জ্বলদর্চি

দীর্ঘ কবিতা / তুলসীদাস মাইতি

ফোটোগ্রাফি- সৈয়দ স্নেহাংশু   


এই ঘর আমার নয়

তু ল সী দা স  মা ই তি

একটা ছোটো ঘর চাই। নিজেদের ঘর। 

পুবদুয়ারি- দক্ষিনে ছায়াদিঘি আর জানালায় কাচ, তুমি বলেছিলে, একটা ফলের গাছ । উত্তরের ঝুল-বারান্দা থেকে লেবুর গন্ধ এলে তোমার কাছে চলে আসা।
সুপর্ণা, তোমার মনে পড়ে একটা সামান্য কারণে
তুমুল কলহ সন্ধে বেলা।  সারা রাত্রি তুমি দক্ষিণ জানালায় আর আমি সিড়ির রেলিঙ ধরে। 
ঘুমহীন সকাল, চায়ের গন্ধ পেয়ে যেন কিছুই হয়নি।

তোমারও ইচ্ছে ছিল ছাদে একটা ঘর চাই।  

যমুনাবাঁধ থেকে যে বালিহাঁস আর সাদা বকের দল উড়ে এসে বসত কাঁটা বাঁশের ঝাড়ে, হাসপাতলের আলোয় সারারাত তাদের ঘুমন্ত শরীর দেখা যেত। 
বর্ষার বিকেলে তাদের আরও কাছে  পেতে চেয়ে 
পুরো ছাদ জুড়েই ঘর বাড়লো। সকালের কাকেরা চিলেকোঠার ঠিক ওপরে দেখা দিয়ে গেলেও বিকেলের বকদল তখনো আকাশের কোল ছুঁয়েই উড়ে আসতো।
এইভাবেই দৃশ্য বদল। এই ভাবেই বারোমাস্যায় সুখ দুঃখের বসবাস । কখনো বারান্দায়,কখনো একান্ত ঘুমের ভেতর,  কখনো বা  প্রতিবেশীর মতো তারা আশেপাশেই চলাফেরা করে। আমাদের জীবিত রাখে।
সেদিন রান্না ঘরের জানালায় পাশের বাড়ির ছাদে শালিকের সঙ্গম কলা 
কোথা থেকে একটা তৃতীয় শালিক আসতেই 
একটা লাজুক লাজুক দৃশ্য দেখেছিলাম । 
তুমিও সেদিন আমার মুখের দিকে তাকিয়ে 
বলেছিলে- পাখিদের সমাজেও সৌজন্য আছে । 
কলাদিঘীর নৈঋত কোণে ছোটো ডুমুর গাছ 
মগডালে মাছরাঙার অপেক্ষা দেখতে দেখতে 
তোমার কাছে খাবার চেয়ে বসতাম। 
সেবার যখন বাগানের মূসাণ্ডা গাছটায়
বুলবুলির দুটো বাচ্চা হল - একমাস তোমরা 
মা ছেলেতে বাসার দিকে  তাকিয়েই কাটালে। 
বলেছিলাম- কী ধৈর্য তোমাদের!
সে তোমার কী রাগ!!যেন দীপক রাগিনী বাজলো।
ষোলকলা তান, সঙ্গে পূর্ণমাত্রার তেহাই।


তোমার ই প্রশ্রয় পেয়ে পথের কুকুর গুলো 
ঘরের হয়ে গেল ক্রমে। খাবার কম পড়লেও 
উঠোন ছাড়ে না ।  বঞ্চিত কন্ঠে আওয়াজ তোলে না। আমাদের কামড়ে খাওয়ার 
ফন্দিও আটে না । শুধু তোমার ভালবাসাই তাদের প্রিয়। কোনও একদিন তুমি কলাবতীর আলাপে  
তিন চারটে কুকুর একমনে বসে আছে। ভঙ্গিটা যেন' হিজ মাস্টার ভয়েস- এর লোগোর সারি।
এই তো সেদিন!কবিতার খাতা হাতে সারারাত্তির আমি নির্ঘুম। তুমিও তো এলোমেলো কাজে জেগে থেকে পরের দিন কম কথা শোনাও নি । 
মাঝে মাঝেই ভাবতাম লেখালেখি  ছেড়েই দেব । 
কদিন পরে দক্ষিণ বারান্দায় অবসর আমার 
নতুন মলাটের একটা পত্রিকা হাতে নিয়ে  বলতে থাকলে ' আহা!কী সুন্দর  লেখা । 
খুব ভাল লিখেছ তুমি । একটা চা বানিয়ে আনি'। তারপর পাশের চেয়ারে বসে সে কত গল্প । 
তারপরেই এবার পুজোয় কী খাবার বানাবে 
তার  তালিকা নিয়ে আরো কিছু সময় । 

ইতিমধ্যে ক্ষয়াটে বিকেল অতল  দিগন্ত বেয়ে নেমে 
আসছে সুদীর্ঘ ছায়ার গভীরে।
গোধূলি আলোয় কপালের বলিরেখায় ডুকরে  উঠছে একটুখানি কোমল আলো। তিল মাত্র পরেই সান্ধ্য আওয়াজ ভেসে আসছে কানের ভেতর দিয়ে। কান থেকে বুকের ভেতর সে বাজিয়ে যাচ্ছে পুরোনো গানের ধ্বনি। 'কুলায়ে যেতে যেতে কে যেন কাকলি'। অন্ধকার আকাশের দিকে তাকিয়ে অন্তরের আলোয় কি দেখছো আমায়! এই সময়- এই সন্ধ্যা অতল ঘুমে ডুবে যাচ্ছে! স্রোতের মুখের সামনে আমরাও।

এ ঘর নিজের নয়! আমারও না। তোমারও না।

ফোটোগ্রাফি- সৈয়দ স্নেহাংশু   

Post a Comment

1 Comments

  1. চোখে একটা আকাশ এঁকেছিলাম,
    ছোট ছোট মেঘ বালিকারা লুকোচুরি খেলছিলো ঈশান কোনে । সাদা বকের দল উড়ে যাচ্ছিলো গেরোস্থলী গোছাতে । একবিন্দু বৃষ্টি গড়িয়ে পরলো শালিকের আস্তানায়।
    তবুও একটা সুনীল আকাশের আশায় এক বুক নিশ্বাস নিই বিশ্বাসের আশ্বাসে ।
    আসাধারন কবি ।

    ReplyDelete