জ্বলদর্চি

ওঁ বিদ্যাসাগর, ওঁ বিদ্যাসাগর- সন্দীপ কাঞ্জিলাল।


Ishwar Chandra Vidyasagar
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর   


"মাঝে মাঝে বিধাতার নিয়মের এরুপ আশ্চর্য ব্যতিক্রম হয় কেন? বিশ্বকর্মা যেখানে চার কোটি বাঙ্গালী নির্মাণ করিতেছিলেন, সেখানে হঠাৎ দু একজন মানুষ গড়িয়া বসেন কেন?"
                  - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। 

ওঁ বিদ্যাসাগর, ওঁ বিদ্যাসাগর 

স ন্দী প  কা ঞ্জি লা ল

আমরা যারা বিভিন্ন কারণে এই মানুষটাকে শ্রদ্ধা করি এবং তাঁর চরিত্র এবং জীবন থেকে কিছু শেখার কথা ভাবি বা বলি, তাদের মধ্যে দায়িত্ব পড়ে কেন এই মানুষটিকে শ্রদ্ধা করবো। 
বিদ্যাসাগর সেদিনও যেমন ছিলেন, আজও তেমনি কিছু মানুষের কাছে সমস্যার। হিন্দু বিবাহ আইনের জন্য কিংবা বাল্যবিবাহ বন্ধ করার জন্য নয়, তাঁর দুটো বিখ্যাত উক্তি যা তাঁর মৃত্যুর পর প্রায় ১৯২৬ সাল নাগাদ আবিষ্কৃত হয়েছে। যখন ইংরেজরা তাঁকে (তখনও মাক্সমূলার বা ওডেনবার্গ সেই পঞ্চাশ খণ্ড অনুবাদ করেননি।) বলেছিল, ভারতীয় দর্শন কিছু অনুবাদ করে ইংরেজিতে পড়ানো যায় কি না? তিনি বলেছিলেন - "That samkhya and vedanta are false statement of philosophy in no more in dispute. There is nothing substantial in them"- গোদা বাংলায় "সাংখ্য বেদান্ত" ভ্রান্ত দর্শন তন্ত্র, সে কথা বলতে। ওগুলোতে সেরকম কিছু নেই। 
ঈশ্বর সম্বন্ধে তাঁর ধারণার মীমাংসা করা দূরহ। তিনি নির্মম দেশাচারের ঘোর বিরোধী ছিলেন। মানুষের দুঃখ দূর করার জন্য শাস্ত্রের রচনাকে হেলায় উড়িয়ে দিতে পারতেন। নিজের উইলে বিভিন্ন হিতকর কর্মে অর্থ বরাদ্দ করেছেন বটে তবে মন্দির দেবসেবার জন্য এক পয়সার ব্যবস্থা করেননি। বিজয় কৃষ্ণ গোস্বামী ভক্তিপথে গিয়ে ধর্ম প্রচারক হয়েছিলেন- তাঁকে বিদ্যাসাগর বলেছিলেন, "তুমি একটা কি হয়েছো বলে শুনেছি?" কিন্তু এসব ধারণা থেকে তাকে কখনো নাস্তিক বলা যাবে না। তিনি বিশ্বাস করতেন- ধর্মের থেকে কর্মই বড়ো। যাতে মানুষের দুঃখ দূর হয়। তিনি ভাবতেন- ঈশ্বর বিষয়ক তত্ত্ব কথা এমন সংগুপ্ত যে, যুক্তি বুদ্ধি দিয়ে তার নাগাল পাওয়া যাবে না। অতএব অন্যকে উপদেশ দেওয়া মূর্খামি। তাঁর মতে ঈশ্বর সাধনা একান্ত ভাবে ব্যক্তিগত ধ্যানধারণার বস্তু- প্রচার বা বিতর্কের বিষয় নয়। রামকৃষ্ণ কথামৃতের মহেন্দ্রগুপ্ত প্রশ্ন করেছিলেন- "আপনার হিন্দু দর্শন কেমন লাগে?" বিদ্যাসাগর-- আমার মনে হয় ওরা যা বোঝাতে গেছে, তা পারেনি। ঈশ্বর বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন-- তাকে তো জানবার জো নেই। প্রত্যেকের চেষ্টা করা উচিত যাতে জগতের মঙ্গল হয়। আবার প্রশ্ন, তাহলে জীবের করণীয় কি?- "জীবকে ঈশ্বর জ্ঞানে সেবা করা।" 

তাই বিবেকানন্দ বলেছিলেন, "আমার প্রথম গুরু রামকৃষ্ণ, দ্বিতীয় গুরু বিদ্যাসাগর।" 

আসলে তিনি হিন্দু দর্শনের সীমা সম্বন্ধে অতিশয় সচেতন ছিলেন। দর্শন মূলত বুদ্ধি-আশ্রয়ী। সুতরাং ঈশ্বর বলতে যদি কিছু থাকে তবে সে বিষয়ে তত্ত্বদর্শন কতটুকু সাহায্য করতে পারে। এই বুদ্ধির দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি বেদান্ত ও সাংখ্যকে ভ্রান্তদর্শন বলতে কুণ্ঠিত হননি। মোদ্দা কথা যাকে জানা যায় না তাঁর পিছনে ছুটে কি লাভ? যাই জানা যায় তাই-ই ভালো। তাই তিনি একবার বলেছিলেন, "এ দুনিয়ার একজন মালিক আছেন তা বেশ বুঝি, তবে ঐ পথে চললে তার প্রিয়পাত্র হইব স্বর্গরাজ্য অধিকার করিব, এইসকল বুঝি না। আর লোককে তাহা বুঝাইবার চেষ্টাও করি না। লোককে বুঝিয়ে শেষে কি ফ্যাসাদে পড়বো?" তাছাড়া তিনি বোধ হয় বুঝে ছিলেন- ধর্ম একদিন রাজনীতির হাতিয়ার হবে। ঘটা করে বিদ্যাসাগরের দ্বিশতবর্ষ পালন করছি- এখনও বিজ্ঞান ভবন উদ্বোধনের সময় নারকেল ফাটাই, আসলে আমাদের পণ্ডিতদের মস্তিষ্ক আসলে নারকেলডাঙা। খানিকটা ছিবড়ে খানিকটা জল। পুরো জ্ঞান একেবারে জলভাত। 

এতবড় এক অচলায়তন-- তার দরজা ভাঙতে পারলেও, বেশ কয়েকটা ফুটো করে দিয়ে গেছেন। যা আজও সারানোর অযোগ্য। হাতে এসে গেল বাংলা অক্ষর। ঋ কার দোতলা বাস গুলিকে গ্যারেজ করে দিলেন, সংস্কৃত দাপটমুক্ত বাংলা ব্যকরণ হয়ে গেছে সহজ সরল। অনুস্বার বিসর্গকে স্বরবর্ণ থেকে গলা ধাক্কা দিলেন। চন্দ্রবিন্দু মর্যাদা পেল তাঁর হাত ধরে। বর্ণপরিচয়ের কর খল ঘট থেকে "পথছাড়" "জলখাও" "হাত ধর" পড়তে পড়তে শিশু রবীন্দ্রনাথ পেয়ে গেলেন "জল পড়ে পাতা নড়ে"। তাঁরই প্রচেষ্টায় বাংলা ভাষা শিরদাঁড়া পেয়ে নাদুসনুদুস এখন হেঁটে বেড়াচ্ছে। 
বিধবা বিবাহ আন্দোলনের সময় কিছু কিছু পরিচিত বিবাহদের পুনরায় বিয়ে দেওয়ার চেষ্টায় বহু লোক টাকা পয়সা আরও অন্যান্য সাহায্য করবে বলেছিল। কাজে নেমে দেখলেন কারোর টিকিরও দেখা নেই। অনেকজনকে চিঠি লিখে তাও বলেছিলেন, আবার অনেক লোক বিধবাকে বিয়ে করবে বলে টাকা পয়সা নিয়ে কেটেও পড়েছে। এই বিধবা বিবাহ প্রচলন করতে গিয়ে মা বাবা পরিবারের সাথে বিচ্ছেদ! তিনি তাই শম্ভুচন্দ্রকে লিখলেন- " আমি জ্ঞানতঃ তাঁহাদের সুখের কোনও ব্যাঘাত ঘটাইনি। তাহারা কেন আমার সুখ প্রদয়ক কর্মে ব্যাঘাত হইবেন?"

শিক্ষকদের সময় মতো স্কুলে আসা, সঠিকভাবে পড়ানো তাঁর রীতি! তাই তিনি বিবেকানন্দকে মেট্রোপলিটন স্কুল থেকে বের করে দিয়েছিলেন। 
আচ্ছা এমন কোনো নথি কেউ বের করতে পারবেন কোন স্কুল কলেজ বা অন্য কোথাও দাতা হিসাবে বিদ্যাসাগরের নাম আছে? পারবেন না। আসলে তাঁর নামের আগে দয়ারসাগর দানসাগর উপাধি দিয়ে তাঁর চরিত্রের আসল পরিচয়টাকে আমরা ঢেকে দিচ্ছি! তিনি আসলে অক্ষয় মনুষ্যত্ব "অজেয় পৌরুষ!"
রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী একবার বলেছিলেন- "ছোট জিনিসকে বড় করে দেখতে অণুবীক্ষণ যন্ত্র লাগে। আর বড় জিনিসকে ছোট করে দেখতে বিদ্যাসাগরকে লাগবে।"
মাও সেতুং একবার বলেছিলেন- "একটা দুটো ভালো কাজ করা তেমন কঠিন নয়। সারাজীবন ধরে ভালো কাজ করে যাওয়াটাই যথার্থই দূরহ।" জানতে পারলে মাও সেতুং চিনের লোকদের বিদ্যাসাগরের কথা নিশ্চয় বলতেন৷ শত নিন্দা শুনলেও কারোর বিরুদ্ধে কোনও নিন্দাসূচক বাক্য বলেননি। অনেকে তাঁর সমালোচনা করেছেন, স্বয়ং বঙ্কিমচন্দ্রও৷ তাঁর উপন্যাসের এক চরিত্রের মুখ দিয়ে কটূ কথা বলিয়েছেন, তবু তিনি একটি কথাও বলেননি। চটি পরে এশিয়াটিক সোসাইটিতে যাওয়া যাবে না বললে, আর তিনি কোনদিনই সেখানে পা রাখেননি। 

আমরা সময় সুযোগমত মেরুদণ্ডটাকে একটু এদিক ওদিক বাঁকিয়ে কাজটা হাসিল করে নিই। কিন্তু বিদ্যাসাগরের শিরদাঁড়ার এই নমনীয়তা ছিল না। যা ঠিক বলে বুঝেছেন তাই করেছেন। নিজের ছেলেকে পর্যন্ত ত্যাগ করেছেন। 
অ এ অজগড় আসছে তেড়ে। অ এ আর কিছু পেলেন  না, অজগর তেড়ে আসছে তার পেটে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছি। আ এ আমটি খাব পেড়ে, যে যার আম গাছ লাগাও, আমরা মগডালে বসে খাবো। ইঁদুর ছানা ভয়ে মরে- যে মরতে ভয় পায়, সেই ইঁদুরছানা।" 
মনে পড়ে গেল কার্ল মার্ক্স ১৮৬৫ সালে আন্তর্জাতিক শ্রমজীবীর সভায় ধনতান্ত্রিক অর্থনীতির মুনাফা কোত্থেকে আসে বোঝাতে গিয়ে কোপারনিকাসের উদাহরণ দিয়ে বলেছিলেন- "বন্ধুগণ দুনিয়ার কোন গূঢ় সত্যকেই উপর উপর দেখে জানা বা বোঝা যায় না, আপাতদৃষ্টি ঘটনার ভেতর ঢুকে তলিয়ে বিচার বিশ্লেষণ করে তার অন্তহীন রহস্য বুঝবার চেষ্টা করতে হয়। সত্য জলের উপর তেলের মতন ভেসে বেড়ায় না, চিনির মতো দ্রবীভূত থাকে।" 
কী আর করা যাবে, মহম্মদ যখন পর্বতের কাছে যাবেন না, পর্বতকেই তাহলে বলে-কয়ে মহম্মদের কাছে নিয়ে আসতে হয়। তাই রামকৃষ্ণ এলেন বিদ্যাসাগরের কাছ। তাঁর ফর্মুলা - "যত মত তত পথ"। বিদ্যাসাগর "সত্য এক" বলে মনে করতেন না। তাঁর মতে সত্য বহু। অন্তত বহু-বচন! স্বয়ং ঋগবেদ বলেছে- "একম সদ্বিপ্রাঃ বহুদাবন্তি।" ফলে সত্যের বহু-বচনে দোষ নেই। এ ছিল এক আদর্শ কালপূর্ব অগ্রিম উত্তর-আধুনিক তত্ত্বক্রম। রামকৃষ্ণের তাঁর সরল বাক্যালাপ, সহজিয়া পল্লি-উদাহরণ, শিশুর মতো হাসি- সব মিলিয়ে তিনি বহু মানুষকেই জয় করেছিলেন। কিন্তু তখনও বাকি থেকে গেছেন একজন- বিদ্যাসাগর। তাকে দখলে নিতে পারলে বিরাট সাফল্য। অতএব রামকৃষ্ণ মহেন্দ্রবাবুর মাধ্যমে দিন ক্ষণ ঠিক করে একদিন বাদুড়বাগানে চলে এলেন বিদ্যাসাগরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। 
সে এক অভূতপূর্ব আলাপন। ঘন্টা চারেক ধরে। বক্তা মাত্র একজনই। তিনিই খালি বলে চললেন। বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে। শ্রোতা অবশ্য দুজন। তার মধ্যে একজন আবার বিমুগ্ধ শ্রোতা। যাই শোনেন, অমৃতের সন্ধান পেতে থাকেন। আর অন্যজন ক্রমান্বয়ে আগত বাক্যশব্দের এক নিঃশব্দ পরম গ্রাহক। সে যুগে অবজেক্টিভ টাইপ প্রশ্নোত্তর চালু থাকলে সংলাপ বজায় রাখার সৌজন্যের স্বার্থে বিদ্যাসাগরের উত্তরগুলি এক আদর্শ সংগ্রহ হয়ে থাকতে পারতো। শোনা যায়, বিদ্যাসাগর খাওয়ারদাওয়ার ও ভালো বন্দোবস্ত করেছিলেন। রামকৃষ্ণও খেয়েদেয়ে খুশি হয়েছিলেন৷ রামকৃষ্ণের যত পথ জানা ছিল, বিদ্যাসাগরের মত অনুমান করে করে সেই অনুযায়ী প্রচুর ঢিল ছুঁড়েছিলেন সেদিন। একটাও লক্ষ্যভেদ করলো না। আধ্যাত্মিক লাইনের কোনো পথেই বিদ্যাসাগরের মতের নাগাল পেলেন না তিনি। ভদ্রতা ও বিনয়ের অবতার (অবতার শব্দটা বোধ হয় এখানে বেমানান, বরং রাহুল দ্রাবিড় বলাই ভালো) হয়ে ঈশ্বরচন্দ্র প্রতিটি ঢিল যত্ন করে হাতে ধরে নিয়ে বিস্মৃতির আলমারিতে চালান করে দিলেন৷ 
রামকৃষ্ণ বুঝলেন, এখানে আসা তাঁর ব্যর্থ। অনেক দিনের পোষিত ইচ্ছা পূরণ হলো না। তবু বুদ্ধিমান ব্যক্তি বলেই তিনি আমন্ত্রণ জানালেন বিদ্যাসাগরকে রাণি রাসমণির "বাগান" দেখতে আসার জন্য। এই একটি আমন্ত্রণ বাক্যেই তিনি বুঝিয়ে দিলেন যে তিনিও বুঝে গেছেন- বিদ্যাসাগরের আরোধ্য বিষয়টি ঠিক কি ধরনের।
এখন বাংলা বাদ দিয়ে ইংরেজি শেখাচ্ছি ছেলেমেয়েদের, মাস্টাররা বলছেন বাড়িতে ছেলেমেয়েদের সঙ্গে ইংরেজিতে কথা বলুন- বলছি- বাংলা ভুলছে- তবু আমরা বাংলা লিখছি- বিদ্যাসাগর পালন করছি- কেউ বলছে কালের দাবি- সে যুগে ইংরেজের দাবি আরও বেশি ছিল- বিদ্যাসাগরের ছিল বাংলা ভাষার জন্য লড়াই! আমাদের মতো পথভ্রষ্ট মৃতপ্রায় জাতিকে বাঁচাতে পারে কমন্ডুল নয়, ঘটিতে জল নিয়ে সবার গায়ে ছিটাতে হবে, তবে ওঁ নারায়ণ ওঁ নারায়ণ নয়, বলতে হবে ওঁ বিদ্যাসাগর,ও বিদ্যাসাগর ওঁ বিদ্যাসাগর!

Post a Comment

0 Comments