জ্বলদর্চি

জামরঙের পুরুষ / লক্ষীকান্ত মণ্ডল


নীল রঙের বোধেরা অনন্ত খুঁজতে থাকে

নি মা ই  জা না

রাত্রির পদচারণায় কবিতা সর্বংসহা দেবীর কাজল মুখ হয়ে যায়। প্রতিটি বৈদিক মন্ত্রের কাছে জাম রং মানুষ এক আলো-আঁধারির মায়াবী চোখ, যে চোখে নক্ষত্রেরা উপুড় হয়ে সমর্পণ করে সকল অস্তিত্বকে। অস্তিত্ব মানে এক জাম রঙের পুরুষ। জাম রং মানে নিষ্কলুষ এক আঁধার। কবি লক্ষ্মীকান্ত মন্ডল এমনই এক পুরোহিত , যিনি প্রতিদিন সূর্যকে প্রণাম করে বসে পড়েন মন্ত্রপূতঃ আসনের উপর। আজান ধ্বনি অথবা আলোর মত তরঙ্গে স্নান করিয়ে শূন্য অথবা অসীম রোদকে খুঁজতে থাকেন অসুখের ভিতর। আলো কি কখনো অবৈধ্য সঙ্গমের তৃষ্ণা বোঝে ? কুয়াশার চাদরে নেতানো স্তনে প্রজাপতি এসে বসলে নদী হয়ে যায় চারিদিক। কবিতার মুহূর্তগুলো বানডাকার মতো বিপন্নতা মুক্তি নিয়ে উড়ে যায় ব্রহ্মলোকে। কবি খুঁজে নেন গুঁড়ো গুঁড়ো প্রজাপতির রেনু-----
"ওড়াতে চাইছে বিপন্ন প্রজাপতি"।

বোল মুখ অথবা বরদা নামক অস্তিত্বের ভিতর কিভাবে জেগে থাকে ঈশ্বর। ঈশ্বর কে ঘুমিয়ে রাখে মানত বেলপাতা। আসলে প্রতিটি কবিতায় মাটির গন্ধ অথবা হিজল গাছের মাঝরাতে যে মহাজগৎ থেকে আলোর রেখা উড়ে আসে, তাতে অদ্ভুত মায়াঘোর ছড়িয়ে থাকে। ইগো ছড়িয়ে থাকে শালুক পাতার উপর, থাকতে ও পারে, তাকেও তিনি ঈশ্বরের ত্রিফলা বেল পাতার উপর অভিষিক্ত করে তুলেছেন। নিজের উপশম কপাল রেখার উপর চাঁদের সাথে, মাটির সাথে, কম্পমান মর্নিং এলার্ম এর সাথে ভাসিয়ে দিয়েছেন-----
"চাঁদ ভাসে অতল বেলপাতা " 

কোন রাত বন্ধনমুক্ত করতে পারিনা। অসীম নামক শব্দের ভেতরে হাঁটাহাঁটি করে এগিয়ে যায় অন্ধকার , নীলের ভেতর দিয়ে সিঁদুর ঢালা পাথরটির কাছে। যে ব'উটি যন্ত্রণার উপর জল ঢেলে দেয় সে আবার মাতাল পায়ে পায়ে ঢুকে যায় কুয়াশার ভেতর। কুয়াশা মানে তো চিরন্তন ধ্রুব সত্য কথার বেড়াজাল। কবি নদী ও হয়েছেন নিঃশব্দে। সঙ্গম অথবা তার বেড়াজাল পুড়তে থাকে নির্মাণের কাছে। 
নির্মাণেই নিজের খোলস -----
" আঁচলের জল নিয়ে আমি পুড়ে যায় নিঃশব্দে" 

অহংকার এর কোন শর্ত থাকেনা। মায়া ঘোরের একমাত্র একটি দরজা জানালা । উঠোনের ঝরা পাতা মাড়িয়ে কবি পৌঁছে যান শরীরের ভালোবাসার কাছে। সূর্য মানেই জ্বলন্ত এক চিতা রোদে। যে রোদে পুড়তে কালের পাথরে নিজেকে সোনা করে তোলা যায়। কবি সাদাভাত, ফুল, তুলসীপাতা ফেলে সে গুলোকে পরমান্ন করে তোলেন------- 
"অতুল গমনে মেতে ওঠেন নিশাচর "

অণু অথবা পরমাণু আঁধারের স্থানাঙ্ক চিহ্ন। জ্যামিতিক বিন্দু ছুঁয়ে ছুঁয়ে গহ্বর ছেড়ে বের করে কম্পনের জরুল। দিনকাল বাহিত করেন কবি নিজের মতো করেই। নিপুন ভাবে ভরিয়ে তোলেন উষ্ণতার প্রতিটি ক্ষেত্র। প্রাণের কৃষ্ণ প্রতিটি কবিতায়----------
"কম্পনের জড়ুলে প্রাণ গুলিক্রমশ উষ্ণ।"
'
'বেহাগ' কবিতায় আদিম নির্জনতা কিভাবে অদৃশ্য হতে হতে চৈত্র মাস হয়ে গেল। বিনীত ঠোঁটে নিজের সুখ অন্তরা গাইতে না পেরে পাতা ঝরার শব্দে বাদামী রং হয়ে গেল। শালিক গাইলে বড় মায়া জেগে ওঠে বুকের ভেতর। 
মোহ জ্যোৎস্নায় কতজন যাযাবর হয়ে গেছে। শালুকের পাতায় ঘরের ছায়া খুঁজে বের করে মৌসুমী বাতাস। তাপের মতো তীব্র গোপনীয়তার দূরত্ব ঘুচে যায় এক দুপুরে------
"এক দুপুর মোহে"

ভূগোলের অক্ষাংশ নিয়ে যে নারী হাঁস চরাতে জানে, সে জানে তার সাথেও পরান মন্ডল ও খুঁড়ে চলেছে নিজের জন্য মাটির গহ্বর। পায়ের ছাপে উর্বরতা খুঁজতে থাকে স্নান গন্ধে------ 
"পরান মন্ডলের আদিগন্ত কাঁপন "

অসুখেরও ভাঙ্গা রাস্তা আছে। ভক্ষণের মাঝে যে স্নিগ্ধতা আর পরমানন্দ আছে সে কথা জানে কেবল জাম রঙের দোতারা। যে কেবল নিজেকে বাঁচিয়ে শুদ্ধ করে ঘন্টা, মিনিট, সেকেন্ড নামক নির্জনতার একক গুলি। কবি চাতক পাখিকে বিন্দু বিন্দুর অবস্থান দিয়েছেন এই কার্তিক মাসেই। বিকালে উদভ্রান্ত হয়ে পড়েন এক অমৃতযোগের তুলসী বাগানের নাড়ী। বসে থাকেন ঠাকুরদা নামক এক প্রাচীন স্বরযোগ। 
পাখি কখনো সুখ হয়ে উড়ে আসে ঈশান কোণ থেকে। গাছের ডালে ডেকে যায় বছরের পর বছর, পরাগ মিলনের মত অসীম যোগের সূর্যোদয় নিয়ে। মহাপ্রস্থানের গর্ত খুঁড়ে চলে অন্তিম শয়ানের ধ্বংসাবশেষে। ক্রমশ নাবাল হয়ে ওঠে------
"তখনই আমি কলম"

সকল অনাবৃত শরীরের ক্ষত লুকিয়ে আছে দারিদ্রতার আড়াল অথবা নীল আগুনে। পোড়া শরীরে কবি চাঁদকে দেখতে পান কপালেশ্বর উৎসমূলে। পাতা ঝরার শব্দ কত মলিন অথবা পবিত্র। বালক অভিমুন্য সবুজ পাতা ভরে চুপ ঠোঁটে দাঁড়িয়ে থাকে সাদা রঙের ভাত গন্ধের কাছে --------
"নিখাদ অবোধ পুরুষেরা নিজেকে সপ্তরথীর হাতে মরতেও দেখে "

কবি মানেই নক্ষত্র রঙের আত্মীয়তা। প্রতিটি অক্ষর অথবা অনুভব ছুঁয়ে গেছে জাম রঙের পুরুষের সার্থকতা। বড় সুখপাঠ্য ।

লক্ষ্মীকান্ত মন্ডল
জাম রঙের পুরুষ 
প্রচ্ছদ -কমলেশ নন্দ 
প্রকাশক -কবিতিকা 
প্রথম প্রকাশ---২০১৯ 
মূল্য ৭০টাকা

Post a Comment

0 Comments