মানুষ আত্মহত্যার ঠিক আগে আপেল খায় না। আর যদি হত্যা হয়—তাহলে কি বিষ মেশানো ছিল আপেলে? অথবা অন্য কিছু?
তবে সবচেয়ে কৌতূহলোদ্দীপক ছিল ফুলদানিতে রাখা একটি শুকিয়ে যাওয়া লাল গোলাপ। নির্ঝরা সেটিকে তুলে নিয়ে গন্ধ নেয়, পাপড়িতে অদ্ভুত সাদা গুঁড়োর মতো কিছু। তার সন্দেহ, এটা পটাশিয়াম সায়ানাইড, যা গন্ধে টের পাওয়া কঠিন, কিন্তু মারাত্মক বিষ।
পরবর্তী কয়েক দিনে সে আবিষ্কার করে, সুদেষ্ণার ভাগনে সৌরভ কিছুদিন ধরে এই ফ্ল্যাটেই থাকছিল। পুলিশের কাছে সে জানিয়েছে, ঘটনার রাতে সে বন্ধুর বাড়ি ছিল, যেটা তার বন্ধুরাও কিছুটা দ্বিধাভরে সমর্থন করেছে। সৌরভ একজন স্ক্রিপ্টরাইটার—সিনেমার চিত্রনাট্য লেখে, কিন্তু কাজ চলছে না বলে প্রায়ই আর্থিক সংকটে থাকে।
নির্ঝরা আরও খোঁজখবর নিতে শুরু করে। পাড়ার কিছু মানুষ জানিয়েছে, শেষ কয়েক মাসে সুদেষ্ণা সেন বেশ ভীত ছিলেন। বারবার বলতেন, "কেউ আমাকে অনুসরণ করছে।" অনেকে এটাকে বয়সজনিত মানসিক ভয় বলে উড়িয়ে দেয়। কিন্তু নির্ঝরা জানে, বহু সত্য এভাবেই হারিয়ে যায়—অবিশ্বাসের পর্দায়।
ঘটনার রাতে বিল্ডিংয়ের লিফটের সিসিটিভি ফুটেজও কিছু অস্বাভাবিকতা দেখায়। ১২:৪৫ মিনিটে লিফট ৮তলায় উঠে যায়, কিন্তু কেউ নামেনি। ১:১০-এ আবার লিফট নিচে নামে। অথচ ফ্ল্যাটের দরজা ছিল ভিতর থেকে বন্ধ!
এখানে একটা প্রযুক্তিগত মোড় নেয় তদন্ত। নির্ঝরা ফ্ল্যাটের স্মার্ট লক পরীক্ষা করে জানতে পারে, লকটি বাইরের একটি অ্যাপ দিয়ে খোলা বা বন্ধ করা সম্ভব। অথচ সুদেষ্ণা সেন কোনো স্মার্টফোন ব্যবহার করতেন না। কে নিয়ন্ত্রণ করছিল লক?
নির্ঝরা এবার ছদ্মবেশে সৌরভকে অনুসরণ করে। দেখে, সে এক মোবাইল অ্যাপ ডেভেলপারের সঙ্গে দেখা করছে। তাদের কথাবার্তা রেকর্ড করে সে প্রমাণ পায়, সৌরভ-ই অ্যাপ বানিয়ে লক নিয়ন্ত্রণ করত। খুনের রাতে সে বাইরে থাকলেও, ফ্ল্যাটে গিয়ে সুদেষ্ণাকে খুন করে ফিরে গিয়েছিল। অ্যাপ দিয়েই দরজা বাইরে থেকে লক করে দেয়, যেন আত্মহত্যা বলে মনে হয়।
কিন্তু সবচেয়ে চতুর যে ব্যাপারটা, সেটা ছিল খুনের মাধ্যম। স্কার্ফ দিয়ে শ্বাসরোধ করে খুন করা হয়, কিন্তু বিষ মিশিয়ে রাখে গোলাপে—যাতে সন্দেহ অন্যদিকে ঘুরে যায়। সৌরভ জানত, আত্মহত্যার মতো দেখাতে হলে চেহারায় ভয় নয়, বরং শান্তি রাখতে হবে।
তবে সে ভুল করেছিল—নির্ঝরার মতো কারও উপস্থিতির কথা কল্পনাও করেনি।
নির্ঝরা শেষে একটি মানসিক ফাঁদ পাতল। একদিন সৌরভকে জানিয়ে দিল, CID-এর হাতে সুদেষ্ণার লেখা একটি ডায়েরি এসেছে, যেখানে তার নাম লেখা আছে। সেই রাতেই সৌরভ আবার ঘরে ফিরে যায়, ডায়েরির খোঁজে। আর সেই সময়েই তাকে হাতেনাতে ধরে ফেলল পুলিশ।
পরে জেরায় সব স্বীকার করে সে। সুদেষ্ণার নামে থাকা জমি ও পুরনো বিমার টাকা পেতে সে খুন করেছিল। তার সিনেমার স্বপ্ন ছিল, সেই টাকা দিয়েই নিজের ছবি বানানোর কথা ভাবছিল।
গল্প শেষ হয় নির্ঝরার কলেজে ফিরে আসা দিয়ে। ক্লাসে সে নিজের মতো করে আবার ইংরেজি সাহিত্য শেখায় ছাত্রদের। কেউ জানে না, তাদের নরম স্বভাবের ম্যাডামই একজন পর্দার আড়ালের গোয়েন্দা।
তবে ব্ল্যাকবোর্ডে আজ একটা নতুন লাইন লেখা হলো:
"The dead don’t speak, but they always leave a sign."
নির্ঝরা হালকা হেসে কালো মার্কারটা বন্ধ করে রেখে দেয়।
।।শেষ।।
🍂
0 Comments