জ্বলদর্চি

হাড়জোড়া/ভাস্করব্রত পতি

বাংলার ঘাস পাতা ফুল ফল, পর্ব -- ৮৯
হাড়জোড়া

ভাস্করব্রত পতি

মহাভারতের বনপর্বের ১০০ তম অধ্যায়ে একটি কাহিনি রয়েছে। সেখানে কোনও এক সময়ে দেবতারা খুব লাঞ্ছিত হতেন বিভিন্ন অসুর দানবদের হাতে। তাঁদের নাম 'কালকেয়'। এঁদের নেতা ছিলেন বৃত্তাসুর। শ্লোকে পাই --
"কালকেয়া ইতি খ্যাতা গণাঃ পরম দারুণাঃ। তে তু বৃত্রং সমাশ্রিত্য নানা প্রহরণোদ্যতাঃ।।"
অসুরদের তাণ্ডবে দেবতাদের তখন  লবেজান অবস্থা। কিছুতেই বাগে আনতে পারা যাচ্ছিলনা অসুরদের। এমতাবস্থায় দেবতারা সমবেত হয়ে প্রজাপতি ব্রহ্মার কাছে আকুল প্রার্থনা করলেন সমস্যার সমাধানের জন্য। ব্রহ্মা জানালেন যে, কালকেয়দের বদলে তাঁদের নেতা বৃত্তাসুরকে বধ করলে তবেই রেহাই মিলবে। 

কিন্তু বৃত্তাসুরকে বধ করা খুব একটা সহজ কাজ নয়। দেবতাদের পক্ষে সাধারণ অস্ত্র দিয়ে তাঁকে বধ করা অসম্ভব কাজ। তখন ব্রহ্মা তাঁদের জানান, সরস্বতী নদীর তীরে অথর্বাপুত্র অটবীর্য' পুরুষ দধীচি বসবাস করেন। যাঁর মায়ের নাম চিত্তি। সেই দধীচি যদি স্বেচ্ছায় দেহত্যাগ করে, তবে তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর দেহের হাড় দিয়ে বজ্রশক্তির অস্ত্র তৈরি করা যাবে। সেই অস্ত্রের ঘায়ে বৃত্তাসুরকে হত্যা করা সম্ভব। 

ব্রহ্মার পরামর্শমতো দেবতারা দধীচি মুনির কাছে গিয়ে সব ব্যক্ত করলেন। দেবতাদের স্বার্থে তিনি রাজি হলেন দেহত্যাগ করতে। 
"ততো দধীচিঃ পরম প্রতীতঃ সুরোত্তমান্ স্বানিদমভ্যুবাচ। 
করোমি যদ্রোহিতমদ্য দেবাঃ স্বঞ্চাপি দেহং স্বয়ংমুৎসূজামি।"
দধীচি প্রাণত্যাগ করলেন স্বেচ্ছায়। তারপর দধীচির দেহের হাড় জুড়ে জুড়ে তৈরি হল বজ্রশক্তির অস্ত্র। সেই 'অস্থিসংহার' অস্ত্র দিয়ে দেবতারা বধ করলেন বৃত্তাসুরকে। 
"অস্থিসংহার বজ্রেণ বৃত্রাসুরো নিপাতিতঃ।”
মহাভারতে উল্লিখিত এই 'অস্থিসংহারে'র অর্থ হল 'অস্থিভিঃ সংহার'। তথা অস্থিগুলির দ্বারা সংহার। আবার ভেষজ উদ্ভিদ হাড়জোড়াকেও বলা হয় 'অস্থিসংহার'। এর অর্থ 'অস্থীনি সংহরতি = যোজয়তি'। অর্থাৎ যে ভেষজে অস্থিগুলি সংযুক্ত হয়। এই গাছটির অবয়ব দেখলে মনে হবে পরপর কয়েকটি হাড় মনে হয় জুড়ে জুড়ে তৈরি করা হয়েছে। যেন ঠিক দধীচির হাড় জুড়ে জুড়ে তৈরি করা হয়েছে হাড়জোড়া গাছের কাণ্ড। তাছাড়া মানুষের দেহের হাড় ভেঙ্গে গেলেও তা জোড়া লাগাতে ভেষজকাররা এই গাছ ব্যবহার করেন। তাই নামের মধ্যে কি অদ্ভুত মিল নজরে পড়ে এক্ষেত্রে। 

হাড়জোড়াকে সংস্কৃতে গ্রন্থিমান, অস্থিভঙ্গী, বজ্রবল্লী, গুজরাটিতে তরধারী, মারাঠিতে ত্রিধারী, ওড়িয়াতে হড়েজাচড়, পাবোরি, তেলুগুতে নল্লেড়ু, হিন্দিতে হড়সঙ্কারী, হযোড় বলে। একে অস্থিসংহার, বজ্রাঙ্গী, গ্রন্থিমান, অস্থিশৃঙ্খলাও বলা হয়ে থাকে। একে হাড়ভাঙা লতা বা হারেঙ্গাও বলে। 

হাড়জোড়ার বিজ্ঞানসম্মত নাম Cissus quadrangularis। যা Vitaceae পরিবারের অন্তর্গত। এর অন্যান্য কিছু প্রজাতি হল --
Vitis quadrangularis
Cissus quadrangula 
Cissus bifida 
Cissus edulis 
Cissus fischeri 
Cissus succulenta 
Vitis succulenta 
Cissus tetragona 
Cissus tetraptera 
Cissus triandra 

হাড়জোড়া গাছে শিকলের মতো গঠন দেখা যায়। লম্বায় ১.৫ মিটার বা ৪.৯ ফুট হয়। এদের চারকোনা কাণ্ডগুলি (ডাঁটা) চারপর্বযুক্ত এবং বেশ রসাল। এই ডাঁটার (কাণ্ড) একটি পর্ব কেটে মাটিতে বসিয়ে দিলেই আবার নতুন গাছ বেরিয়ে আসে। তাই এর নাম 'কাণ্ডবল্লী'। গ্রন্থিতে আকর্ষ এবং পাতা জন্মায়। এদের পাতা এক পাশে জন্মায়। শিকড় অন্যদিকে। লতিয়ে চলে। বেশ লম্বা। অনেকদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। মাঝে মাঝে পত্রহীন দেখায়। হৃদয়াকার পাতাগুলি ১-১.৫ ইঞ্চি লম্বা। পাতার কিনারা করাতের মত দেখতে। কাণ্ডের বোঁটায় সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম রোমশ ফুল ফোটে। এদের ফুলে পুংকেশরচক্র রয়েছে চারটি। সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর মাসের মধ্যে ফুল ফোটে। একবীজপত্রী গোলাকার ফলগুলি পেকে গেলে লাল হয়ে যায়। যা অনেকটা রসাল মটরের মত। গেরস্থের বাড়ির প্রাচিরে, দেওয়ালে, পার্কের মধ্যে জন্মায়। খুব সুন্দর দৃশ্য তৈরি করে বেড়ার গাছ হিসেবে। শোভাবর্ধক গাছ। 

একাদশ শতকের কবি চক্রপাণি দত্ত তাঁর লেখা 'চক্রদত্ত' বইতে অস্থিভগ্নের চিকিৎসায় দুবার এবং গলার রোগের চিকিৎসায় একবার এই হাড়জোড়া গাছের উপকারিতার কথা উল্লেখ করেছেন। এখানে পরিস্কারভাবে উল্লেখ করা হয়েছে কোনওভাবে দেহের সন্ধিস্থলের হাড় ভেঙ্গে গেলে এই অস্থিসংহার গাছের রসের সাথে দুধ এবং ঘি মিশিয়ে খেলে উপশম হবে। আর যদি দেহের হাড় ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যায় সেক্ষেত্রে এই অস্থিসংহার গাছের রস এবং লাক্ষা একসাথে বেটে গুগগুল মিশিয়ে সহ্যমতো গরম করে তা দিয়ে প্রলেপ দিয়ে বেঁধে রাখতে হবে ('সভন্ন যুক্তাস্থি রুজং নিহন্যাদ')। এরফলে যাবতীয় যন্ত্রনা তো দূরে পালাবেই আর ভাঙা হাড়ও জুড়ে যাবে অচিরেই। এখানে আরও উল্লেখ রয়েছে যে, এটি নড়তে থাকা দাঁতকে স্থায়ী করে তাই এর আরেক নাম 'বজ্রবল্লী' বা 'বজ্রাঙ্গী'। এই বজ্রবল্লীর রস তেল দিয়ে ফুটিয়ে মুখের মধ্যে রাখলে নড়তে থাকা দাঁত ফের শক্ত হয়ে বসে যাবে। 

এটির পাতা খেলে খিদে বাড়ে। হাঁপানির উপশমে এর কাণ্ডের রস কার্যকরী। দেহের পুরোনো দূষিত ক্ষত নিরাময়ে উপকারী। দাঁতের নানা রোগ সহ অনিয়মিত ঋতুস্রাব বন্ধ করতে কাজে লাগে। গ্যাসট্রিক আলসার নিরাময়েও এই গাছ উপকারী। স্বাদে তেতো হলেও এটি বলকারক, ক্রিমিনাশক, ক্ষুধাবর্ধক, বাতপ্রশমক এবং বেদনানাশক হিসেবে পরিচিত। এটি অগ্নিমান্দ্য, কৃশতা, অনিয়মিত ঋতুস্রাব, অম্লপিত্ত রোগ, কৃমির উপদ্রব, বাত বেদনা, কানের পুঁজ, শ্বাসরোগ ইত্যাদি রোগেরও উপশমকারী গাছ। এই গাছের নরম কাণ্ড সবজি হিসেবে খায় কোথাও কোথাও। আধুনিক কবিতাতেও পাই  এই হাড়জোড়ার অস্তিত্ব পাই... 
'হাড়ভাঙা মানুষের মতো গড়াতে থাকে 
পুরোনো দুটি সাইকেল 
হাড়জোড়া গাছে ঝুলে যেমন আমাদের হৃদয় 
গভীর মাঠের ভেতর ভালুর ডুঙরি ,
সূর্যের লাল আলো যেন অসম্ভব রকমের এক কারুকাজ'।  
     --- উজ্জ্বলের গ্রাম, পল্লব গোস্বামী
🍂

Post a Comment

0 Comments