অবলুপ্ত ‘অবতার’
মু ক্তি দা শ
ইংরেজিতে একটি কথা আছে, ‘হিউমার ইজ্ দ্য সল্ট অফ্ কনভারসেশন্, নট দ্য ফুড’। কিন্তু সেই ‘হিউমার’ এখন বাঙালি-জীবন থেকে ভোজবাজির মতন উধাও। বাংলা-সাহিত্যের পংক্তিভোজনে এখন লবণহীন খাবারই হরদম পরিবেশন করা হচ্ছে। আর আমরা, বাংলাসাহিত্যের বুভুক্ষু পাঠকরা, সেই বিস্বাদ খাবার নির্বিচারে এবং নির্বিবাদে গিলে চলেছি। উপায়ই বা কী ! এখন সিরিয়াসনেসের যুগ। হাসি-ঠাট্টা রঙ্গ-তামাশার মধ্যে ডুবে থাকার সময় থাকলে তো ! সাহিত্যের দরবারে অপাংক্তেয়, ব্রাত্য হবার ভয়ে লেখককুলও বোধহয় আর সরস-সাহিত্য সৃষ্টির ব্যাপারে তেমন দুঃসাহসিক হতে পারছেন না। ‘হিউমার’ বা উইটধর্মী সাহিত্যের রসাস্বাদন থেকে তাই আমরা আজ সর্বতোভাবে বঞ্চিত। আমাদের হাসির ঝুলিতে ত্রৈলোক্যনাথ, পরশুরাম, শিবরাম, সুকুমার আজও ভাস্বর।
বর্তমানকালে অবিশ্বাস্য মনে হলেও জেনে রাখা দরকার যে, বিংশ শতাব্দীরই প্রথমার্ধে ‘অবতার’ নামে একটি আগাগোড়া রঙ্গব্যঙ্গের সাহিত্য-সাপ্তাহিক তাবৎ কলকাতা এবং মফস্বল দাপিয়ে বেড়াতো। ‘অবতার’ আগাগোড়াই আক্ষরিক অর্থে নির্ভেজাল রঙ্গব্যঙ্গের কাগজ। একেবারে প্রচ্ছদ থেকে শুরু করে শেষ-মলাট পর্যন্ত হাসি-তামাশার ঠাসবুনন। তখনকার প্রতিটি মানুষ সারা সপ্তাহ উন্মুখ হয়ে থাকতো বৃহস্পতিবারের জন্যে। হ্যাঁ, বৃহস্পতিবারই ‘অবতার’-এর প্রকাশ বার। কম করেও হাজার দশেকের বেশি কপি হট্-কেকের মতো বিক্রি হয়ে যেত প্রতি সপ্তাহে। যদিও প্রচ্ছদে এর প্রচারসংখ্যার উল্লেখ প্রসংগে ব্যঙ্গ করে ছাপানো হতো প্রথমে পর পর সাতাশটি শূন্য এবং তারপর এক। আরও সব মজার মজার ব্যাপার থকতো। যেমন, প্রতি সংখ্যার প্রথম পৃষ্ঠায় অবধারিত ভাবে মুদ্রিত হতো ঊনবিংশ শতাব্দীর রঙ্গরসের অবিস্মরণীয় ও সর্বাধিক জনপ্রিয় কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের সেই বিখ্যাত পংক্তি-‘এত ভঙ্গ বঙ্গদেশ, তবু রঙ্গে ভরা’। এছাড়াও ওই প্রথম পাতাতেই থাকতো একজন মানুষের প্রাচ্য-পাশ্চাত্ত্য মিশ্রিত রূপের ছবি। মাথার একদিকে আধখানা হ্যাট্, তো আর একদিকে বিশাল টিকি। একহাতে চুরুট, অন্যহাতে থেলো হুঁকো। পরণে একদিকে কোট-ট্রাউজার-জুতো, অন্যদিকে নামাবলি-ধুতি-খড়ম। এইরকম আর কি!
এ তো গেল ‘অবতার’-এর অঙ্গসৌষ্ঠব। বিষয়বস্তুর চমৎকারিত্বেও ‘অবতার’ তুলনারহিত। ষোলো পৃষ্ঠার এই সাপ্তাহিকে ছোটগল্প, প্রবন্ধ, নক্শা, সংবাদ, ছড়া, কবিতা, ব্যঙ্গচিত্র মায় বিজ্ঞাপন, সবই স্থান পেয়েছে। বেশিরভাগ ব্যঙ্গচিত্রই শিল্পী বলদেব রায়ের আঁকা।
স্বনামে বেনামে সেকালের বহু কবি সাহিত্যিকই ‘অবতার’-এ হাত পাকিয়েছেন। বিভিন্ন সংখ্যায় ছোটগল্প লিখে পাঠককুলের প্রশংসাধন্য হয়েছেন জীবনভূষণ কাব্যালংকার, জ্ঞানেন্দ্রনাথ সরকার, তারাপদ মুখোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ। এবং প্রবন্ধকারদের মধ্যে যতিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, এ. বি. মজুমদার, কালাপাহাড়, দর্শক, ভূষণ্ডী, অহিভূষণ মজুমদার, রসাচার্য, স্বদেশরঞ্জন চক্রবর্তী, মাখনলাল সেন, নিধিরাম সর্দার, অমরেন্দ্রনাথ রায় প্রভৃতির নাম উল্লেখযোগ্য। আর ছড়া ও কবিতা লিখতেন কাঁড়াদাস বাবাজী, প্রবোধচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় (বাঘাবাবু), শ্রীঅভয়, ভৈরবানন্দ এবং আরও অনেকে।
কলকাতার বিভিন্ন চমকপ্রদ ঘটনা ও তৎকালীন নানাবিধ সামাজিক সমস্যা নিয়ে ‘অবতার’-এ হামেশাই প্রকাশিত হতো ব্যঙ্গকবিতা ও ছড়া। যেমন কলকাতার নকলসাধু বা কলকাতা কর্পোরেশনের নির্বাচন বা রাজনৈতিক নেতাদের খেয়োখেয়ি, এরকম নানা ঘটনার উপর ব্যঙ্গের চাবুক চালাতো ‘অবতার’।
তিরিশ হাজার টাকা ব্যয়ে কার্জনপার্কে রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মূর্তিস্থাপনকে কেন্দ্র করে ‘অবতার’-এ ছাপা হলো একটি বেশ মজাদার এবং উপভোগ্য ব্যঙ্গকবিতা, যা উদ্ধৃত করার লোভ সংবরণ করা বড়ই কষ্টসাধ্য। কবিতাটির শীর্ষনাম ‘অবাক ছাঁচ’। কবিতাটি এরকম :
ক্ষুরে ক্ষুরে দন্ডবৎ, রথা-রথীগণ !
ভেবেছ কি দেশবাসী দৃষ্টিশক্তিহীন ?
কার্জন-উদ্যানশোভা করিতে বর্ধন,
তিরিশ হাজার টাকা হইল উড্ডীন !
ঢাক-ঢোল-তূরী-ভেরী বাজায়ে দামামা,
প্রতিমূর্তি আবরণ হল উন্মোচিত ;
নাক কাটি বিশ্বকর্মা ঘষি দিল ঝামা,
তাজ্জব পুতুল এক হইল স্থাপিত !
থাকে যদি সৎসাহস বজ্রকন্ঠে কহ :
সুরেন্দ্রনাথের মূর্তি কভু ইহা নয়।
সত্যের মর্য্যাদা রক্ষা নির্ভয়ে করহ,
মনে মুখে এক হও কিসে এত ভয়,
মুখশ্রীতে তিলমাত্র সাদৃশ্য তো নাই !
সুরেন্দ্রের ভক্তবৃন্দ সবাই কি কানা ?
লেখনী সংযত করি বুঝাইতে চাই-
মেসোরে বলিতে বাবা শাস্ত্রে আছে মানা।
এখন যেমন আগাছার মতো যত্রতত্র চিট্ফান্ড গজিয়ে উঠেছে, সেকালেও এরকম দৃষ্টান্ত বিরল ছিল না। ‘গ্রেট ইন্ডিয়া’ নামে একটি দেশী জীবনবীমা কোম্পানি বহু নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তকে পথে বসিয়ে রাতারাতি লাটে উঠলো। মজার ব্যাপার এই যে, এই প্রতিষ্ঠানের সংগে আবার তদানীন্তন কলকাতার অনেক নামজাদা ওপরতলার লোকেরাও জড়িত ছিলেন। পরে সেটা ফাঁস হয়ে যায়। এমন সুস্বাদু ঘটনাটি প্রায় সংগে সংগে লুফে নিল ‘অবতার’। ‘দেগে দাও’ শীর্ষক কবিতায় লেখা হলো :
‘গ্রেট ইন্ডিয়া’ কুপোকাৎ,
চোরেদের বাজীমাৎ
হের ঐ সারাদেশে উঠে হাহাকার।
দেশেতে মানুষ নাই,
হেন দশা ঘটে তাই-
লক্ষ লক্ষ কাপুরুষ, মনুষ্য আকার।......
ভুলাইতে অজ্ঞজনে,
কিবা ঘটা বিজ্ঞাপনে,
জীবনান্তে বীমাকারী অষ্টরম্ভা খায়।
পড়িয়া বিষম ফাঁদে,
অনাথা বিধবা কাঁদে,
সরকারের বজ্রমুষ্টি ভিক্ষা তারা চায়।
বড় বড় রথারথী
সবাই সাজিল সতী,
নামের কাঙ্গাল যত ছিল ডিরেক্টর।
স্বচ্ছন্দে মোটর চড়ে,
হাতে দড়ি নাহি পড়ে,
নামের মাহাত্ম্য কিবা মহিমা অপার।
‘অবতার’-এর সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিভাগ ছিল ‘সাড়ে বত্রিশ ভাজা’। এই বিভাগে নানাধরণের টাটকা অথচ মজাদার সংবাদ, ঘটনা এবং টীকা-টিপ্পনী পরিবেশন করা হতো।
‘অবতার’ পত্রিকার অফিসকে বলা হতো ‘অবতারের আখড়া’। এই আখড়ার ঠিকানা ১৯২৩ সালের দিকে ছিল ৫৩ নং সীতারাম ঘোষ ষ্ট্রিট। মুদ্রণের দায়িত্বে ছিল তারা প্রেস। তারা প্রেসের ঠিকানা : ৪৮ নং পটলডাঙা ষ্ট্রিট। সম্পাদক তথা প্রকাশক হিসেবে সেসময় শশধর ঘোষের নাম মুদ্রিত থাকতো। বয়স চৌত্রিশ। পিতা-অভয়কুমার ঘোষ। গ্রাম-রামপুর, পুলিশথানা-বড়জোড়া, জেলা-বাঁকুড়া। ১৯৩৯ সালের মাঝামাঝি সময়ে ৫৩ নং থেকে ৫৬ নং সীতারাম ঘোষ ষ্ট্রিটে আখড়া উঠে আসে। এবং শেষমেষ ১৯৪১ সালে আখড়া স্থানান্তরিত হয় ১০ নং শ্যামাচরণ দে ষ্ট্রিটে। ততদিনে অবশ্য সম্পাদকের নামও পরিবর্তিত হয়েছে। শশধর ঘোষের জায়গায় এসেছেন অমূল্যচরণ সেন। মানগত দিক থেকে ‘অবতার’ কতখানি উন্নত ছিল তার চুলচেরা বিচার-বিশ্লেষণ করবেন সাহিত্য-সমালোচক ও গবেষকরা। ব্যঙ্গপত্রিকা হিসেবে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে ‘অবতার’-এর স্থান থাকুক বা না-থাকুক, জনপ্রিয়তার নিরিখে সেকালের মানুষের হৃদয়ে ‘অবতার’-এর আসনটি যে একেবারে পাকাপোক্ত হয়ে ছিল, একথা দ্বিধাহীনভাবে বলা যায়।
0 Comments