জ্বলদর্চি

শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ সঙ্গীতামৃত - ৪



শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ সঙ্গীতামৃত  

সু দ র্শ ন  ন ন্দী

পরের গানের উল্লেখ পাই ৬ই মার্চ ১৮৮২। দক্ষিণেশ্বরে ভক্ত হনুমান প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে বললেন হনুমানের কিছুর অভাব নেই। সে শুধু ভগবানকে চায়। মন্দোদরী যখন হনুমানকে ফল দেখিয়ে হাতের অস্ত্র ফেলতে বলল তখন হনুমান বলল, এই বলে ঠাকুর গাইলেন-
আমার কি ফলের অভাব।
পেয়েছি যে ফল জনম সফল, 
মোক্ষ ফলের বৃক্ষ রাম হৃদয়ে।...
গানটি দাশরথি রায়ের লেখা। গানটির উল্লেখ পাই একবারই। 
পরের গান। ১১ই মার্চ থেকে ২রা এপ্রিল কোন একদিন। ঠাকুর নিজের ঘরে ছোট খাটটির উপর বসে আছেন, আনন্দময় মূর্তি -- হাস্যবদন। শ্রীযুক্ত কালীকৃষ্ণের সঙ্গে মাস্টার এসেছেন।
কালীকৃষ্ণ জানতেন না, তাঁকে তাঁর বন্ধু কোথায়  নিয়ে এসেছেন। বন্ধু বলেছিলেন, “শুঁড়ির দোকানে যাবে তো আমার সঙ্গে এস; সেখানে এক জালা মদ আছে।”  
ঠাকুর হাসছেন। বললেন, “ভজানন্দ, ব্রহ্মানন্দ, এই আনন্দই সুরা; প্রেমের সুরা। মানবজীবনের উদ্দেশ্য ঈশ্বরে প্রেম, ঈশ্বরকে ভালবাসা। ভক্তিই সার, জ্ঞানবিচার করে ঈশ্বরকে জানা বড়ই কঠিন।”
এই বলে ঠাকুর গান গাইতে লাগলেন:
কে জানে কালী কেমন, ষড় দর্শনে না পায় দরশন।
আত্মারামের আত্মা কালী প্রমাণ প্রণবের মতন...
 
প্রতিটি গানে তিনি ঈশ্বরের কথা এভাবেই প্রকাশ করেছেন ভক্তদের। দেখিয়ে দিয়েছেন ঈশ্বরলাভের পথটিও ।
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণদেব আবার বলছেন, ঈশ্বরকে ভালবাসা- এইটি জীবনের উদ্দেশ্য; যেমন বৃন্দাবনে গোপ-গোপীরা, রাখালরা শ্রীকৃষ্ণকে ভালবাসত। যখন শ্রীকৃষ্ণ মথুরায় গেলেন, রাখালেরা তাঁর বিরহে কেঁদে কেঁদে বেড়াত।
এই বলে ঠাকুর উপরের দিকে তাকিয়ে গান শুরু করলেন:
দেখে এলাম এক নবীন রাখাল,
নবীন তরুর ডাল ধরে...
 
ঠাকুরের প্রেমমাখা গান শুনে মাস্টার আনন্দে কেঁদে ফেললেন। ভক্তরা বিহ্বল।
প্রথম গানটি বিদ্যাসাগরের বাড়িতে, শ্যামপুকুরের বাড়িতে সহ ঠাকুর সাতবার গেয়েছেন বলে উল্লেখ পাই কথামৃতে। দ্বিতীয় গানের উল্লেখ পাই একবারই ।
পরের গানের উল্লেখ ২রা এপ্রিল, ১৮৮২, বেলা ৫টা। ঠাকুর কেশবচন্দ্রের বাড়িতে গেছেন। ঘরে ঢুকে ঠাকুর বললেন, তোমার অনেক কাজ, আবার খপরের কাগজে লিখতে হয়; সেখানে (দক্ষিণেশ্বরে) যাবার অবসর নাই; তাই আমিই তোমায় দেখতে এসেছি। তোমার অসুখ শুনে ডাব-চিনি মেনেছিলুম; মাকে বললুম, “মা! কেশবের যদি কিছু হয়, তাহলে কলিকাতায় গেলে কার সঙ্গে কথা কইব।”
ঠাকুরের আরও অনেক কথা হল ভক্তদের সঙ্গে। কথার পর এবার গান।
ব্রাহ্মভক্ত ত্রৈলোক্যনাথ গান গাইছেন। গান গাইতে গাইতে সন্ধ্যার বাতি জ্বালা হল, গান শুনতে শুনতে ঠাকুর হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লেন -- আর মার নাম করতে করতে সমাধিস্থ হয়ে গেলেন। কিঞ্চিৎ প্রকৃতিস্থ হয়ে নিজেই নৃত্য করতে করতে গান ধরলেন:

সুরা পান করি না আমি সুধা খাই জয় কালী বলে,
মন-মাতালে মাতাল করে মদ-মাতালে মাতাল বলে...
 
গানটি রামপ্রসাদ সেনের। কথামৃতে দেখি ঠাকুর চারবার গেয়েছেন গানটি। কেশব সেনের বাড়ি ছাড়াও দক্ষিণেশ্বরে এবং শ্যামপুকুরের বাড়িতে। 
কেশবচন্দ্রের বাড়িতে সেদিন আরেকটি গান গেয়েছিলেন ঠাকুর।গানটি বঙ্কিমচন্দ্রের লেখা।
কথামৃতকারের বর্ণনায়-শ্রীযুক্ত কেশবকে ঠাকুর স্নেহপূর্ণ নয়নে দেখিতেছেন। যেন কত আপনার লোক; আর যেন ভয় করিতেছেন, কেশব পাছে অন্য কারু, অর্থাৎ সংসারে হয়েন! তাঁহার দিকে তাকাইয়া আবার গান ধরিলেন:

কথা বলতে ডরাই; না বললেও ডরাই ৷
মনের সন্দ হয়; পাছে তোমা ধনে হারাই হারাই...
 
ঠাকুর বোঝাচ্ছেন “আমরা জানি যে মন-তোর; দিলাম তোরে সেই মন্তোর; এখন মন তোর।” অর্থাৎ সব ত্যাগ করে ভগবানকে ডাক, -- তিনিই সত্য, আর সব অনিত্য; তাঁকে না লাভ করলে কিছুই হল না! এই মহামন্ত্র।
উপরের গানটি ঠাকুর আরেকবার গেয়েছেন ১৮৮৫এর দোল পূর্ণিমার দিন।

১৮৮২, ৫ই অগস্ট ঠাকুর এসেছেন বিদ্যাসাগরের বাদুড়বাগানের বাড়িতে। ঠাকুরের অনেকদিনের ইচ্ছে বিদ্যাসাগরের বাড়ি আসতে। বাড়িতে ধর্ম প্রসঙ্গে কথা হচ্ছে।ঠাকুর বিদ্যাসাগরকে কথাপ্রসঙ্গে জিজ্ঞাসা করলেন-আচ্ছা, তোমার কি ভাব?
বিদ্যাসাগর মৃদু মৃদু হাসছেন। বললেন, “আচ্ছা সে কথা আপনাকে একলা-একলা একদিন বলব।”
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্য) -- তাঁকে পাণ্ডিত্য দ্বারা বিচার করে জানা যায় না।
এই বলে ঠাকুর প্রেমোন্মত্ত হয়ে গান ধরলেন। গানটি রামপ্রসাদ সেনের।
 
কে জানে কালী কেমন?
ষড় দর্শনে না পায় দরশন ...

গানের শেষে ঠাকুর বোঝালেন-“দেখলে, কালীর ‘উদরে ব্রহ্মাণ্ড ভাণ্ড প্রকাণ্ড তা জানো কেমন’! আর বলছে, ‘ষড় দর্শনে না পায় দরশন’ -- পাণ্ডিত্যে তাঁকে পাওয়া যায় না।”
ঠাকুর এই গানটি আগেই উল্লেখ করেছি। সাতবার গেয়েছেন বলে কথামৃতে উল্লেখ পাই।
-----------------------------------------------------
প্রতি সোমবার ও বৃহস্পতিবার এই ধারাবাহিক প্রকাশ পাচ্ছে।
www.jaladarchi.com 
  

Post a Comment

0 Comments