জ্বলদর্চি

পড়শি/ প্রতিমা রায়

ফোটোগ্রাফি- সৈয়দ স্নেহাংশু   

পড়শি 


প্র তি মা  রা য় 

তিন কাঠা  জমির উপর পুরানো  দোতলা  বাড়িটা জলের দামে পেয়ে আমরা উঠে এলাম শ্যামনগরে । মেন রাস্তা থেকে একটু ভেতরের দিকে বলে এখানে শহরের কোলাহল তেমন নেই, রাস্তা ঘাটে মানুষের ভীড় ও কম । বেশ শান্ত পরিবেশ। বাড়িগুলোও গা ঘেঁষাঘেঁষি করে নেই ।  বাড়ির পূর্বদিকে ফাঁকা মাঠ আর একতলার গেটের মুখে দাঁড়িয়ে থাকা গোটা ছয় সুপুরি গাছ সেই নির্জনতাকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে । দোতলার বিশাল লনের মত ব্যালকনি পূর্বদিকে হয়ায় রোদ আর হাওয়ার দাপাদাপি উপভোগ করার মতো । কিন্তু আমার আবার নির্জনতা ভালো লাগে না। নির্জনতায় নিজেকে বড় একলা মনে হয় । তখন  নিজের ভেতর কুঁয়ো খুঁড়তে ইচ্ছে করে । রৌণক অবশ্য মাঝে মাঝে অফিস থেকে ফোন করে বলে— দুপুরে একটু ঘুমিয়ে নিতে তো পারো । আমার ঘুম আসে না । তখন আমার ভেতরের কুঁয়ো জলে পা ডুবিয়ে বসি, ডুবন্ত জলে কত কিছু ভেসে ওঠে,কত কিছু ভাসিয়ে দিই, নয়তো ব্যালকনিতে এসে মাঠের দিকে মুখ করে দাঁড়ায় । মাঠের পাশে পুকুরে দু একজন স্নান করে কখনও কখনও । তারপর খাঁ খাঁ মাঠ,শূন্য পুকুর আর নিঃসঙ্গ রোদ্দুর কেবল লুটোপুটি খায়, আমি হাঁ করে গিলি সেসব কখনও একতলায় নেমে এসে বাগানে বসি, গুনগুন গান করা ভ্রমরের মতো । তখন পাশাপাশি পড়শিদের সঙ্গে টুকটাক কথা হয় এই যা ।
প্রশ্নটা ঠিক এভাবেই এলো --এই, তোমরা  নতুন এসেছো  , কবে এলে ?   পিছনে ঘুরতেই দেখি  ব্যালকনির সোজা পশ্চিমদিকে  এতদিন বন্ধ থাকা জানলাটা খোলা  । সেখানে হাসি মুখে তিনি  দাঁড়িয়ে । ভোরের প্রথম আলোর মত গায়ের রঙ, চেহারায় স্নেহ মাখানো ভাবটা বেশ স্পষ্ট । আর কিছু চোখে পড়েনি, প্রথম দর্শনে সব কিছু চোখে পড়ার কথা ও নয়।
হাঁ নতুন । মাস খানেক হবে ।
ও । তিনি মাথা নাড়লেন । জানো আমি তিন মাস দিল্লিতে মেয়ের কাছে ছিলাম, একমাত্র সন্তান তো , কাল এসেছি তাই আলাপ হয়নি । আমরা তিন পুরুষ এখানে আছি । এটা বনেদী পাড়া । এখানে সবাই সবার বিপদে পাশে দাঁড়ায় ।
 বুঝলাম কথা বলতে ভালোবাসেন আর বেশ মিশুকে মানুষ ।
তোমার থেকে আমি বয়েসে  অনেক বড়,আমাকে তুমি  রমা আন্টি বলতে পারো । 
সেই প্রথম নাম জানলাম রমা । শরৎচন্দ্রের উপন্যাসের নায়িকার মতো বেশ স্নিগ্ধশীলা মনে হল। এরপর পশ্চিমের জানলা খোলাই থাকত। ওটা ওনার রান্নাঘর। জানলার গরাদ বেয়ে করিডর বেডরুম ঠাকুরঘর দেখা যেত । অসমবয়সী হলেও ঘন্টার পর ঘন্টা এটা ওটা বেশ একজন কথা বলার মানুষ পেয়ে ভালো লাগলো । রৌনক হেসে বলল—জায়গাটা ভালো না,বড় নির্জন, গ্রাম গ্রাম, মানুষগুলো ও কেমন কেমন কোথায় তোমার বাপের বাড়ি বিধাননগর আর কোথায় শ্যামনগর বলে আমার কানের কাছে আর ঘ্যানঘেন করো না । 
 আস্তে আস্তে সত্যি সয়ে এল সব কিছু ।   
ওনার রান্নাঘরের জানালা থেকে আমাদের ব্যালকনির দূরত্ব হাত তিনেকের বেশি নয় । উনি রান্না করতে ভালো বাসতেন আর সেই সঙ্গে বোধহয় খাওয়াতেও । একটা ডান্ডার মাথায় ছোট ব্যাগের ভেতর টিফিন বক্সে খাবার দিয়ে ডান্ডাটা আমার ব্যালকনিতে বাড়িয়ে দিলেন – নাও তো একটু কষা মাংস করেছি, দেখতো খেয়ে ।
আমার নিতে ইচ্ছে করছিল না ,কিন্তু সেই স্নেহশীলাকে নাও বলতে পারলাম না। টিফিনটা নিয়ে নিজের রান্নাঘরে এসে দেখি -এক মস্তবড় নধর মা ষষ্ঠীর বাহন কিচেনে রাখা খাবার খেয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে । রাগে গা হাত জ্বলতে লাগল – পিছু পিছু ধাওয়া করলাম ।
নীচে এসে বাগান থেকে এক টুকরো ইঁট তুলে ছুঁড়লাম, ম্যাও আওয়াজ করে সে ততক্ষণে  পগার পার। পাশের পড়শি যেন এই অপেক্ষাতেই ছিলেন । দরজা খুলে আমার গেটের কাছে এসে বললেন – আপনার ও কিচেনে ঢুকেছিল বুঝি ? সব কিছুতে মুখ  দিয়েছে ? এই তো শুরু । এরপর দেখবেন  কী জ্বালাতন । আপনার পশ্চিম দিকের পড়শি এতদিন ছিলেন না, এ উৎপাত ছিল না ,এখন এসেছেন সঙ্গে সঙ্গে শুরু ।
মানে। 
মানে আর কী । উনি গোটা দশেক বেড়াল আর কুকুর পুষেছেন। তা পুষতেই পারেন । কিন্তু তারা যে পাড়াতে যখন তখন এর ওর ঘরে ঢুকছে খাবার দাবারে মুখ দিচ্ছে পাড়া নোংরা করছে সে খেয়াল তো ওনার নেই।
 সেদিন দুপুরে ছাদে গেলাম । ছাদ থেকে দেখলাম -- রমা আন্টি এক তলার বারান্দায় রোয়াকে বসে কোলে নিয়ে গোটা দু তিন বেড়ালছানাকে পরম মমতায় খাওয়াচ্ছেন, পাশে আরও গোটা কতক , একটু দূরে খাচ্ছে বেশ কতকগুলো স্ট্রিট  ডগ। কুকুরগুলো নিজেদের মধ্যে খাবার কাড়াকাড়ি করতেই আন্টি ধমক দিলেন ,ওরাও শান্ত হয় গেল । ওদের মাঝে আন্টি যেন মা অন্নপূর্ণা । বুঝলাম পড়শি ভুল বলেননি।
আমি দূর থেকে কুকুর বেড়াল পছন্দ করলেও বাড়িতে নৈব নৈব চ । বিশেষ করে বেড়ালের লোমে আমার খুব ভয়। নতুন পাড়ায় এসেছি, কোন ব্যাপারে ঝামেলা চাই না, তাই পরের দিন রৌণক মিস্ত্রি ডেকে আনল। সব গেটের নীচের দিক অ্যালুমিনিয়ামের শীট দিয়ে মোড়া হল , জানলায় নেট বসল , বাইরে বেরোনোর সময় ছাড়া প্রাচীরের গেটে তালা খুলত না। তবু প্রাচীর টপকে, কার্নিস বেয়ে মাঝেই মাঝেই ঘরের মধ্যে চলে আসত-আওয়াজ -ম্যাও । দু’একদিন ছাড়া ছাড়া শোনা যেত আজ এর বাড়িতে কাল ওর বাড়িতে মার্জারবাহিনীর তাণ্ডব, নয়তো সারমেয় বাহিনীর দাপাদাপি । এই নিয়ে পাড়াতে একটা চাপা সমস্যা।  আড়ালে আন্টিদের বাড়িটাকে সবাই ডাকে --পশ্বশালা বলে, অনেকে আবার আন্টির বাড়িকে বেশ এড়িয়ে যেত।
কথার ফাঁকে এ নিয়ে আন্টিকে একদিন সরাসরি নালিশ জানিয়ে বসলাম ।  রমা আন্টি  একটু থমকে গেলেও বিরক্ত হলেন না , বললেন—ওরা আমার পোষা নয়, রাস্তার বেড়াল কুকুর, আমি কেবল দুটো খেতে দিই । অবলা নিরীহ জীব তো।
আমার ভেতরের ঝগড়ুটে সত্তাটা বেরিয়ে এলো --তা বলে ওদের আস্কারা দেবেন । খেতে না পেলে ওরা অন্য কোথাও চলে যেত। 
আন্টি হাঁসলেন, হঠাৎ উজ্জ্বল সাদা মেঘের উপর এক টুকরো কালো মেঘ এসে যাওয়ার মত একটা মলিন হাসি। কোথাও তো ওদের ঠাঁই নেই , কিন্তু ভারী অদ্ভুত দেখ ওরা আমাদের উপরেই নির্ভর করে বাঁচে । একদিন মর্নিওয়াক থেকে ফেরার পথে দেখি ড্রেনের ধারে প্রায় মৃতবৎ একটা ছোট বেড়ালছানা, সারা শরীরে মারের দাগগুলো তখনও তাজা । কোন একজন মানুষ  আধমারা করে ফেলে গেছে, তাও পরম বিশ্বাসে আমি মানুষ দেখেও মুখ তুলে তাকিয়ে , বসে যাওয়া গলায় ডাকে ম্যা—ওঁ—ওঁ,,,।, আমায় বাঁচাও ।
ছানাটাকে বাড়িতে নিয়ে এলাম । বেশ কিছুদিনের যত্নে সুস্থ হয়ে উঠল, ভাবলাম পশু তো এবার চলে যাবে । ঠিক উল্টো হল--সারাক্ষণ আমার পাশে পাশে সকালে ঘুম থেকে উঠে ,দুপুরের নির্জনতায় রাতে বিছানায় যাবার আগে – ম্যাও । কেমন মায়া পড়ে গেল। দেখলাম মায়ার বাঁধন মানুষের চেয়ে পশুদের কম নয় । তখন থেকেই ।
আন্টির কথা আমার পছন্দ হলো না , আবার রাগও হলো না । আমি এই নিয়ে আর কোন কথাও বাড়ালেম না। ব্যাপারটা ইগনোর করে গেলাম ।
 মাঘমাসের শেষ । পাড়ার অশোক স্যান্যালের ছেলের বিয়ে ।  বিয়েতে সারা পাড়া নিমন্ত্রিত । সামনের ফাঁকা মাঠটাতে ডেকরেশনের লোকজন প্যান্ডেল খাটিয়ে ফুল আলো দিয়ে কী সুন্দর করে সাজিয়েছে । মাংস মিষ্টির গন্ধে বিয়েবাড়ি ম্ ম করছে । আর সে গন্ধে বিনা নিমন্ত্রণে নিজেদের পাড়ার সঙ্গে জুটল কিছু বেপাড়ার কুকুর বেড়াল । খাবার নিয়ে, বেপাড়ায় ঢোকা নিয়ে প্যান্ডেলের বাইরে ঘেউঘেউ ঘ্যাঁক এএ নাগাড়ে চলল ওদের  কনসার্ট । কনেপক্ষের কেউ একজন খেতে বসে ফুট কাটলে—এ তো বিড়াল কুকুরের পাড়া মনে হচ্ছে । ব্যাস ,যেন আগুনে ঘি পড়ল । পাড়ার বদনাম নতুন অতিথিদের মুখে পাড়ার ছেলেপেলে ক্লাবের ছেলেদের সম্মানে লাগল। বিয়েবাড়ি চুকেবুকে যাওয়ার পর চাপা সমস্যা জরুরি সমস্যা হয়ে সামনে এসে দাঁড়াল।
অতীতে বস্তায় ভরে কুকুর বা বেড়াল ছানাদের অনেক দূরের রাস্তায় ছেড়ে দিয়ে এসে কোন সুরাহা হয়নি, তারা রাস্তা চিনে আবার পাড়ায় ফিরে এসেছে,পাড়ার মাতব্বর হরেন মল্লিক জানালো। একযোগে সবাই তাই এবার একটা পাকাপাকি বন্দোবস্ত করতে মরিয়া। মরিয়া কী আর – একদিকে নিরীহ কতগুলো পশু ও অন্যদিকে বেশ শক্তিধর কতজন মানুষ । আমিই আইডিয়া দিলাম—আপনারা এখানকার পৌরসভাকে জানান। পাড়ার অবাঞ্ছিত বিড়াল কুকুরদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিক । 
দাওয়াইটাতে কাজ হল। দরখাস্ত ভরা খাম পৌরসভার অফিসে পৌঁছে গেল। কয়েকদিন পর পৌরসভার গাড়িতে চেপে চলে গেল সারমেয় এবং মার্জার বাহিনী।
এখন পাড়া আগের চেয়েও নির্জন । সময়ের বয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোন শব্দ নেই । শুধু পশ্চিম দিকের রমা আন্টির জানলাটা আর খোলা নেই । ভাবি আজ না হয় কাল খুলবে। না ,অনুমান মিথ্যে হয়ে ফিরে আসে। আর থাকতে না পেরে ছাদে উঠে দেখতে গেলাম দিনের আলোয় বন্ধ দরজার ওপারে খাঁ খাঁ উঠোন ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ল না। রাতে আবার গেলাম।  সিঁড়ি ঘরের  দেয়াল  ধরে দাঁড়িয়ে দেখছি , বিশ্ব চরাচর  চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে , দুধ সাদা জোছনায় প্রকৃতি নিজের ঘর সাজাতে ব্যস্ত । শুধু  রমা আন্টির কিচেনের  বন্ধ জানলা বেয়ে করিডরের দিকটা একটা বিশাল টর্নেডোর  মত জমাট  অন্ধকার , অন্ধকারের শেযপ্রান্তে  ভয়ংকর গভীর একটা কুঁয়ো।  আমার  ভেতরের কুঁয়োর চেয়ে ও  তা  গভীর। স্পষ্ট দেখতে পেলাম সেই  নিঃসঙ্গ  নির্জন  কুঁয়োয় পা  ডুবিয়ে  বসে আছে রমা আন্টি  , ভয়ে চোখ বন্ধ  হয়ে গেল।।

Post a Comment

4 Comments

  1. খুব ভাল লাগল,
    আমাদের সঙ্গে গল্পটার
    মিল আছে।

    ReplyDelete