জ্বলদর্চি

সেমিকোলনের আত্মজীবনী - ৬


আমাদের ভালোবাসার কোনো রাজনীতি হয় না 

 সা য় ন

ওনারা দুজনেই সিটি কলেজে পড়ান। একজন নিউ ইয়র্ক একজন আমহার্স্টস্ট্রিট। দুজনেই জাতীয়তাবাদকে ঘৃণা করেন, দুজনেই দৃপ্ত কন্ঠে উচ্চারণ করেন মানুষকে বাঁচানোর  রাজনীতিটা দুজনেই বাঁচার জন্য ইতিহাস বই খোলেন - একজন ইতিহাস শেখান দর্শনের ভিতরে একজন দর্শনের মধ্যে দিয়ে শেখান ইতিহাস। একজন কবি- সুবোধ সরকার, একজন ঐতিহাসিক হানস্ কোহন। নিউইয়র্ক আর আমহার্স্টস্ট্রিট দুই সিটি কলেজের তলা দিয়ে একটা টানেল চলে গেছে যেখানে পড়ে আছে অনেক নোংরা কাঁথার চিৎকার, লুকিয়ে পরা মার্কিন প্রেসিডেন্টের টুপি, সেখানে বাংলার হিপোক্রেসি গড়াগড়ি খায় এখানে ওখানে। কোহন রাষ্ট্রিয় ভণ্ডামির রূপ নগ্ন করে ভাষায় আঁকছেন " It asserts that the nation- state is the ideal and the only legitimate form of political organization and that the nationality is the source of all cultural/creative energy and of economic well-being. " সুবোধ ছবিটা ভাষায় লিখছে - " বাবা আদি কম্যুনিস্ট, সে যুগের লোক / ছেলে এ যুগের ছেলে এবং বি. জে. পি / ছাদ নেই, ঘরে বসে রান্না করে মা /  মেয়েটি ভীষণ একা। আরও একা হোক। " ( সেই মেয়েটির কথা) । টানেল থেকে বেরিয়ে এল - একটা বই - " রাজনীতি করবেন না"

রাজনীতির মাথা :

এই মেয়েটির নাম ভারতবর্ষ, কিংবা চীন কিংবা আফ্রিকা আবার হতেও পারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। মেয়েটি কেন একা হয়ে থাকবে। ওর থালায় কেন রক্তমাখা হাড় কিংবা বুলেটের খোলের অবশিষ্ট? এই উত্তর দেবে কোনো কলেজের স্টাফ রুম নয়, কোনো বিশ্ববিদ্যালয় নয়, কোনো পার্লামেন্টেরিয়ান লুকোচুরি নয় ।  এর উত্তর দেবে মানুষ, গুটিকয়েক যার মুখ আর মুখোশের ফারাক আছে - " খুব খারাপ শোনাবে, তবু একটা সত্যি কথা বলি / ভিখিরি দিয়ে কোনও জাতির কোনও উপকার হয় না / এমনকি বেশ্যা দিয়েও হয়।" (অন্ন) । কবিতার ভাষা ছিন্ন করে ভেসে আসছে একটা কথপোকথন ........ চিন্ময় গুহ বলছেন : "The Mask has unmasked the people all around the World" ( Candid Talk 3 : "Reflections")

রাজনীতির দেহ :

দেশ হাসপাতাল বানায় না, খাবার দিতে পারে না, কোনো ভ্যাক্সিন নেই, কিন্তু বেড ভাড়া প্রতিদিন ১২,৫০০ টাকা। মৃতদেহের উপর প্রথম ইট রাখা হয়, চোখের জল পাথর করে গড়ে ওঠে মন্দির - আমাদের প্রতিদিন পুড়ে যাওয়া আগুনের অবশেষ দিয়ে অকাল দেওয়ালি হয়! আমি বলি - 
" নাভি পোড়ে না বলে শুনেছি 
নাভির ভেতরে একটা অন্ধকার জমে থাকে 
সেই অন্ধকারের নাম অভিমান 
অভিমান আগুনে পোড়ে না। " (দাঙ্গা) 
কবিতা কোনো তারিখ ধরে লেখা হয়না। তারিখ আর ক্যালেন্ডারের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকে কবিতা। কবি শুনতে পাচ্ছে বোদল্যেরের ' প্যারিসের বিতৃষ্ণা' - শেষ পর্যন্ত আমার হৃদয়ে বিস্ফোরণ হয়
আর শান্ত ভাবে বলে : যে কোনও খানে! যে কোনও খানে! যদি সেটা পৃথিবীর বাইরে হয়, তবুও । " এ তো শুধু প্যারিসের নয়, এই তো এখন গোটা বিশ্বের ক্লিষ্ট মানবতার স্বর! 
সুবোধের মুখে রক্তহীন হাসি, একটা পাতা এগিয়ে দিল হাতে - "পৃথিবী যখন দুটো শিবিরে ভাগ হয়ে গেছেই / তখন বলি: / যারা না যেতে পেয়ে সরে যাচ্ছে / তাদের দেখে / যারা খেতে পেয়ে বেঁচে আছে / তাদের যেন লজ্জা না করে। " (কেমন আছেন?) 

রাজনীতির যৌনাঙ্গ :

কবির খোলস ফেলে মানুষ বেরিয়ে আসছে আবার -
 ভালোবাসা আর ধারালো ছুরির ভিতর এক একটা করে বছর জন্মাচ্ছে । প্রশ্নপত্র ততক্ষণই ভালো যখন তুমি চাকরি অ্যাপয়েন্টমেন্ট হাতে পাও । অধ্যাপকের হাতের কলম তোমার আঙুলের মতোই নরম, না হলে দিনের পর দিন তোমার রাতজাগা খাতা বই সাক্ষী থাকত না তোমার হোয়াটসঅ্যাপের দোলাচলে । এরপর হঠাৎ - 
"আকাশ দেখবে বলে অসীম তাকে নিয়ে এল 
এগারো তলার ছাদে/ সন্ধ্যে 4টার মধ্যে নিচের রাস্তায় এসে পড়ল দেবযানীর শরীর। / মুখে রুমাল গোঁজা । " (ছুরি দেখিয়ে ভালোবাসা যায়না)
একজন উনিশ বছরের বিধবার সাদা থানে লেখা থাকে বানতলার ইতিহাস " স্বামীর তলপেটে ঢুকে গেল বারো ইঞ্চি/ ওপর থেকে নীচে। নীচে নেমে ডানদিকে।/ পড়ে রইল খাবার, চিলি ফিশ থেকে তখনও ধোঁয়া উঠছে।/ এর নাম রাজনীতি বলেছিল পাড়ার লোকেরা।" (শাড়ি)

রাজনীতির পা :

সুবোধ সরকার কাঁধে হাত রেখে বললেন - "গলা নামিযে়ও ভাল কথা বলা যায় ।/ হাজার হাজার ছেলের কথা আপনাকে/ ভাবতে হবে না/ আপনি নিজের ছেলেকে একটু মানুষ করে তুলুন।" (হাউ টু বি আ গুড কমিউনিস্ট)
হানস্ কোহন্ , বোদল্যের আপনারা কেউ কলকাতার ফুটপাথ চেনেন না, কেউ রতনকে চেনেন না যে " রতন মাছ কাটে/ রতন স্যালাড বানায়/ লাল টম্যাটোর গায়ে হাত লাগে/ মায়ের স্নেহের মতো, মেদিনীপুরের গ্রামে" (রতন)
নদিয়ার অঞ্জলিকে চেনে না আকাদেমি কাঁপানো কবির দল। তারা কেউ পারবে দিতে " অঞ্জলির তিনটে সন্তান/ আর একটাও এসে গেল/ কী শেখাবে তাদের?/ ক্ষুধার্ত মা ক্ষুধার্ত সন্তানকে কী শেখায়?" (সুস্মিতা সেনকে)
বাংলা কবিতার ক্ষীর খেয়ে আমরা যখন অন্ধের পিঠে হাত বুলাই, জানলা ওপারে তখন রাজনীতির পেরেকে ক্ষত বিক্ষত গা'যে়, চোখ জলে ভেজা হাসি, আমার বাংলা কবিতা স্বপ্ন ও সংঘাতের এক একটি সিম্ফনি তৈরি করে।

Post a Comment

0 Comments