ঘুমিয়ে গেছে গানের পাখি
(পঞ্চদশ পর্ব)
চিত্রা ভট্টাচার্য্য
গীত সংগীতে নজরুল
নজরুল সাগরে অবগাহন করে আঁচল ভরে যতটুকু মণিমুক্তো সংগ্রহ করতে পেরেছি তারমধ্যে খুঁজে পেয়েছি তাঁর অনবদ্য সৃষ্টি রাশিরাশি সুর ও সঙ্গীতের লহরীতে সমৃদ্ধ রত্নমালা রাজী। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের গৌরবান্বিত মহাসভায় যত স্বনাম ধন্য মনীষীজন তাঁদের স্বনামকে অতিক্রম করে স্মরণীয় ও মহিমান্বিত হয়ে আছেন, নজরুল ও তাঁদেরই মধ্যে অন্যতম একজন যাঁর উজ্জ্বল প্রভায় সাহিত্যের মহাসভা আলোকিত হয়ে আছে। প্রাচীন কবি ভারতচন্দ্র যেমন রায়গুণাকর নামে খ্যাত, মুকুন্দরাম যেমন চারণকবি ,পদাবলীকাব্যের চন্ডীদাস যেমন আপন আলোয় উজ্জ্বল ,আধুনিক যুগে বিশ্বকবি বলতে যেমন রবীন্দ্রনাথ ,সাহিত্যসম্রাট নামে খ্যাত, বঙ্কিমচন্দ্র, কথাশিল্পী ঔপন্যাসিক শরৎচন্দ্র, প্রকৃতি প্রেমিক বিভূতি ভূষণ,পল্লীকবি জসিমুদ্দীন-এবং আরও অনেকের সাথে স্মৃতিবিজড়িত নাম যেমন মানসলোকে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে তেমনি সগৌরবে মনে পড়ে যায় 'বিদ্রোহী কবি' নামে খ্যাত কবি কাজী নজরুল ইসলাম'কে। কবির সৃষ্টিকর্ম এবং জীবনাচারের বিচারে 'বিদ্রোহী কবি' অভিধাটি যথেষ্ঠ নয়। নজরুল কে নিয়ে গবেষক রা বলেন ''এই সাড়ম্বরে উচ্চারিত 'বিদ্রোহী কবি' সম্ভাষণের আড়ালে ঢাকা পড়ে গিয়েছে তাঁর অসাধারণ সঙ্গীত প্রতিভা,পরম অসাম্প্রদায়িক মানবহিতৈষী সত্তা, প্রকৃতির পূজারী সর্বাঙ্গসুন্দর এক প্রেমিক কবির পরিচয় ''।
🍂
" কবি নজরুলের লেখা ও সুর করা গানগুলি নজরুলগীতি-- বাংলাদেশ এবং ভারতে ব্যাপক মাত্রায় জনপ্রিয়, বাংলা সংগীতের ইতিহাসে তিনি একমাত্র ব্যাক্তি যিনি প্রায় সব বিষয় নিয়ে অবাধে গান রচনা করেছেন। তার লেখা গানের সংখ্যা আট হাজারের অধিক কিন্তু স্বভাব উদাসীন কবি টুকরো কাগজে এসব গান লিখলেও বাংলা গানের দুর্ভাগ্য তা বেশিরভাগই উপযুক্ত সংরক্ষণের অভাবে চিরতরে হারিয়ে গিয়েছে। অবশেষে তাঁর গানের সংখ্যা চার হাজারের মত পাওয়া গেছে । এই তালিকায় নজরুলগীতির মধ্যে রয়েছে নতুনের গান , বাংলাদেশের জাতীয় পদযাত্রার গান এবং রমজানের এবং রোজার শেষ গান ,বাঙালি মুসলিম দের চাঁদ রাত এবং ঈদ-উল-ফিতরের উৎসবের উপর একটি বাংলা ইসলামী গান। তাঁর গানে বিপ্লবী ধারণার পাশাপাশি আরও আধ্যাত্মিক, দার্শনিক এবং রোমান্টিক বিষয়বস্তু অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। বাংলা সঙ্গীতের প্রায় সবকটি ধারার পরিচর্যা ও পরিপুষ্টি, বাংলা গানকে উত্তর ভারতীয় রাগসঙ্গীতের দৃঢ় ভিত্তির ওপর স্থাপন করেছেন।বাংলা সঙ্গীতের অণুবিশ্ব, তদুপরি উত্তর ভারতীয় রাগসঙ্গীতের বঙ্গীয় সংস্করণ। ইসলামী গজল যেমন তিনি রচনা করেছেন তেমনি লোকসঙ্গীতাশ্রয়ী বাংলা গানকে উপমহাদেশের বৃহত্তর মার্গসঙ্গীতের ঐতিহ্যের সঙ্গে সংযুক্তি নজরুলের মৌলিক সঙ্গীত প্রতিভার পরিচায়ক। তাঁর দেবীকালী মাতা কে নিয়ে রচিত শ্যামা সংগীত আজ ও এই বাংলার ঘরেঘরে বহুল প্রচলিত ও সমাদৃত ।
বাংলা সাহিত্যে নজরুল ''গ্রন্থে লেখক আজাহারউদ্দীন নজরুলগীতি বা নজরুল সঙ্গীতের পর্যালোচনায় বলেছেন ",বাংলাভাষার অন্যতম প্রধান কবি ও সংগীতজ্ঞ কাজী নজরুল ইসলামের লিখিত গান তার সীমিত কর্মজীবনে তিনি ৩২৪৯ টি , এবং এ সকল গানের বড় একটি অংশ তারই সুরারোপিত। তার রচিত চল্ চল্ চল্, ঊর্ধ্বগগনে বাজে মাদল বাংলাদেশের রণসংগীত। তার কিছু গান জীবদ্দশায় গ্রন্থাকারে সংকলিত হয়েছিল যার মধ্যে রয়েছে গানের মালা, গুল বাগিচা, গীতি শতদল, বুলবুল ইত্যাদি। পরবর্তীকালে আরো গান সংগৃহীত হয়েছে। তবে তিনি প্রায়শ তাৎক্ষণিকভাবে লিখতেন; একারণে অনুমান করা হয় প্রয়োজনীয় সংরক্ষণের অভাবে বহু গান হারিয়ে গেছে। তার কিছু কালজয়ী গানগুলো হলো - ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’, ‘চল চল চল’, ‘ত্রিভুবনের প্রিয় মুহাম্মদ’ ইত্যাদি।নজরুল সংগীত বা নজরুলগীতি হলো বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম কর্তৃক রচিত ও সুরারোপিত গান, যার মধ্যে রয়েছে বিপ্লব, প্রেম, আধ্যাত্মিকতা, ও দার্শনিক ভাবধারা এবং যা ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।" নজরুলের গানের কথা ও সুরের মধ্যে রয়েছে এক অফুরন্ত প্রাণশক্তি, যা সংগ্রাম, প্রেম, এবং ভালবাসা সহ বিভিন্ন মানবীয় আবেগ ধারণ করে।
নজরুল জীবনীকার দের মতে ,এখন পর্যন্ত নজরুলের রচিত যত গানের সন্ধান পাওয়া গেছে, তাকে কালানুক্রমে সাজাতে গেলে বড় পরিসরে দুটি ভাগে পাওয়া যায়। ভাগ দুটি হলো-
ক).লেটো পর্ব (১৯১০-১৯১২ খ্রিষ্টাব্দ [১৩১৭-১৩১৯ বঙ্গাব্দ]
খ).লেটোত্তর পর্ব (১৯২০-১৯৪২ খ্রিস্টাব্দ)
''ঘুমিয়ে গেছে গানের পাখি'' এই প্রবন্ধের আলোচনার শুরুতেই কবি জীবনের শৈশবের বর্ণনায় পেয়েছি গ্রামছাড়া সহায় সম্বলহীন এক পল্লী বালকের ছন্নছাড়া জীবনের পরিভ্রমণের রোমহর্ষক কাহিনি। শৈশব-কৈশোরের সন্ধিক্ষণে বর্ধমানের ক্ষুদ্র লোক-নাট্যগীতি লেটো গানের মধ্য দিয়ে কবি চলেছেন-- তাঁর সৃষ্টি-সত্তার আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল। নজরুল জীবনীকারদের মতে সে 'সৃষ্টি সুখের উল্লাস'-হীন অধ্যায়। তারপর তাঁর সৃষ্টির দ্বিতীয় অধ্যায় শুরুহলো.,নজরুলের প্রথম সঙ্গীত সংকলন হিসেবে 'বুলবুল' প্রকাশিত হয়েছিল ১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বর মাসে। নজরুল গবেষক দের মতে এরপর থেকে বিভিন্ন সঙ্গীত সঙ্কলনে, স্বরলিপি গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর বহু গান। এ ছাড়াও পাওয়া গেছে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক অগ্রন্থিত গান। সকল গানের সংকলন নিয়ে প্রামণিক গ্রন্থ হিসেবে নজরুল ইনস্টিটিউট প্রকাশ করেছিল 'নজরুল সঙ্গীত সংগ্রহ'। ২০০৬ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবর মাসে। এর তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি মাসে। অল্পবিস্তর ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও বর্তমানে এই গ্রন্থটিকে নজরুলের গানের একটি আদর্শ সঙ্গীত-সংকলন বলা যায়। সুকুমার শিল্পের যে কোনো বিষয়ের বিকাশের ধারা অনুসৃত হয় কালানুক্রমে। নজরুলের গানের সার্বিক মূল্যায়নে ক্রমিবকাশের ধারাও এর বাইরে নয়।নজরুলের কাছে প্রকৃতি ছিল স্বাধীনতার প্রতীক, যা তাঁর বিদ্রোহী চেতনার সাথেও যুক্ত। বাণী ও সুরের বৈচিত্র্যে নজরুল বাংলা গানকে যথার্থ আধুনিক সঙ্গীতে রূপান্তরিত করেছিলেন।
১৯৩৮ সালে কাজী নজরুল ইসলাম কলকাতা বেতার কেন্দ্রের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্ত হয়েছিলেন । সেখানে তিনটি অনুষ্ঠান যথাক্রমে 'হারামণি', 'নবরাগমালিকা' ও 'গীতিবিচিত্রা'র জন্য তাকে প্রচুর গান লিখতে হতো। 'হারামণি' অনুষ্ঠানটি কলকাতা বেতার কেন্দ্রে প্রতি মাসে একবার করে প্রচারিত হতো যেখানে তিনি অপেক্ষাকৃত কম প্রচলিত ও বিলুপ্তপ্রায় রাগরাগিণী নিয়ে গান পরিবেশন করতেন। উল্লেখ্য, এই অনুষ্ঠানের শুরুতে তিনি কোনো একটি লুপ্তপ্রায় রাগের পরিচিতি দিয়ে সেই রাগের সুরে তার নিজের লেখা নতুন গান পরিবেশন করতেন। এই কাজ করতে গিয়েকবি নবাব আলী চৌধুরীর রচনায় 'ম আরিফুন নাগমাত' ও ফার্সি ভাষায় রচিত আমীর খসরুর বিভিন্ন বই পড়তেন এবং সেগুলোর সহায়তা নিয়ে বিভিন্ন ধরনের রাগ আয়ত্ব করতেন। এসব হারানো রাগের ওপর তিনি চল্লিশটিরও বেশি গান রচনা করেছিলেন।
রোমান্টিক কবিদের মতো,মানবিক অনুভূতির প্রকাশে নজরুলও তাঁর প্রেম, আনন্দ, ও বেদনায় প্রকৃতির অনুষঙ্গ ব্যবহার করেছেন। প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে কবি নিজের বেদনাকে বিশ্বজনীন করে তুলেছেন, যেমনটা তাঁর গানেও দেখা যায়। জন্মভূমির প্রতি এক বুক ভরা ভালোবাসায় গভীর অনুরাগ ভক্তি ও শ্রদ্ধা সঞ্চারিত এই ধারার গানের মূল প্রেরণার উৎস। এই ধরনের প্রকৃতি প্রেম নজরুলের রচনাকে আরও সমৃদ্ধ করেছে এবং তাঁর সংগীতে এক নতুন গভীরতা যোগ করেছে।স্বদেশ বন্দনার কিছু গানে তিনি স্বদেশ মাতার অপরূপ রূপেরও বর্ণনা করেছেন। বাংলা মায়ের অপরূপ রূপের কবি যে সকল দেশবন্দনার গান রচনা করেছেন তা অত্যন্ত সফল এবং সর্বজনপ্রিয়। ঋতু বৈচিত্রে মাতৃভূমি বাংলার রূপের পরিবর্তন অনবদ্য ভাষায় সুরে সংগীতে মোহনীয় তাঁর বিশ্লেষণ। অফুরন্ত প্রাণশক্তি, যা সংগ্রাম, প্রেম, এবং ভালবাসা সহ বিভিন্ন মানবীয় আবেগ ধারণ করে।
শিয়রে গিরি-রাজ হিমালয় প্রহরী,
আশিস-মেঘ বারিসদা তার পড়ে ঝরি,
যেন উমার চেয়ে এ আদরিণী মেয়ে,
ওড়ে আকাশ ছেয়ে মেঘ-চিকুর॥
গ্রীষ্মে নাচে বামা কাল-বোশেখি ঝড়ে,
সহসা বরষাতে কাঁদিয়া ভেঙে পড়ে,
শরতে হেসে চলে শেফালিকা-তলে
গাহিয়া আগমনি- গীতি বিধুর॥
সুজলা, সুফলা, শস্য শ্যামলা কবির জন্মভূমি বাংলাদেশ , কবি মানসে মাতৃসমা। বাংলার প্রকৃতি নানা রূপে নানা ভাবে কাব্য সংগীতের অপূর্ব মূর্ছনার মাধ্যমে প্রতিটি ছত্রে ফুটে উঠেছে। কবির চোখে তাঁর মা শ্যামল বরণী। কখনো বাংলা মা তাঁর কাছে ‘কালো ভীরু মেয়ে ’ কখনো তাঁর কাছে সে বৈরাগিণী। সেই ভীরু মেয়েটি ই আবার কখনও কবির গানে দুরন্ত, উচ্ছল ‘ডাকাত মেয়ে’ হয়ে ওঠে। ঝড়ের সঙ্গে, বেদের সাপ খেলানোর তালে সে নেচে ওঠে। নদীর স্রোতে যে নুড়ি-পাথর ঠোক্কর খেতে খেতে গড়িয়ে চলে, সেই শব্দকেই কবি বাংলা মায়ের হাতের কাঁকন-চুড়ির শব্দের সঙ্গে তুলনা করেছেন। এই বাংলা মায়ের কপালে ফুটে ওঠে সন্ধ্যাতারার টিপ, কখনও সবুজ শস্যখেতে মায়ের আঁচল লুটায়। কখনও আবার মায়ের পায়ের নূপুরের শব্দ কবি শুনতে পান ঝিল্লির শব্দরূপে। সেই মা ভোরবেলায় দূরের কোনো নদীতে জল ভরতে যান। কখনও ভাটিয়ালি, কখনও বাউল গানে মাতোয়ারা হতে দেখা যায় বাংলা মাকে। আবার কখনও প্রিয়জনকে হারিয়ে শ্মশানঘাটে তাঁর চোখ বেয়ে নামে বিদায়ী ব্যথার অশ্রুধারা।
প্রকৃতি বন্দনায় নিমগ্ন কবি শ্যামলা মায়ের গুণকীর্তন করেছেন নানা মহিমায়। স্বদেশের গান যেখানে অত্যন্ত সুন্দর ও নিখুঁতভাবে গ্রামবাংলার রূপের বর্ণনা করেছেন। বঙ্গভূমির অপূর্বরূপের মহিমাটি কবি অত্যন্ত নিপুণতার সাথে সফলভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। খেতের বাঁকেবাঁকে হেঁটে চলার অত্যন্ত মনোরম ছন্দ। কালো দীঘির পদ্মফুলের শোভা থেকে শুরু করে ঝড়ের রাতে সাপের নাচন, নদীর স্রোতে নুড়ী পাথরের নড়াচড়ার শব্দকেও কবি সুরে সংগীতের মূর্ছনায় রূপ দিয়েছেন । এমন নিখুঁত বর্ণনা স্বদেশপর্বের খুব কম গানেই দেখা যায়।
“শ্যামলা বরণ বাংলা মায়ের
রূপ দেখে যা আয়রে আয়।
গিরি-দরী-বনে-মাঠে-প্রান্তরে রূপ ছাপিয়ে যায় ॥
বাংলার প্রকৃত সৌন্দর্য এর পল্লী গ্রাম তার ঐতিহ্য লোক গানের সুর ভাটিয়ালি-বাউলের কথা উল্লেখ করে কবি স্বাক্ষর রেখেছেন যে সংস্কৃতির প্রতিটি ধারাতেই এই বাংলা পরিপূর্ণ। এমনই আরো একটি গানের উদাহরণ পাই একি অপরূর রূপে মা তোমায়’ গানটিতে। এখানেও ফুল, ফসল, কাদা-মাটি জল সকল কিছুর অপার লাবণ্যকে ফুটিয়ে তুলেছেন তাঁর গীতিতে । এমন কি ঋতুর সাথে তাল মিলিয়ে বাংলার প্রাকৃতিক পরিবর্তন ও কবির দৃষ্টি এড়ায় নি। বৈশাখের প্রখরতায় আম-কাঁঠালের সুঘ্রাণ শেষ না হতেই বর্ষার কেতকী- -কদম- যুথিকার গন্ধে হৃদয় আকুল করে। বাংলার প্রকৃতিতে ঋতুগুলো যেন হাত ধরাধরি করে চলে। অঘ্রাণে আমন ধানের গন্ধে কৃষাণ-কৃষাণীর মুখের হাসি ফুটে ওঠে, শরতের আগমনী বার্তার আবেশ শেষ না হতেই। হাসি-আনন্দে যেন এখানে আপন সহোদরা সহদরের মত হাত ধরে নৃত্যের তালেতালে মগ্ন হয়ে ঘুরে বেড়ায় বর্ষা থেকে বসন্তে। তাদের যে পথ চলাতেই আনন্দ।
সারি-ভাটিয়ালি গানে শীতের রাতে কীর্তনের আসরে বাংলা মায়ের কাছে, ঈশ্বরের কাছে, কৃতজ্ঞতায় চোখের কোণে জল জমে। সেই অশ্রু দু’হাত দিয়ে পৃথিবীকে রঙিন করে তোলে, বসন্তের নানা রঙের ফুলের বাহার। বাংলার মাটিকে কবি সোনার চেয়েও খাঁটি বলেছেন। কারণ এই মাটিতে ধন্য হতে কতো জ্ঞানীগুণি জন ভিড় জমায়। এই দেশের সংগ্রামের ইতিহাস, এর প্রকৃতির সৌন্দর্যতা রক্ষায় এর সন্তানের অবদান অনন্য স্মরণযোগ্য উদাহরণ। এই দেশের প্রকৃতির, মাটির গন্ধে যে সুখ তা অর্থবৈভব-বিত্তে নেই। কবি তাই দেশবন্দনার গানে স্বদেশের চেতনাকে ত্বরান্বিত করতে রচনা করেছেন এ ধারার কয়েকটি গান—
. “আমার দেশের মাটি ও ভাই খাঁটি সোনার চেয়েও খাঁটি। /এই দেশেরই মাটি জলে, এই দেশেরই ফুলে ফলে,
তৃষ্ণা মিটাই, মিটাই ক্ষুধা পিয়ে এরি দুধের বাটি।
অথবা লিখলেন -- “এই ভারতে নাই যাহা তা’ ভূ-ভারতে নাই।মানুষ যাহা চায় স্বর্গে গিয়ে, আমরা হেথায় পাই" ॥
কবি নজরুল দেশচেতনার এই সকল গানের ভিতর দিয়ে স্বদেশের প্রকৃতির রূপের বর্ণনার সাথে এর মানুষ কি করে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে তাও ব্যক্ত করেছেন। বাংলার মানুষ সহজ সরল হৃদয়ের অধিকারী, ঠিক এক সবুজের গভীরতার মতো এদের দেহ-ভালোবাসার রূপটি। মাঠে-ঘাটে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার পূর্ণ করা খুশি এখানে নিত্য শাস্তির পরশে সাধারণ মানুষের ঘরে স্বর্গ খেলা করে। এই জাতি যেমন কোমল তেমনি সাহসী।
তথ্য সূত্র :---
১. কাজী নজরুল ইসলাম ও বাংলা সাহিত্য। আজিবুল হক। লেখা প্রকাশনী, কলকাতা।
.২) কাজী নজরুল। প্রাণতোষ ভট্টাচার্য। ন্যাশনাল বুক এজেন্সী প্রাইভেট লিমিটেড।
৩). কাজী নজরুল ইসলাম। বসুধা চক্রবর্তী। ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট ইন্ডিয়া।
৪). নজরুল জীবনী। অরুণকুমার বসু। পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি। জানুয়ারি ২০০০।
৫). নজরুল-জীবনী। রফিকুল ইসলাম। নজরুল ইন্সটিটউট, ঢাকা। ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দ।
৬). নজরুল রচনা সম্ভার। আব্দুল কাদির সম্পাদিত। ইউনিভার্সল বুক ডিপো। কলিকাতা।
0 Comments