হিমালয়ের পথে চলতে চলতে || পর্ব - ৫
দে ব ব্র ত ভ ট্টা চা র্য্য
কেদারনাথ তীর্থ পরিক্রমন হ'ল উত্তরাখণ্ডের চার ধাম যাত্রার সব চেয়ে দুর্গম পর্ব। গৌরীকুণ্ড থেকে কেদারনাথের বর্তমান দূরত্ব একুশ কিলোমিটার। ২০১৩ এর আগে এ দূরত্ব ছিল চোদ্দো কিলোমিটার। পথও আগে অনেক সুগম ছিল। এখন তো শেষের দশ কিলোমিটার মন্দাকিনীর বিপরীত তীর ধরে নতুন তৈরী পথে যাত্রা। এ পথ এখনও নির্মাণ পর্বের মধ্য দিয়ে চলছে।
আমরা দুজনে ধীর গতিতে হাঁটছি। বেশ বুঝতে পারছি পা আবার ধরে আসছে। মন যেন বলছে,
-অনেকটা পথ হাঁটা হয়ে গেছে। এবার একটু বিশ্রাম নেওয়া যেতে পারে। আসলে সত্যিই পা দুটো আর চলছিল না, ঠিক তখনই দেখলাম, রাস্তার পাশে একটা ছোট মন্দির। সিঁদুরে ঢাকা এক প্রস্তর মূর্তি। পাশে আবার চা এর দোকান। সুতরাং দেবুস্যারকে আর পায় কে! চা হ'ল কারণ আর মন্দির হ'ল কার্য। একটু প্রণাম করে নিই আগে। এগিয়ে গেলাম।
ইনি হ'লেন চীরবাসা ভৈরব দেব। কেদারনাথ শিব ক্ষেত্রের রক্ষক। এনাকে প্রণাম করে অনুমতি না নিলে কেদারনাথ দেব দর্শণের পুণ্য লাভ সম্ভব নয়। মন্দিরের পাশে পানীয় জলের ব্যবস্থা আছে। মহিলা ও পুরুষের পৃথক টয়লেট আছে। সোজা কথায় সভ্য সমাজের ছোঁয়া দেবভূমির অন্দরে প্রবেশ করেছে।
চা দোকানে জানলাম, আমরা তিন কিলোমিটারের কাছাকাছি পথ হেঁটে এসেছি। মাত্র তিন কিলোমিটার! আমি তো ভেবেছিলাম পাঁচ -ছ' কিলোমিটার হেঁটে ফেলেছি। মনটা বড় দমে গেল। সামনে আরও আঠারো কিলোমিটার পথ! কি আর করা যাবে! এখন তো চা এর তৃষ্ণা মেটাই। বিশ্রাম তো উপরি পাওনা।
আবার নতুন উদ্যমে হাঁটা শুরু। প্রথমটা বেশ গতিশীল। বৃষ্টিও নেই। রাস্তা ও দেখছি অনেকটা মসৃণ। আমাদের সাথে মন্দাকিনীও একই রূপ চঞ্চলা। গভীর খাদের মধ্যে তার তোলপাড় করা গতি ওপর থেকেও বেশ অনুভব করা যায়। বাম দিকে পাহাড়ের খাঁজে সরে গিয়ে মাঝে মাঝেই ঘোড়া, ডুলিওয়ালাদের পথ করে দিতে হচ্ছে। তবে থেমে যাইনি আমরা। লাঠির ঠকঠক আওয়াজ তুলে এগোচ্ছি। মাঝে মাঝে আসছে 'রেন সেল্টার '। সবুজ রঙের সেড দেওয়া লোহার বেঞ্চ পাতা পথের পাশে। লাঠিটা রেখে বসে পড়ার জন্য মনটা ভীষণ টানছিল। আমি যদিও বসে পড়ার ইচ্ছে করি, ভবেশদার কড়া নির্দেশ, -
-না! এখন একদম বসা নয়। আর একটু এগিয়ে পরের রেন সেল্টারে বসবো আমরা।
অগত্যা! কদম কদম এগিয়ে চলো। ডান দিকে মন্দাকিনীর প্রান্ত বরাবর লোহার রেলিং দেওয়া। খুঁটিগুলোতে জাতীয় পতাকার রঙ লাগানো। মনটা জাতীয়তা বোধে একটু রঙিন হয়ে উঠলো। মোড় ফিরতেই দেখলাম একটা ছোট কুঠুরি। এক পাল্লার দরজা। ওপরে লেখা -'দাওয়াখানা '। সরকারী ব্যবস্থায় তীর্থযাত্রীদের সেবা শুশ্রূষার জন্য রাখা। কিন্তু দাওয়াখানা আজ বন্ধ। তার চাতালে এখন যাত্রীগনের বিশ্রাম পর্ব। আমারও মনটা বড় টানছিল।
আবার টিপটিপ বৃষ্টি পড়া শুরু হ'ল। আমরা হাঁটছি, বৃষ্টিও বাড়ছে। রেন কোটের বোতামগুলো আটকে নিলাম মাথার টুপিটা টেনে দিলাম। অসংখ্য যাত্রী এক দুই করে আমাদের পেরিয়ে যাচ্ছে। আমরা বেশ বুঝতে পারছি, এবার একটু থামা দরকার। মনে হচ্ছে, ভবেশদাকে থামতে বলি। কিন্তু বড় লজ্জা করছে! আসার সময় বৌদি আমার ওপর দায়িত্ব দিয়েছিলেন, ভবেশদাকে দেখাশুনো করার। এখন আমাকেই দেখেকে! পাহাড়ের খাঁজে দাঁড়িয়ে পড়লাম। দেখে ভবেশদা পিছিয়ে এলেন -
-কি দেবুদা! খুব কষ্ট হচ্ছে? পরের রেন সেল্টারে দাঁড়াবো ভেবেছিলাম।
কষ্ট তো ওনারও হচ্ছে। কিন্তু অসম্ভব প্রাণশক্তিতে সব কষ্টকে উনি জয় করে চলেছেন। আসলে আমার সে মনের জোরই নেই!
এক পথযাত্রীকে প্রশ্ন করে জানা গেলো, আর এক কিলোমিটার দূরেই 'জঙ্গল চটী', একটি রেন সেল্টার। মনে জোর পেলাম, আর তো মাত্র এক কিলোমিটার! চলুন ঠিক যেতে পারবো। যেন এই এক কিলোমিটার গেলেই পথ চলা শেষ। একদম মোক্ষলাভ নিশ্চিত !
হঠাৎ দেখলাম, সামনে একটা সাইনবোর্ড। এই প্রথম কোনো সাইনবোর্ড চোখে পড়ল যেখানে পথ নির্দেশ দেওয়া আছে। লেখা আছে, 'কেদারনাথ -১২ কিলোমিটার।ভীমবলি -২ কিলোমিটার।
- ভবেশদা, দেখুন! আমরা 9 কিলোমিটার পেরিয়ে এসেছি! ভীষণ আনন্দ হচ্ছিল। এই পাহাড়ি চড়াই পথে 9 কিলোমিটার হেঁটে ফেলা তো ওয়াটারলু যুদ্ধ জয়ের কৃতিত্বের সমান।
-ঐ তো রেন সেল্টার!' জঙ্গল চটী' এসে গেলাম তো! মনের সব শক্তিকে একত্রিত করে পা চালালাম। লাঠির শব্দ জোরালো হ'ল। ভবেশদাকে হারিয়ে যেন ট্রফিটা আমাকে জিততেই হবে। একটাই স্লোগান -'জঙ্গল চটী' চলো।
বৃষ্টির বেগ যথেষ্ট জোরালো। পৌঁছে গেলাম রেন সেল্টার। লাঠি পাশে রেখে বেঞ্চে বসার পর বুঝলাম, সব জীবনী শক্তি নিঃশেষ।
-দেবুদা, একটা ঘোড়ার খোঁজ করি?
এর আগে শুনেছিলাম, কাশ্মীরে ঘোড়ায় চড়তে গিয়ে ভবেশদা পড়ে গিয়েছিলেন। সেই থেকে পণ করেছেন, আর কখনও ঘোড়ায় চড়বেন না। সে ক্ষেত্রে ঘোড়ার খোঁজ করার কোন অর্থ হয় না। আমি তাই বললাম -
-আপনি তো ঘোড়ায় চড়বেন না। তবে আর কি? ছেড়ে দিন। আর তো মাত্র এগারো কিলোমিটার! ঠিক হেঁটে চলে যাবো। সন্ধে হতে অনেক দেরী!
বেঞ্চ ছেড়ে উঠতেই হ'ল। লাঠির জোর সম্বল করে হাঁটা শুরু করলাম। দুজনে এখন একেবারে পাশাপাশি। আবার নতুন করে পাশের প্রকৃতির দিকে তাকালাম। মেঘগুলো পাহাড়ের গলায় ওড়নার মত জড়িয়ে আছে। সামনের পথ বৃষ্টির আড়ালে ঝাপসা। ঘোড়াদের গলায় বাঁধা ঘন্টার ধ্বনি আমাদের সাবধান করছে। পথ বেশ পিছল।এক নাগাড়ে বৃষ্টি হয়ে চলেছে। হঠাৎ ভবেশদা বললেন -
-ঘোড়ায় না হয় আর একবার চড়ে দেখতে পারি। কিন্তু দেবুদা, ঘোড়াটা পাবো কোথায়? একটা নয়, আবার দুটো ঘোড়া চাই। কে এনে দেবে!
আমি ভীষণ খুশি হয়ে বললাম -
-বাবা কেদারনাথ যদি চান আপনাকে ঘোড়ায় চড়াবেন, আপনার সাধ্য কি সে আদেশ অমান্য করার?
মনে মনে 'ঘোড়া বাবা কী জয় ' বলতে বলতে হেঁটে চলেছি। প্রকৃতই বাবা কেদারনাথ মুখ তুলে চাইলেন। এই দুই মহা ভক্তের প্রতি অশেষ করুণায় এক মাঝ বয়সী রোগা মানুষকে পাঠিয়ে দিলেন। লাঠি হাতে মানুষটিকে দেখলেই মালুম হয়, এনার আদি নিবাস নেপাল বা ভুটান। আমাদের পাশে হাঁটতে হাঁটতে উনি বললেন -
-বাবুসাব, ঘোড়ে চাহিয়ে?
আমরা এতটাই হতবাক ! কি বলবো বুঝতে পারছি না। একে অপরের দিকে তাকিয়ে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করলাম। ভবেশদা খেই ধরলেন -
-হ্যাঁ, চাহিয়ে তো। তবে দুটো চাহিয়ে।
এ হিন্দি ভাষণ ভদ্রলোকের বুঝতে কোনও অসুবিধে হ'ল না। সজোরে মাথা নাড়িয়ে বললেন,
-হাঁ সাব, দো ঘোড়ে হ্যায় তো। মিল যায়েগা।
এরপর জিজ্ঞাসাবাদ, দরদস্তুর চলল হাঁটতে হাঁটতে। বৃষ্টি মাথায় ভদ্রলোকের অসীম ধৈর্য। শেষে ঘোড়া প্রতি বারশ' টাকায় রফা হ'ল। এর মধ্যে সরকারি বাবুদের নজরদারির নজরানাও ধরা হয়েছে। আমি বললাম -
-চলিয়ে, আপকা ঘোড়ে তো লাইয়ে।
-হাঁ সাব, মেহেরবানি করকে উস্ বিরিজ পার হোকে জাইয়ে। ম্যায়নে ঘোড়ে লে কর আ রহা হুঁ।
বিরিজ বলতেই আমরা সামনে তাকালাম। খেয়ালই করিনি, একশ মিটার মতন দূরে মন্দাকিনীর স্রোতের গা বরাবর একটা লোহার ব্রীজ শোয়ানো আছে। পথ ঢালু হয়ে একেবারে স্রোতের কাছে নেমে গেছে। এই হ'ল 'ভীমবলি'। এ নামটা বাসে সোনপ্রয়াগ আসার পথে শুনেছিলাম। এবার নদী পেরিয়ে নতুন পথে এগোবো আমরা।
-------
0 Comments