জ্বলদর্চি

ঊনবিংশ শতাব্দীর যুগন্ধর পুরুষ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর


Ishwar Chandra Vidyasagar

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর   


এক যে ছিল বিদ্যাসাগর

মু ক্তি  দা শ



“এক যে ছিল বিদ্যাসাগর
ভীষণ বাজে লোক,
বলতো কিনা বিধবাদের
আবার বিয়ে হোক! 

এক যে ছিল বিদ্যাসাগর
দেখতে এলেবেলে,
চাইতো কিনা লেখাপড়া
শিখুক মেয়েছেলে!

এক যে ছিল বিদ্যাসাগর
দেমাকধারী ধাত,
সাহেব যদি জুতো দেখায়
বদলা তৎক্ষণাৎ!

এক যে ছিল বিদ্যাসাগর
কপালে তার গেরো,
ওষুধ দিয়ে বাঁচায় কিনা
গরিব-গুর্বোদেরও!

এক যে ছিল বিদ্যাসাগর
মগজটা কি ফাঁকা, 
যে যেখানে বিপন্ন তাঁর
জোগানো চাই টাকা!”

অধুনা-প্রয়াত সাম্প্রতিককালের কবি-সাহিত্যিক পূর্ণেন্দু পত্রী’র কলম-নিঃসৃত হালকা মেজাজে নেগেটিভ ফর্মে লেখা উপরোক্ত কবিতাটিতে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের যে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলি ছত্রে ছত্রে ফুটে উঠেছে তার থেকে একনজরে ঊনবিংশ শতাব্দীর এই পুরোধা-পুরুষকে, তাঁর বিশাল ব্যক্তিত্বকে সম্যক পাঠ করে নিতে আমাদের অসুবিধে হয় না।

ঊনবিংশ শতাব্দীর যে ক্রান্তিকালে ঈশ্বরচন্দ্রের জন্ম, বাঙালি হিন্দুসমাজে তখন কেবলই জমাটবাঁধা সংস্কার। সেই সংস্কারাচ্ছন্ন তথাকথিত সমাজের পথে চলতে গিয়ে হোঁচট খেতে হয়েছে বার বার। তবু তিনি তাঁর পরিশীলিত মনন, শিক্ষাদীক্ষা ও নিজস্ব যুক্তির বাইরে একপা-ও বেরিয়ে আসতে পারেননি। সেই শৈশবকাল থেকেই এরকম অনমনীয় ব্যক্তিত্বের বহিঃপ্রকাশ ঘটে নানান ঘটনায় তাঁর চারিত্রিক দৃঢ়তার মধ্য দিয়ে। 

মূলত, ঊনিশ শতক ছিল পরিবর্তনের যুগ। নবজাগরণের যুগ। তৎকালীন কূপমন্ডুক সমাজের ধর্মীয় গোঁড়ামি ও কুসংস্কারের বেড়াজাল ছিন্ন করে সমগ্র জাতি ও সমাজকে নবজাগরণের দিশা দেখাতে আলোকবর্তিকা হাতে বুকে দুর্জয় সাহস নিয়ে এগিয়ে এসেছিলেন যে ধুতি-চাদর ও তালতলার চটি পরিহিত অতি সাধারণ অথচ অন্তরে দৃঢ়চেতা খর্বকায় মানুষটি, তিনিই ঊনবিংশ শতাব্দীর যুগন্ধর পুরুষ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।   

ঈশ্বরচন্দ্রের কর্মজীবন মূলত ত্রিধারায় প্রবাহিত – তিনি শিক্ষক, তিনি সমাজসেবক এবং তিনি সমাজসংস্কারক। বস্তুত, যে-যুগ বিভিন্ন্ বিরোধ-সংঘর্ষ ও ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে জাতির আত্মপরিচয় ও আত্মপ্রতিষ্ঠায় পরিণতি লাভ করেছিল, সেই যুগের অন্যতম ঋত্বিক ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র।

ঊনিশ শতকে ইংরেজ শাসন ও ইংরেজি শিক্ষা আঘাত হেনেছিল বাঙালির ভাবজীবন ও চিন্তাজীবনের মূলে, তার আত্মতৃপ্তির মানসদূর্গে। আঘাত হেনেছিল আচারসর্বস্ব, পুঞ্জীভূত অনাচার, অজস্র বিধিনিষেধের আকর ধর্মে। নাড়া দিয়েছিল প্রথাজীর্ণ, অবসাদগ্রস্ত, হাজারো কুসংস্কারে আচ্ছন্ন বাঙালি সমাজকে। তখনকার সামাজিক বিধি ও আচার-অনুষ্ঠানগুলি প্রত্যক্ষভাবে ধর্মের সংগে সম্পর্কিত ছিল। সমাজজীবনে ধর্মের প্রভাব ছিল ব্যাপক ও অব্যাহত। যার ফলে, অনৈক্য, পরস্পর বিদ্বেষ, আক্রমণ-প্রতিআক্রমণ। স্বভাবতই ধর্মের পথ ধরে এল সমাজজিজ্ঞাসা। আর সমাজজিজ্ঞাসা থেকে অনুভূত হলো সমাজ-সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা।

পর্যাপ্ত পরিমাণে শিক্ষার আলো না থাকলে যে সমাজকে বদলানো সম্ভব হবে না, মানসিক স্বতঃস্ফূর্ততা আসবে না এটা ভালোই বুঝেছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র। সমাজকে নতুন ছাঁচে গড়তে হলে শিক্ষার প্রসার। শিক্ষার চিরাচরিত পদ্ধতি বা রীতিকে ভেঙে নতুন করে তৈরি করতে হবে তার পরিকাঠামো। এবং তা হওয়া চাই একেবারে গোড়া থেকেই। তাই তিনি শিশুশিক্ষার জন্যে লিখলেন ‘বর্ণপরিচয়’। সংস্কৃত শিক্ষাকে অপেক্ষাকৃত সহজ করার জন্য লিখলেন ব্যাকরণ ‘উপক্রমণিকা’। বাংলাভাষার এলোমেলো ছত্রখান রূপকে শাসনে বাঁধতে তিনিই প্রথম শেখালেন বিভিন্ন যতিচিহ্নের ব্যবহার। সেইদিক থেকে ঈশ্বরচন্দ্রকে আধুনিক বাংলা গদ্যের জনক বললেও অত্যুক্তি হবে না। সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রও স্বীকার করে নিয়েছেন - “বিশেষতঃ বিদ্যাসাগর মহাশয়ের ভাষা অতি সুমধুর ও মনোহর। তাঁহার পূর্বে কেহই এরূপ সুমধুর বাংলা গদ্য লিখিতে পারে নাই এবং তাহার পরেও কেহ পারে নাই।” 

রবীন্দ্রনাথও লিখেছেন - “তাঁহার প্রধান কীর্তি বঙ্গভাষা।…বিদ্যাসাগর বাংলাভাষার প্রথম যথার্থ শিল্পী।…বিদ্যাসাগর বাংলা লেখায় সর্বপ্রথমে কমা, সেমিকোলন প্রভৃতি ছেদ চিহ্নগুলি প্রচলিত করেন।…গদ্যের পদগুলির মধ্যে একটি ধ্বনি সামঞ্জস্য স্থাপন করিয়া, সৌম্য ও সরল শব্দগুলি নির্বাচন করিয়া তাহার গতির মধ্যে একটি অনতিলক্ষ ছন্দস্রোত রক্ষা করিয়া বিদ্যাসাগর বাংলা গদ্যকে সৌন্দর্য ও পরিপূর্ণতা দান করিয়াছেন। গ্রাম্য পান্ডিত্য ও গ্রাম্য বর্বরতা উভয়ের হস্ত হইতেই উদ্ধার করিয়া তিনি ইহাকে পৃথিবীর ভদ্রসভার উপযোগী আর্য ভাষা রূপে গঠিত করিয়া গিয়াছেন।”

বিধবা-বিবাহের প্রচলন সমাজ-সংস্কারের ক্ষেত্রে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি – একথা মেনে নিতেই হবে। তবে মনে রাখা প্রয়োজন, বিধবা-বিবাহ প্রচলনের প্রাথমিক অনুভূতি ও প্রয়োজনীয়তার বীজ সর্বপ্রথম রোপিত হয়েছিল বিদ্যাসাগরের জন্মেরও ষাট বছর আগে।

১৭৬০ সালে ঢাকা নিবাসী রাজবল্লভ সেন মহাশয়ের অল্পবয়স্কা কন্যা অকালে বিধবা হয়। কন্যার বালবৈধব্যজনিত সামাজিক অনুশাসনের যন্ত্রণা বাপ হিসেবে অসহনীয় হয়ে উঠছিল তাঁর কাছে। কন্যার পুনর্বিবাহের জন্যে দ্রাবিড়, ত্রৈলঙ্গ, কাশী ও মিথিলার পন্ডিতদের কাছে তিনি ছুটে যান, যদি তাঁরা শাস্ত্রসম্মত ভাবে হোক বা শাস্ত্রীয় বিধিনিয়মের ফাঁকফোকর দিয়ে হোক - এর কোনো বিহিত করতে পারেন! শেষপর্যন্ত সেখানকার পন্ডিতরা যদিও পুনর্বিবাহের সপক্ষেই রায় দিয়েছিলেন, তবু আজীবন কুসংস্কারের ঐতিহ্যে লালিত রাজবল্লভ কন্যার পিতা হয়েও সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট হতে পারেনি। তখন তিনি পুনরায় নবদ্বীপের পন্ডিত-মন্ডলীর মতামত জানতে চেয়ে নদীয়ার মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়কে চিঠি লেখেন। জনশ্রুতি এই যে, মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র নাকি গোপনে এর বিরোধিতা করেছিলেন। যার ফলে, রাজবল্লভের মনোবাসনা পূর্ণ হতে পারেনি। সে যাই হোক, অসফল হলেও সম্ভবত এটাই ছিল হিন্দু বিধবা-বিবাহ আন্দোলনের প্রথম ও ভীরু পদক্ষেপ।

রাজবল্লভ তখন যা পারেননি, প্রায় নব্বইবছর বাদে ঈশ্বরচন্দ্র তৎকালীন হিন্দুসমাজে বিধবা-বিবাহ প্রচলনের আবশ্যিকতা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। এবং তিনি এ-ও বুঝেছিলেন যে, সবার আগে চাই স্ত্রী-শিক্ষার প্রসার। কারণ, একমাত্র উপযুক্ত শিক্ষার আলোই পারে এই কুসংস্কারের অন্ধকার দূর করতে। তাই আগে থেকেই তিনি প্রাথমিকভাবে তখনকার আইন-সদস্য ও শিক্ষাপরিষদের সভাপতি জন এলিয়ট ড্রিঙ্কওয়াটার বীটন-এর আনুকূল্যে বাবু দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের বৈঠকখানা বাড়িতে ১৮৪৯ সালের ৭ই মে তারিখে একটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। উদ্দেশ্য সম্ভ্রান্ত পরিবারের হিন্দু বালিকাদের ধর্মবর্জিত শিক্ষাদান। প্রথমদিকে এই স্কুলের নাম ছিল ‘ক্যালকাটা ফিমেল স্কুল’, পরে ‘হিন্দু ফিমেল স্কুল’, তারও পরে ‘নেটিভ ফিমেল স্কুল’ এবং অবশেষে বীটন সাহেবের নামে ‘বীটন গার্লস স্কুল। পরবর্তীকালে যা ‘বেথুন গার্লস স্কুল’ নামে পরিচিতি লাভ করে।

পরের বছর ১৯৫০ সালের জানুয়ারি মাসের গোড়ায় হেদুয়া পুষ্করিণীর পশ্চিমদিকে স্কুলের নিজস্ব ভবনের ভিত্তি স্থাপিত হয়। বীটন সাহেবের অনুরোধে ঈশ্বরচন্দ্র সেই স্কুলের অবৈতনিক সম্পাদক হিসেবে কার্যভার গ্রহণ করেন। তখনকার দিনে সেই প্রবল স্ত্রী-শিক্ষাবিরোধী সমাজেও ঈশ্বরচন্দ্রের নিরলস প্রচেষ্টায় অনেক সম্ভ্রান্ত ঘরের কন্যা ওই স্কুলে ভর্তি হয়। স্কুলের নিজস্ব গাড়ির ব্যবস্থাও ছিল। স্কুল-বালিকাদের সেই গাড়িতে স্কুলে নিয়ে আসা হতো। আবার স্কুলের পর তাদের যত্নসহকারে বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হতো। স্কুলগাড়ির সামনে ও পেছনে – দু’দিকেই খোদাই করা থাকতো একটি শ্লোক – “কন্যাপ্যেবং পালনীয়া শিক্ষণীয়াতিযত্নতঃ”। 

যাইহোক, কয়েকবছর বাদে ১৮৫৬ সালের মার্চ মাসে বীটন সাহেব ভারতবর্ষ থেকে বিদায় গ্রহণ করে ইংল্যান্ডে ফিরে যান। স্কুল পরিচালক কমিটির একাধারে সভাপতি ও সম্পাদক নিযুক্ত হন ঈশ্বরচন্দ্র। কিন্তু নানাকারণে মতবিরোধ দেখা দেওয়ায় প্রচন্ড অভিমানে নিজ সিদ্ধান্তে অটল থেকে শেষপর্যন্ত ১৮৬৯ সালের জানুয়ারি মাসে ঈশ্বরচন্দ্র পদত্যাগ করেন।

কিন্তু ঈশ্বরচন্দ্রের স্ত্রী-শিক্ষার প্রচেষ্টা তো আর শুধু বীটন স্কুলেই সীমাবদ্ধ ছিল না। এরমধ্যে ১৮৫৭ সালের নভেম্বর মাস থেকে ১৮৫৮ সালের মে মাস পর্যন্ত – এই সাতমাসে ছোটলাট হ্যালিডে সাহেবের বদান্যতায় তিনি শহর ও শহরতলী এবং মেদিনীপুর, হুগলী, নদীয়া, বর্ধমান পভৃতি জেলায় সব মিলিয়ে প্রায় ৫০টি  বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন।

এছাড়া ইতিমধ্যেই ১৮৬৪ সালের প্রথমদিকে কর্ণও্য়ালিশ স্ট্রিটে তিনি ‘হিন্দু মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশন’ স্থাপন করেন, যার সূচনা হয়েছিল ১৮৬১ সাল নাগাদ ‘ক্যালকাটা ট্রেনিং অ্যাকাডেমি’ নামে। পরবর্তীকালে এই ‘হিন্দু মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশন’ নাম থেকে ‘হিন্দু’ শব্দটি বাদ পড়ে যায় এবং নতুন নামকরণ হয় ‘মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশন’। রাজা প্রতাপচন্দ্র সিংহ হলেন তার সভাপতি এবং স্বয়ং ঈশ্বরচন্দ্র সম্পাদক। আর প্রধান শিক্ষকের পদ অলংকৃত করলেন হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়।  

বলাই বাহুল্য, এই সমস্ত সমাজসেবামূলক কার্যাবলী মোটেই অনায়াসলভ্য ছিল না। ভয়ংকর প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেই তাঁকে প্রতিটি পা ফেলতে হয়েছে।

স্ত্রী-শিক্ষা প্রচার বিষয়ে এই যে আন্দোলন, তখনকার ধর্মভীরু ও ধর্মান্ধ রক্ষণশীল সমাজ স্বভাবতই তা মেনে নিতে পারেনি। অনেকেই এর বিরোধিতায় এগিয়ে এসেছেন। তবে বিরোধের সেই আগুন - এতদিন যা ধিকিধিকি জ্বলছিল, বিধবা- বিবাহ প্রচলনের আন্দোলনে মানুষ দেখলো তার ভয়াবহ বিস্ফোরণ। 

প্রথমদিকে ঈশ্বরচন্দ্র পড়লেন মহাবিপাকে। না আছে প্রাচীন হিন্দুধর্মে বিধবা-বিবাহের কোনো সমর্থন বা স্বীকৃতি, না আছে হিন্দু ম্যারেজ অ্যাক্টে রি-ম্যারেজের কোনো ধারা। নাওয়া-খাওয়া ভুলে দিনরাত সংস্কৃত কলেজের লাইব্রেরি তন্ন তন্ন করে খুঁজে হিন্দুশাস্ত্র ও পুঁথি ঘেঁটে চলেছেন ঈশ্বরচন্দ্র। অবশেষে বহু শাস্ত্রানুসন্ধানের পর ১৮৫৩ সালের ডিসেম্বর মাসে ঈশ্বরচন্দ্র ‘পরাশর সংহিতা’য় বিধবাবিবাহের সমর্থনসূচক একটি শ্লোক খুঁজে পেলেন। কিংবা বলা যায়, আবিস্কার করলেন। এটাই তখন তাঁর কাছে আলোর দিশা। এবং অন্যতম আয়ুধ। শ্লোকটি হলো –

“নষ্টে মৃতে প্রব্রজিতে ক্লীবে চ পতিতে পতৌ।
পঞ্চস্বাপৎসু নারীণাং পতিরন্যো বিধীয়তে।” 

অর্থাৎ পতি যদি মারা যায় বা সন্ন্যাস নিয়ে গৃহত্যাগী হয় বা নিখোঁজ হয় বা সন্তান উৎপাদনে অক্ষম হয় অথবা অত্যাচারী বা অধার্মিক হয় তাহলে পত্নী পুনরায় বিবাহ করতে পারে।

এখানে একটা কথা বলে রাখা ভালো, ঈশ্বরচন্দ্রের এই আবিস্কারের ‌এগারো/বারো বছর আগে ১৮৪২ সালের জুলাই সংখ্যায় ‘বেঙ্গল স্পেক্টেটর’ পত্রিকায় ‘রি-ম্যারেজ অফ হিন্দু উইডোজ’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল। তাতে নাকি এই শ্লোকটির হুবহু উদ্ধৃতি ছিল। শুধু শ্লোকটির প্রথম লাইনে ‘নষ্টে’ শব্দের জায়গায় ‘গতে’ শব্দ ছিল। তাতে কি-ই বা এসে যায়! উভয় শব্দের অর্থ তো একই। 

এতদিনে মনে তবু কিছুটা জোর পেলেন ঈশ্বরচন্দ্র। পরিসর তো আগে থেকেই তৈরি ছিল ইয়ংবেঙ্গল মুভমেন্ট ও রাজা রামমোহন রায়ের সমাজ-সংস্কারের পথ ধরে। সেই পথ ঈশ্বরচন্দ্রকে শুধু অনুপ্রাণিতই করেনি, অসীম সাহসও যুগিয়েছিল। বিধবা-বিবাহের সপক্ষে সর্বসাকুল্যে মাত্র হাজারখানেক স্বাক্ষর সংগ্রহ করতে পেরেছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র। যদিও বিরোধীদের সংখ্যা ছিল কয়েকগুণ বেশি। তা হোক। তবু তিনি পিছ-পা হননি। হতে পারে বিরুদ্ধবাদীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। তবু তাঁর মনে হয়েছিল, জিত অবশ্যম্ভাবী। কারণ, তিনি তো এগোচ্ছেন যুক্তি-তত্ত্ব ও তথ্যের ভিত্তিতে একেবারে গণতান্ত্রিক উপায়ে, আবেগের বশে নয়। 

অতএব, ১৮৫৫ সালের ৪ঠা অক্টোবর ঈশ্বরচন্দ্র হিন্দু বিধবাগণের বিবাহ-আইন সিদ্ধ করার জন্যে ওই একহাজার ব্যক্তির স্বাক্ষর সম্বলিত আবেদনপত্রটি পাঠিয়ে দিলেন ভারতের গভর্নর জেনারেলের অফিসে। এবং পরের বছর ১৯৫৬ সালের ১৬ই জুলাই বিধবা-বিবাহ আইন ভারতীয় ব্যবস্থাপক সভায় পাস হয়ে যথারীতি গভর্নর জেনারেলের দ্বারা স্বাক্ষরিত হয়ে গেল। 

এবার রীতিমতো শোরগোল পড়ে গেল হিন্দু রক্ষণশীল সমাজে। উত্তাল হয়ে উঠলো শহর। উত্তপ্ত আবহাওয়া। সমাজের হর্তা-কর্তা ব্যক্তিরাই শুধু নয়, বড়ো বড়ো বাবুরাও এবং পুরোহিত সম্প্রদায় প্রকাশ্যে উঠে পড়ে লেগে গেলেন বিধবা-বিবাহ আইন প্রণয়নের বিরোধিতায়। হিন্দুধর্মের ভাড়াটে গুন্ডা লেলিয়ে দেওয়া হলো। লাঠিয়াল বাহিনী নিয়ে ঈশ্বরচন্দ্রকে আক্রমণ করা হলো। ক্রমাগত অশ্রাব্য অশ্লীল  কটূক্তি বর্ষণ হতে থাকলো। প্রাণনাশের হুমকি পর্যন্ত দেওয়া হলো। তাঁর শিক্ষা ও পান্ডিত্যকে নিয়ে ব্যঙ্গ করা হলো। সব দেখেশুনেও সেসময়ের শিক্ষিত ও বিদগ্ধ ব্যক্তিবর্গ ঈশ্বরচন্দ্র বা বিধবা-বিবাহের পক্ষে একটি কথাও বললেন না। অনেকে কটাক্ষ করলেন। স্বয়ং বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কিন্তু নীরব হয়ে রইলেন। তবে বেশ কয়েকবছর বাদে তিনি তাঁর প্রকাশিত ‘বিষবৃক্ষ’ উপন্যাসের সূর্যমুখীকে দিয়ে বলিয়ে নিলেন -“যে বিধবা-বিবাহের ব্যবস্থা করে সে যদি পন্ডিত হয়, তবে মূর্খ কে?” 

সবচেয়ে বড় কথা, শোভাবাজারের প্রভাবশালী রাজা রাধাকান্ত দেবও বিধবা-বিবাহের বিরোধিতা করে গেছেন। তিনি ১৮২৯ সালে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন “ধর্মসভা”। সেই “ধর্মসভা” থেকে উঠে এসেছিল বিরোধী-কন্ঠ। তারা নিজেদের উদ্যোগে এর বিরুদ্ধে বহুসংখ্যক স্বাক্ষর সংগ্রহ করেছিল এবং আবেদনপত্র জমা দিয়েছিল। যার হোতা ছিলেন স্বয়ং রাজা রাধাকান্ত দেব। যদিও তা ধোপে টেকেনি। 

আগেই বলেছি, বিধবা-বিবাহ বিরোধীরা তুলনামূলকভাবে সংখ্যাধিক। রাস্তাঘাটে তারা ঈশ্বরচন্দ্রকে গালিগালাজ করতে শুরু করে দিলো। তবু তিনি অবিচল রইলেন। এরূপ প্রতিক্রিয়ার জন্যে তাঁর মন তো আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল। পথেঘাটে লোকমুখে ছড়িয়ে পড়ছিল মেয়েলি গান – “…কি লিখন লিখেছে বিধি কপালে,/সিঁদুর পরিতে বুঝি হলো এবার কপালে,/একাদশী করা বুঝি উঠালে,/ডায়মোনকাটা মল বুঝি পরালে।/বুঝি বিদ্যাসাগর এতদিনে,/বিধবা নারীগণে,/একলা শোয়ার কত জ্বালা জেনেছে,/দিদি, বিধি ভালো বিবেচনা করেছে।” 

তাঁকে লক্ষ্য করে পত্রপত্রিকাগুলিতেও ছাপার অক্ষরে বের হতে লাগলো বিধবা-বিবাহ বিরোধী ব্যঙ্গধর্মী বিদ্রূপাত্মক ছড়া ও কবিতা। “সমাচার সুধাবর্ষণ”-এ বেরোলো – 

“সাজো গো বিধবাগণ ফুটিয়াছে ফুল,
তোমাদের সৌভাগ্য ঈশ্বর অনুকূল।”

এমনকি, সে যুগের আর একজন খ্যাতনামা কবিও তাঁর লেখনী দিয়ে বিদ্ধ করলেন ঈশ্বরচন্দ্রকে। তিনিও ঈশ্বর। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক কলম ধরলেন ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত। গুপ্তকবি তাঁর চাঁচাছোলা স্বভাবসিদ্ধ ছন্দে লিখলেন –

“বাধিয়াছে দলাদলি লাগিয়াছে গোল।
বিধবার বিয়ে হবে বাজিয়াছে ঢোল।।
কত বাদী প্রতিবাদী করে কত রব।
ছেলে বুড়া আদি করি মাতিয়াছে সব।।
কেহ উঠে শাখাপরে কেহ থাকে মূলে।
করিছে প্রমাণ জড়ো পাঁজিপুতি খুলে।
……
‘পরাশর’ প্রমাণেতে বিধি বলে কেউ।
কেহ বলে এ যে দেখি সাগরের ঢেউ।।
……
কেহ বলে ক্ষতাক্ষত কেবা আর বাছে।
একেবারে তরে যাক যত রাঁড়ী আছে।।
কেহ কহে এই বিধি কেমনে হইবে।
হিঁদুর ঘরের রাঁড়ী সিঁদুর পরিবে।।”

তবে যাবতীয় লেখালেখিই যে আক্রমণাত্মক ছিল, এমনটা তো নয়। কোনো কোনো বিদগ্ধজন সাধুবাদও জানিয়েছেন। রমেশচন্দ্র দত্ত লিখেছেন –

“An ordinary man would have despaired in those circumstances, but determined Vidyasagar was not such a man. On one side there were selfishness, inertia, foolishness and hypocrisy, on the other side there was Ishwar Chandra Vidyasagar. On one side social torture on widows, the heartlessness of males, the immobility of a spineless Nation, on the other side Ishwar Chandra Vidyasagar. On one side the power of superstitions and selfish priests about fake Hinduism, on the other side. Ishwar Chandra Vidyasagar…”

একজন ইংরেজ সিভিলিয়ান সি. ই. ব্যাকল্যান্ড মুগ্ধ হয়ে লিখলেন –

“He combined a fearless independence of character with great gentleness and the simplicity of a child in his dealing with the people all classes.”

বাঙালি কবি মধুসূদন লিখলেন –

“He has the genius and wisdom of an ancient sage, the energy of an Englishman and the heart of a Bengali mother.”

এছাড়াও জনৈক সাধারণ বাঙালির দৃষ্টিতে –

“যদি অসম্ভবকে সম্ভব করিতে পারা যায় অর্থাৎ আধুনিক যুগের চরম সভ্য মানুষের জ্ঞান, বুদ্ধি, বৈজ্ঞানিক বিচারশক্তি, যুক্তিপ্রবণতা ও উগ্র ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের সঙ্গে যদি আদিযুগের অসভ্য মানুষের কর্মশক্তি, স্বাধীনতা-প্রিয়তা, সরলতা, সত্যবাদিতা, কষ্টসহিষ্ণুতা, পরোপকারবৃত্তি এবং নারীর প্রতি শ্রদ্ধা যুক্ত করিতে পারা যায়, একমা্ত্র তাহা হইলেই বিদ্যাসাগরের মত চরিত্র সৃষ্ট হইতে পারে। এ চরিত্র শুধু মহান নয়, অনন্য, একক এবং অসম্ভব বলিয়াই মর্মান্তিক করুণ ও বেদনাঘন। বাঙালী জাতির শ্রেষ্ঠ আদর্শ ও বিবেক বিদ্যাসাগর।”

সেই ডামাডোলের মধ্যেও, সেই উত্তাল, অস্থির, উত্তপ্ত সময়ের মধ্যেও কিন্তু স্থির হয়ে বসে রইলেন না ঈশ্বরচন্দ্র। কালবিলম্ব না করে বিধবা-বিবাহ আইন পাশ হওয়ার সংগে সংগেই আইনানুসারে তিনি বিধবা-বিবাহের তোড়জোড় শুরু করে দিলেন। এবং কয়েকমাসের মধ্যেই ১৮৫৬ সালের ৭ই ডিসেম্বর তাঁর ব্যবস্থাপনায় হয়ে গেল প্রথম হিন্দু বিধবা-বিবাহ। রচিত হলো এক নতুন ইতিহাস। বর শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন (বন্দ্যোপাধ্যায়)। একদা সংস্কৃত কলেজের কৃতী ছাত্র। খাটুয়া নিবাসী প্রখ্যাত কথক রামধন তর্কবাগীশের পুত্র। আর কনে বর্ধমান জেলার পলাশডাঙা গ্রাম-নিবাসী ব্রহ্মানন্দ মুখোপাধ্যায়ের দশম বর্ষীয়া কন্যা কালীমতি। কালীমতির প্রথম বিয়ে হয়েছিল নদীয়া জেলার বর্হিগাছি গ্রামের কুলীন ব্রাহ্মাণ হরমোহন ভট্টাচার্যের সংগে। কালীমতির বয়স তখন মোটে চারবছর। এই বিয়ের দু’বছর পরেই কালীমতি বিধবা হয়, মাত্র ছয় বছর বয়সে। এখন কালীমতি দশবছরের।

এই বিয়ের বিশদ বর্ণনা দিতে গিয়ে রাধারমণ মিত্র লিখেছেন – “বিবাহবাসর তৎকালের ১২ নং, বর্তমানে ৪৮ নং সুকিয়া স্ট্রীটস্থ বিদ্যাসাগরের পরমবন্ধু রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভবন। বিবাহবাসরে উপস্থিত ছিলেন সংস্কৃত কলেজের ন্যায়দর্শনের অধ্যাপক জয়নারায়ণ তর্কপঞ্চানন, স্মৃতির অধ্যাপক ভরতচন্দ্র শিরোমণি, অলংকারের অধ্যাপক প্রেমচাঁদ তর্কবাগীশ, ব্যাকরণের অধ্যাপক তারানাথ তর্কবাচস্পতি, ব্যাকরণের অধ্যাপক গিরিশচন্দ্র বিদ্যারত্ন, ব্যাকরণের অধ্যাপক হরিনাথ ন্যায়রত্ন (হাওড়া-শিবপুর), স্কুল সাব-ইনস্পেক্টর মাধবচন্দ্র গোস্বামী, নীলকমল বন্দ্যোপাধ্যায় (রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের জ্যেষ্ঠভ্রাতা), হিন্দুকলেজের প্রাক্তন ছাত্র স্বনামধন্য রামগোপাল ঘোষ, হরচন্দ্র ঘোষ এবং প্যারিচাঁদ মিত্র ও কালীপ্রসন্ন সিংহ।”

এই বিয়ের যাবতীয় ব্যয়ভার বহন করেছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র। এই একটি বিয়েতেই তাঁর খরচ হয়েছিল দশহাজার টাকা। শুধু এই বিয়েই নয়, ১৮৫৬ থেকে ১৮৬৭ – এই এগারো বছরে ঈশ্বরচন্দ্র ৬০টি বিধবা-বিবাহ নিজের হাতে দিয়েছিলেন। এতে তাঁর মোট ব্যয় হয়েছিল ৮২ হাজার টাকা। স্বাভাবিকভাবেই তিনি ঋণগ্রস্থ হয়ে পড়েছিলেন। তাঁর ঋণের কথা জানতে পেরে তৎকালীন ‘হিন্দু পেট্রিয়ট’ পত্রিকার সম্পাদক একটি বিধবা-বিবাহ তহবিল গঠন এবং সেজন্যে সর্বসাধারণের কাছে আর্থিক সাহায্যের জন্য আবেদন করার মনস্থ করেন।  কিন্তু ঈশ্বরচন্দ্র তাতে সম্মত হননি। তিনি সাফ সাফ লিখে জানিয়ে দিলেন – “আমি যাহা ঋণ করিয়াছি তাহা শোধ করিবার জন্য সাধারণ সমীপে আবেদন করিবার ইচ্ছা আমার লেশমাত্রও নাই।…তাই আমি উক্ত প্রচারিত প্রস্তাবের প্রতিবাদ করিতেছি। এবং যে-সকল ভদ্রলোক এই প্রস্তাবে স্বাক্ষর করিয়াছেন তাঁহাদিগকে সরিয়া দাঁড়াইতে অনুরোধ করিতেছি। ইতি। ২৬শে জুন, ১৮৬৭ খ্রীঃ।”
এখানেই শেষ নয়। ঈশ্বরচন্দ্র তাঁর উইলেও অনেক বিধবা, বৃদ্ধ, দারিদ্যপীড়িত মানুষদের জন্যেও মাসোহারার ব্যবস্থা করে গিয়েছিলেন।

তদানীন্তন হুগলী জেলার, বর্তমানে মেদিনীপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামে ১৮২০ সালের ২৬শে সেপ্টেম্বরের মহালগ্নে যে ঈশ্বর এই মর্ত্যধামে নেমে এসেছিলেন, এবং ১৮২৮ সালের নভেম্বর মাসে মাত্র আট বৎসর দু’মাস বয়সে বাবার হাত ধরে পদব্রজে কলকাতা এসে তাঁর মহান কর্মযজ্ঞে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, সেই পথচলা শেষ হয়েছিল ১৮৯১ সালের ২৯শে জুলাই, ১৩ই শ্রাবণ, ১২৯৮ বঙ্গাব্দ রাত ২টো ১৮ মিনিটে। কিন্তু এসব কিছুই তো জাগতিক দিন-তারিখ-ঘন্টা-মিনিটের হিসেব। জন্ম ও মৃত্যু এই দিন-তারিখ-ঘন্টা-মিনিট ধরেই আবর্তিত হয়ে চলেছে। আসলে ঈশ্বর তো অবিনশ্বর। এবং আমাদের ঈশ্বরচন্দ্র ঈশ্বর বা দেবতা নন। তিনি রক্ত-মাংসে গড়া, দোষগুণে ভরা মানুষমাত্র। 
তবু আজ তাঁর দ্বিশতজন্মবার্ষিকীতে দাঁড়িয়ে খালি কেন যে গোলমাল হয়ে যায় এই ভেবে যে, এটা ঈশ্বরের দেবত্বলাভ, নাকি দেবতার ঈশ্বরত্বলাভ?

                 

Post a Comment

3 Comments

  1. তথ্যবহুল জীবনবৃত্তান্ত।

    ReplyDelete
  2. ছোট্ট প্রবন্ধ, কিন্তু বেশ ভালো।

    ReplyDelete
  3. ভালো হয়েছে।

    আমাদের পত্রিকার বিদ্যাসাগর বিশেষ সংখ্যা করোনার জন্য প্রেসে আটকে আছে। পনেরটা প্রবন্ধ আছে।

    ReplyDelete