জ্বলদর্চি

পথ যখন সঙ্গী -২



পথ যখন সঙ্গী  || পর্ব -২

ন রে ন  হা ল দা র 


পরদিন আমাদের গন্তব্য থলকোবাদ, কিরিবুরু আর মেঘাটাবুরু। বুরু মানে ছোটো পাহাড়। মনোহরপুরে যিনি আমাদের থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন সেই মুন্নাভাই একটা টাটা সুমোও জোগাড় করে দিয়েছিলেন। ওখানে গাড়ি ভাড়ার নিয়ম – সারাদিনে গাড়ি আর ড্রাইভারের ভাড়া দেড় হাজার টাকা(২০১৮) আর তেল খরচ সওয়ারির। তেল ভরো আর চলো। যত কিলোমিটার ঘুরতে পারো ঘুরে নাও।
আমাদের গাড়ি চলেছে ঘন বনের ভিতর দিয়ে। কখনো বা উন্মুক্ত প্রান্তর আর দু একটা বাড়ি। বিভূতিভূষণের ‘আরণ্যক’-এ পড়া সেই সব ঘরবাড়ি। দেখে বোঝা যায় এ সব আদিবাসিদের বাড়ি। কারণ তাদের মাটির ঘরের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্যই হোল মাটির দেওয়ালের নিচ থেকে উপর পর্যন্ত প্রায় দুই থেকে আড়াই ফুট গোবর বা কালো রঙের মাটি দিয়ে লেপা থাকে। পরে খোঁজ নিয়ে জেনেছিলাম ওটা ওদের ধর্মীয় বিশ্বাসের সাথে জড়িত।
বনের ভিতর দিয়ে আমরা এসে পৌঁছেছি একটি ছোটো নদীর পাড়ে। ড্রাইভার বলল এই জায়গাটা নাকি উড়িষ্যা রাজ্যের মধ্যে পড়ে। মালভূমের উপর দিয়ে বয়ে চলা নদী যেমন হয়; বালির নাম মাত্র নেই, শুধু পাথর আর পাথর, কোথাও বড় বড় কোথাও ছোটো। বড় বড় পাথরে জল আঘাত খেয়ে পাশ কাটিয়ে তীরবেগে নেমে গেছে পাশের নিচু জায়গায়। দু’দিকে তাকিয়ে দেখি নদীর উজান আর ভাটি কোথায় যেন বনের মধ্যে হারিয়ে গেছে। 
ড্রাইভার খোঁজ দিল পাশেই নাকি কোথাও একটা ঝাঁটি ঝর্ণা আছে। সে পর্যন্ত গাড়ি যাবে না, এক কিলোমিটারের মতো রাস্তা পায়ে হেঁটেই যেতে হবে। ‘ঝাঁটি’ কথার অর্থ খুব উঁচু থেকে পড়া ছোটো জলপ্রপার। বুরুডিতে গিয়েও এরকম একটা ঝাঁটি ঝর্ণা দেখেছিলাম। গাড়ি এসে থামলো একটি আকরিকের খনির কাছে (রাকা মাইন)। এর পাশ দিয়েই বনপথে হেঁটে পৌঁছতে হবে ঝাঁটি ঝর্ণার কাছে। অনেকটা জায়গা জুড়ে এই খনি। এর আগে আমি কখনো খনি দেখিনি। চারুব্রত মুখোপাধ্যায়ের ‘অরণ্য পথিক’ উপন্যাসে এরকম একটি খনির বর্ণনা আছে। কিন্তু সে বর্ণনায় ছিল প্রাচীন পদ্ধতিতে আকরিক উত্তোলনের কথা, শ্রমিকের প্রয়োজন সেখানে বেশি। কিন্তু আমার চোখের সামনে যে খনি তার কাজকর্ম সবটাই যান্ত্রিক। বহুদূর বিস্তৃত মোটা মোটা পাইপ বিছানো, তার পাশ দিয়ে মনোরেলের মতো ছোটো লাইন বিছানো। 
খনিকে পাশে রেখে আমরা এগিয়ে চলেছি। যে পথ দিয়ে চলেছি তার উপরে ঝুঁকে পড়েছে দুদিকের জঙ্গল, যেন আমাদের গতি রোধ করতে চাইছে। ছোটো নালার মতো একটা জলধারা, তার পাশ দিয়ে পথ। দেখে বোঝা যাচ্ছে এই জল ওই ঝাঁটি ঝর্ণা থেকেই আসছে। প্রারম্ভিক নির্জনতা দেখে মনে হয়েছিল হয়তো এখানে কেউ আসে না। কিন্তু বাঙালি ভ্রমণ পিপাসু, তাদের দেখা প্রায় সব জায়গাতেই পাওয়া যায়! জঙ্গলের বাধা ঠেলে আমরা এসে পৌঁছলাম গন্তব্যে। এ ঝর্ণা বড় নয়, কিন্তু আশ্চর্য লাগে, কোন উঁচু থেকে একটা দুটো জলধারা বটের ঝুড়ির মতো নিচে এসে ছড়িয়ে পড়ছে। আর পাথরের গায়ে আঘাত খেয়ে ছিটানো জলে রামধনু আঁকা হয়ে যাচ্ছে আমাদের চারিপাশে। অপূর্ব মায়া। ভুলে যাই আমি কে? কোথা থেকে এসেছি। 
(ক্রমশ) 

Post a Comment

0 Comments