জ্বলদর্চি

নির্জন পুরুষ অসুখ / নিমাই জানা

প্রতিটি ঘরেই বসত করে নির্জন পুরুষ

অ ল ক  জা না

বাংলা কবিতায় এখন নতুন একটি নাম বেশ শোনা যায়। প্রথম দশকের কবি নিমাই জানা। আদ্যোপান্ত বসবাসের ভুগোল ইতিহাস বিজ্ঞান লোকায়ত সংস্কৃতি সযত্নে লালিত, তার কবিতার একান্ত ভিত্তিভূমি। কবিতার ভিড় ঠেলে সহজেই নিজেকে চিনিয়ে দেয়ার মুন্সিয়ানা কবি নিমাই-এর সহজাত প্রকৃতি। সেই প্রতিশ্রুতিতে হাতে তুলে নিয়েছেন কলম। 

নীরবযোদ্ধা কলমবাসে পরম সুখ ও ঐশ্বর্য প্রাপ্তি বলেই তিনি মনে করেন। খাঁটি দুধ পরম উপাদেয় সুষম খাদ্য। ছানা বের করলেই বোঝা যায় কতখানি পুষ্টিগুণ যুক্ত, নিমাই-এর কবিতা সেই স্বাচ্ছন্দ্যই দাবি করে। দ্বিতীয় কবিতার বই "নির্জন পুরুষ অসুখ" পড়তে পড়তে তাই মনে হলো।

এই পুস্তিকায় মোট ২৮ কবিতা লিপিবদ্ধ। বাস্তব পরাবাস্তবের অভিনব মিশেল, চিত্রকল্প দর্শন অনবদ্য। সবমিলিয়ে বাংলা কবিতার ধারা থেকে নিজস্ব রাস্তা তৈরির তপস্যা দু একটি জায়গায় লঘু হলেও, তা সার্বিক নান্দনিকতায় কোন ভাবেই প্রভাব খাটাতে পারেনি। 

সুতরাং আমরা যারা কবিতাপ্রেমী, বা কবিতা পড়তে ভালোবাসি, কবিতা আমাদের ঘরদোর তাদের জন্য নিশ্চিত ভাবে পুষ্টি ও তৃষ্ণা নিবারণে কবি নিমাই-এর "নির্জন পুরুষ অসুখ" বিশেষ সহায় হবে বলে আমি মনে করি।

এবার আসা যাক কবি নিমাই-এর কবিতায় ----

"নাবাল জমি থেকে উঠে আসছেন আমার বাবা
হাতে কিছু শ্যামা ঘাস আর শুশনি লতা
প্রতি সন্ধেবেলায় আয়ু মিশে যাচ্ছে
রামায়ণ হলুদ পাতায় " 
(আয়ু)
বাবাও প্রকৃতির অংশ। সারা শরীরে লতাঘাস মাটির গন্ধে যিনি এক পরম সুখ ছায়া হয়ে সংসার আগলে রাখেন। অস্তিত্বের রামায়ণ চর্চার মাধ্যমে একদা ফুরিয়ে আসা পরমায়ু নিরলস একাকর হয়ে যান বাবা।

"প্রেমে পড়লেই এই বৃষ্টিতে ভিজে যায় সকল/
কালো রাস্তা এগিয়ে চলেছে বাড়ির রাস্তার দিকে।"
(নিরন্তর হেঁটে যাওয়া)
এই কবিতায়----"ধান দুর্বার মতো চারাগাছের ঝোপে
সন্ধ্যাতারা আগুন জ্বেলে রাখে" 
তো এভাবেই কথার কোলাজে কবি নিমাই চিত্রকল্প সাজিয়ে চলেন।

"লোকটির কোন কালিদহ নেই ---লাঙ্গলকাটা নেই"
নৈবেদ্য সাজিয়ে মৃত্যুকে এতো কাছ থেকে দেখা যায়"
"কলাখোলের ওপর পৃথিবী যেন ছোটো ছোটো তুলসীপাতা হযে ভেসে আছে"
(ঈশ্বর তিন শব্দের কবিতা)
রূপকের আশ্রয় করে মৃত্যুও কত সুখকর। সেই সঙ্গে আত্মার শান্তি লাভের যে প্রক্রিয়া তাতে পৃথিবীও তুলসীপাতার মতো পবিত্র এবং স্বর্গীয় হয়ে ওঠে।

"একবারই মৃত্যু ঘটে, শিশুপুত্রের আদর খাঁজে
পুণ্য বাঁকে দাঁড়িয়ে থাকি
মা ভাসছেন মেঘের মতো"
(মৃত শরীরের বিবরণ)
চিরন্তন কথা, একবারই মৃত্যু ঘটে। সংসারের সমস্ত মায়া কাটিয়ে মা, মেঘ হয়ে যায়। কি দারুণ দর্শন !

"নদী পেরোলেই বৃষ্টি হয়ে যাই 
নদী পেরোলেই কদমফুল পাখি হয়ে যায়---শূন্যে
চেরা চেরা জিভের স্বাদ গ্রহণে
মেতে ওঠে ইন্দ্রিয় সুখে"
(নিষিদ্ধ পুরুষের পরকীয়া)
মিথুন সুখে বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ার যে শান্তি
ঠিত সে কারণেই কদম ফুলও নদী পেরোতে গিয়ে পাখির মতো মুক্ত হয়ে যায়।

"বুকের কাছে মায়ের মোহময়ী মুখ আটকে আছে
মা এখন ওই পাড়ের নাবিক
পৃথিবী ছাড়িয়ে অন্য আয়ুতে "
( নিরাময়)
আসলে আমরা বরাদ্দ আয়ু খরচের পর আর এক আয়ু লাভ করি যার কোন শেষ কিংবা অন্ত নেই।

"ঈশ্বরী ঠোঁট তুলে নেয় ---আত্মা
আমিও কেবল সারারাত ঈশ্বরের সাথে ঘুমোতে চলে যাই ---ঘুমহীন চোখে"
(ঘুমহীন শরীর)
ঈশ্বরকে পেতে গেলে সমস্ত রিপুর বিপরীতে ডাকতে হয়। সেই আপ্তবাক্যই প্রতিষ্ঠা করেন কবি।

"নির্জন পুরুষ অসুখ" কবিতা পুস্তিকায় এভাবেই দর্শন চিত্রকল্পের নানার রঙের পাতাবাহার পরিচর্যা
করেছেন কবি। এই বই কবিতা প্রেমীদের অনেকটাই আনন্দ বর্ষণে সহায় হবে বলে আমি অধিকতর আশাবাদী।

নির্জন পুরুষ অসুখ--নিমাই জানা
প্রকাশ---২০১৯
প্রচ্ছদ ---কমলেশ নন্দ
প্রকাশক---কবিতিকা
মূল্য ---৭০ টাকা

Post a Comment

0 Comments