জ্বলদর্চি

জঙ্গলমহলের দুর্গোৎসব: দেবতাবাদ ও মানবতাবাদ

Durgotsab of Jangalmahal: Theism and Humanism

জঙ্গলমহলের দুর্গোৎসব: দেবতাবাদ ও মানবতাবাদ

সূ র্য কা ন্ত  মা হা তো

গ্রীষ্মের প্রচন্ড দাবদাহে জঙ্গলমহলের বিস্তীর্ণ জঙ্গলরাশি একরকম ঝলসে ওঠে। বর্ষায় বৃষ্টিস্নাত হয়ে সেগুলো নতুন করে আবার প্রাণ ফিরে পায়। শাখা-প্রশাখার কোলে কোলে এ সময় গজিয়ে ওঠা কচিপাতা গুলো উঁকি মারে। এই শরতেই নব কলেবরে বিস্তীর্ণ জঙ্গলরাশি অপরূপ সাজে সেজে ওঠে।  এই সময় জঙ্গলমহলের মাথার ওপর বিরাজমান থাকে বনানীর সবুজ ছাতার মুকুট। নিম্নে শোভা পায় ঢেউ খেলে যাওয়া হরিৎ ধান ক্ষেতের  বিছানো কার্পেট। সবুজে সবুজে যেন রঙের খেলা। শারদীয়া প্রকৃতির এই অকৃত্রিম সৌন্দর্য  এখানকার বাসিন্দাদের হৃদয়ে এক নিখাদ আনন্দ ধারা সৃষ্টি করে।

সমগ্র জঙ্গলমহলের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে আদিবাসী মূলনিবাসী জনজাতির বসবাস। তবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে অ-আদিবাসী ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় জনজাতির বসবাসও এখানে রয়েছে। সবশুদ্ধ এক মিশ্র জনজাতির বসবাস রয়েছে এই জঙ্গলমহল জুড়ে। আদিবাসী মূলনিবাসী ও হিন্দুদের পৃথক পৃথক সংস্কৃতি, ধর্মীয় আচার আচরণ, ধর্মীয় উৎসব বেশ সম্মানের সঙ্গেই জঙ্গলমহলে পালিত হয়। এখানকার মানুষের মূল জীবিকা হল কৃষিকাজ। প্রায় নব্বই শতাংশেরও বেশি মানুষ কৃষিকাজের ওপর নির্ভরশীল। এই কৃষির বল শক্তিতেই এখানকার অর্থনীতির চাকা ঘুরে। বর্ষার সময় কৃষকদের তাই হাড়ভাঙা পরিশ্রম করতে হয়। বিন্দু বিন্দু বারিধারার সঙ্গে বিন্দু বিন্দু রক্ত ও স্বেদ বিন্দু সংমিশ্রিত না হলে আবার ফসল ফলে না।  তাই তো পুজোর সময় একটি প্রাচীন প্রথা জঙ্গলমহলে প্রচলিত  রয়েছে--- "ধান জাগানো।" মহাঅষ্টমীর দিন কৃষকেরা চালের গুঁড়ি দিয়ে ধান জাগায়। যাতে দেবীর কৃপায় ফসলের যেন কোনও ক্ষতি না হয়।  বর্ষার বিদায়ে কৃষকদের পরিশ্রমও কিছুটা লাঘব হয়। চাষের কাজ শেষ হলে শরতে দু দন্ড বিশ্রাম ও একটু অবসর মেলে।

একদিকে প্রকৃতির সৌন্দর্য ও অন্যদিকে অবসর জীবনে তাই নেমে আসে খুশির আমেজ। কোনও আসন্ন উৎসবের কারণে এ আনন্দ নয়। এ আনন্দ একেবারেই প্রাকৃতিক। যা মনের ভিতর থেকে উঠে আসে। প্রাত্যহিক শরত সন্ধ্যাতে গ্রামগুলোতে ঢোল,ধামসা,মাদল নিয়ে নানান লোক সংগীতের আসর বসে। ভাদুগান, জাওয়া গান, করম গান ও সাঁওতালি গানের সঙ্গে পাতা নাচ, কাঠি নাচ ও দাঁশায় নাচে বিভোর হয়ে আদিবাসীরা চিত্ত বিনোদন করেন। অ-আদিবাসীরাও এমন গানের আনন্দ বেশ উপভোগ করেন। কেউ কেউ তো আবার সমান ভাবে অংশগ্রহণও করেন।
বর্ষায় খসে পড়া কাঁচা মাটির দেওয়াল গুলোতে আদিবাসী নারীরা শরতের এই পুজো মরশুমে  পুনরায় লালমাটি ও সাদামাটি লেপনের কাজ শুরু করেন। সেগুলোকে আবারও চাকচিক্য করে গড়ে তোলার জন্য, তার উপরে  খড়ি মাটি ও নীলবড়ির রং মিশিয়ে অদ্ভুত এক নীলসাদা রং তৈরি করে দেওয়ালে মাখান। অপূর্ব লাগে দেখতে। কেউ কেউ আবার কালো ও গেরুয়া রং দিয়ে দেওয়াল গুলোতে বেশ নকশা তৈরি করেন। ছোট ছোট এইসব ঘটনা গুলো পুজোর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িয়ে আছে।

মিশ্র জনজাতির চির প্রচলিত দুর্গোৎসব:
সমগ্র পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে বাঙালির  শ্রেষ্ঠ মহোৎসব  হিসাবে যে দুর্গাপূজা প্রচলিত, জঙ্গলমহলের পূজাও তার ব্যতিক্রম নয়। এখানেও সেই আলোকসজ্জা, আলোর রোশনাই, প্যান্ডেলের কারুকার্য, পূজা অর্চনা, ঢাকের বোল, সিঁদুর খেলা,দশমীর বিষণ্নতা, খাওয়া দাওয়া, হৈ হুল্লোড় এসব  কিছুই  বেশ ঘটা করে অনুষ্ঠিত হয়। মূলত হিন্দুদের উচ্ছ্বাস বেশি হলেও, আদিবাসীরাও অল্প বিস্তর পুজোয় অংশগ্রহণ  ও আনন্দ লাভ করে থাকেন। বিনোদনের যে নানান ভ্যারাইটি তাও জঙ্গলমহলের পূজা মণ্ডপের সামনে তৈরি হওয়া স্টেজ গুলোতে সংঘটিত হয়। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও ক্রীড়া প্রতিযোগিতা তো পুজোর কদিন এক অন্য মাত্রা বহন করে। ঝুমুর গান হল জঙ্গলমহলের নিজস্ব সম্পদ। নামকরা নামকরা সব ঝুমুর শিল্পী, যেমন অঞ্জলী মাহাত, ইন্দ্রানী মাহাত-র মতো শিল্পীদের গান মাইকে বেজে চলে। সেই সঙ্গে পুজোর কদিন তারা মণ্ডপে মণ্ডপে স্টেজ শো করার জন্যও চরম ব্যস্ত থাকেন। জঙ্গলমহলের বেশ কিছু পূজা প্যান্ডেলের অভিনবত্ব যেমন সকলের  দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে, তেমনি শহরের মণ্ডপ গুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টেক্কাও দিয়ে চলেছে। কোনও কোনও মণ্ডপ তো কারুকার্য ও সৌন্দর্যের অভিনবত্বে জেলা ও রাজ্যের খেতাব পর্যন্ত জিতে নিয়েছে।

শারদীয়ার এই দুর্গোৎসব হল, মাতৃশক্তির একমাত্র আরাধনা। একে শুভ শক্তির জয় ও অশুভ শক্তির পরাজয় বলে মনে করা হয়। এখানে দেবী দুর্গা হলেন দেবত্বের অধিকারী এক নারী শক্তি। দৈব বলে মহিষাসুরের মতো এক অশুভ শক্তিকে  তিনি বিনাশ করেছেন। মহালয়ার কাকভোরে চন্ডী পাঠের মধ্যদিয়ে এই দেবীর শক্তি ও মহিমা সম্প্রচারিত হয়। জঙ্গলমহলও তার ব্যতিক্রম নয়।এখানকার পারিবারিক জীবনে দেবী দুর্গাকে আপন করে নেওয়া হয়েছে। দেবীর বৎসরান্তে একবার পিত্রালয়ে আগমনের কাহিনী এখানকার মেয়েদেরও শ্বশুর বাড়ি থেকে দীর্ঘদিন পর বাপের বাড়িতে আসার কথা মনে করিয়ে দেয়। যা 'দুর্গা' দেবীর সঙ্গে  নিজেদের বাড়ির দুর্গারাও নিবিড় ভাবে সম্পর্কিত। তাই পুজোর সময় কন্যা সন্তানের জন্য বাবা মায়ের আবেগ জেগে ওঠে,  তারা অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়েন। এখানে মাহিষাসুরকে অশুভ শক্তির অধিকারী, বিপদের আশঙ্কা ও ভয়ের প্রতিমূর্তি বলে মনে করা হয়। তিনি ঘৃণিত ও নিন্দার্থের প্রতীক। এমন অশুভ শক্তির বিনাশ ঘটিয়েছেন বলে দেবী দুর্গা আরাধিত পূজিত হন।

জঙ্গলমহলের আদিবাসীদের এক অন্য "দুর্গা" উৎসব:
বিগত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে জঙ্গলমহলের আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষেরা এক ভিন্ন 'দুর্গা' উৎসবে মেতে উঠেছেন। এ উৎসব এক পরাজিত নায়কের ইতিহাসকে স্মরণ। জঙ্গলমহলের আদিবাসী অধ্যুষিত জনজাতি ও খেরওয়াল  সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে শরতের আগমন ও আশ্বিন মাস তাই আনন্দের নয়, বরং বিষাদের, দুঃখের, গ্লানির, পরাভবের।  শরতের এই মনোরম প্রকৃতি শোভা বর্ধন করে না, উল্টে তাদের এক বীর পূর্ব পুরুষের বিরাট পরাজয়ের গ্লানি বহন করে। আপামর বাঙালির আগমনীর সুরমূর্ছনা, আলোর রোশনাই এই সম্প্রদায়ের দুয়ারে দুয়ারে পৌঁছাতে পারে না। এক বিষণ্নতার পরিমণ্ডলে সেই সুর সেই আলো কেবলই ধাক্কা খেতে খেতে ফিরে আসে। তাদের আত্মমর্যাদা আর গৌরবকে ছলনায় পরাস্তকারী অসুর বিনাশিনী আর্য দেবী দুর্গা তাই আজও এদের কাছে চরম উপেক্ষার, অবমাননার। বরং এই সম্প্রদায়ের কাছে যে টুকু গৌরবের, মর্যাদার, বীরত্বের তিনি হলেন, বীর সম্রাট "হুদুড় দুর্গা"(পুং লিঙ্গ/ বীর পুরুষ)। শারদীয়া দুর্গা পূজার কয়েকদিন অসম সাহসী বীর যোদ্ধা এই  "হুদুড় দুর্গা"-কে আদিবাসী খেরওয়াল সম্প্রদায়ের মানুষ শ্রদ্ধা ও সম্মানের সঙ্গে স্মরণ করেন। এই উপলক্ষ্যে তারা দুঃখ উদযাপনের মধ্য দিয়ে,"দশানি" উৎসবে মেতে ওঠেন।

কে এই "হুদুড় দুর্গা?" এর উত্তর জানতে হলে, তাঁকে নিয়ে প্রচলিত ইতিহাসের আখ্যান টুকু জানা জরুরি।

"চাইচম্পা" নামে খেরওয়ালদের একটি নিজস্ব ভুখন্ড ছিল। সেখানকার এক বীর অনার্য রাজা ছিলেন "হুদুড় দুর্গা।" তিনি একদিকে যেমন ছিলেন বীর নেতা,  অন্যদিকে তেমনি ছিলেন বীর যোদ্ধাও। তাঁর নামকরণও বেশ ব্যঞ্জনাময়। সাঁওতালি ভাষায় "হুদুড়" শব্দের অর্থ হল, বজ্রের মতো তেজ বা শক্তি। কিংবা প্রচণ্ড জোরে বয়ে চলা বাতাস বা ঝড়। প্রতিপক্ষকে এভাবেই ঝড়ের বেগে আক্রমন করে অতর্কিতে আঘাত হানতেন,এবং অতি সহজেই জয় হাসিল করতেন। বজ্র গম্ভীর কণ্ঠের অধিকারীও ছিলেন এই বীর যোদ্ধা "হুদুড়।" সাধারণত দুর্গ রক্ষাকারীকে বলা হয় 'দুর্গা'। চাইচম্পা কে তিনি দুর্গের মতোই  সুরক্ষিত ও আগলে রাখতেন বলেই হয়তো তাঁর নাম হুদুড় দুর্গা। সাঁওতালি লোকগাথা অনুযায়ী আর্যরা খেরওয়াল ভুখন্ড চাইচম্পা আক্রমন করেই এদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করেন। কিন্তু বীর নেতা হুদুড় দুর্গা বহিঃশত্রু আর্যদের গতিমুখে স্বরাজ্য ও প্রজা সুরক্ষায় প্রবল বাধা হয়ে দাঁড়ান। অসীম সাহস আর যুদ্ধের নিপুণ কলা কৌশলে আর্যদের বারবার তিনি পরাজিত করেন। তাদের সমস্ত প্রচেষ্টা আর প্রত্যাশাকেও বারবার ব্যর্থ করেন। চালাক ও চতুর আর্যরা এমতাবস্থায় উপলব্ধি করলেন যে, হুদুড় দুর্গার সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধে কোনও ভাবেই জয়লাভ করা সম্ভব নয়। তাইএটা জানার পর তারা হুদুড়ের চরম দুর্বলতার জায়গা গুলো অনুসন্ধান করতে লাগলেন। বেশ কিছুদিন গভীর অনুসন্ধানের পর বুদ্ধিমান আর্যরা আবিষ্কার করলেন, হুদুড় দুর্গা ও তার অনুগামীরা নারী জাতিকে অত্যন্ত সম্মান করেন। তারা কখনও আশ্রিতের সাথে, শিশুর সাথে, রাত্রিতে এবং নারীর সঙ্গে কোনও মতেই যুদ্ধ করেন না। এমনকি হুদুড় দুর্গা রাত্রিতে শয়ন কক্ষে সমস্ত অস্ত্র খুলে ফেলেন এবং অন্যত্র তা সরিয়ে রাখেন। সে সময় তার কোনও দুর্ধর্ষ রক্ষী বাহিনীও পাহারাতে থাকেন না। হুদুড়ের এই দুর্বলতার সুবর্ণ সুযোগ আর্য নেতারা গ্রহণ করলেন। দুরভিসন্ধির দ্বারা তারা এক চক্রান্ত ও ছলনার আশ্রয় নিলেন। তাদেরই এক গৌরবর্ণা লাস্যময়ী বীরাঙ্গনা নারী "দেবী"- কে  হুদুড়ের সঙ্গে বিবাহের প্রতিশ্রুতি দিয়ে সন্ধির প্রস্তাব পাঠালেন। প্রাথমিক অবস্থায় হুদুড় দুর্গা নিমরাজি হলেও পরবর্তী কালে সে প্রস্তাব গ্রহণ করেন, এবং আর্য সুন্দরী নারী দেবীকে বিবাহ করেন। অবশেষে পরিকল্পনা মতো নবমীর রাত্রিতে হুদুড় দুর্গাকে "দেবী" প্রবল ভাবে কামাসক্ত ও সুরাসক্ত(যিনি ইতিপূর্বে কখনও সুরা পান করেননি) করে তোলেন। একসময় হুদুড় দুর্গা অচৈতন্য হয়ে পড়লে, আর্য নারী "দেবী" তার বুকে খঞ্জর বসিয়ে হুদুড় দুর্গাকে হত্যা করেন। কথিত আছে যে, হুদুড় দুর্গাকে হত্যা করার জন্যই ওই "দেবী" নামক নারীর নামকরণ হয় "দেবী দুর্গা।"

"শুভ শক্তির জয় ও অশুভ শক্তির বিনাশ"--- দুর্গা পূজার সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে থাকা এই আপ্ত বাক্যটিও আদিবাসী সম্প্রদায়ের কাছে সম্পূর্ণ বিপরীত অর্থ বহন করে। তাদের কাছে আর্য দেবী দুর্গা হলেন, সমস্ত অশুভ শক্তির অধিকারী। তাদের হুদুড় দুর্গার মতো রক্ষাকর্তাকে তিনি ছলনার দ্বারা হত্যা করেছেন। এবং তাদের সহজ সরল হাসি খুশি জীবনে হঠাৎ করে অন্ধকার নিয়ে এসেছেন। হুদুড়ের মৃত্যুতে তাদের একমাত্র মাতৃতান্ত্রিক সাম্য সভ্যতার তিনি পতন ঘটিয়েছেন। তাই তাদের কাছে দেবী দুর্গা অশুভ। বরং শুভ শক্তি হলেন বীর হুদুড় দুর্গা। এই হুদুড় দুর্গাই হলেন বাঙালির মহিষাসুর। "অসুর" শব্দের উৎপত্তি 'অস্' ধাতু থেকে এসেছে। যার অর্থ হল,শক্তি, ছোড়া বা এগনো। "অসুর" শব্দের অন্য আরও একটি  তাৎপর্যময় অর্থ আছে। অ-সুর অর্থাৎ যিনি সুরা বা মদ্যপান করেন না। এই অনার্য সম্প্রদায়ের মানুষেরা পূর্বে কখনও সুরা পান করতেন না।তাই তারা ছিলেন অসুর। অন্যদিকে "সুর" হলেন বিদেশি আর্যরা।যারা সুরা বা মদ্যপান করতেন। প্রবল পরাক্রমশালী হুদুড় দুর্গা পুরু, যদু, তরবাসা প্রভৃতি আর্য গোষ্ঠীকে বারংবার পরাজিত করায় আর্যরা তাকে "অহুর" বলে আখ্যা দেন। যার অর্থ অসীম ক্ষমতার অধিকারী। এই "অহুর" শব্দটি "অসুর" শব্দেরই নামান্তর। সাঁওতালি লোককথা অনুযায়ী হুদুড় দুর্গা বা মহিষাসুরের যোগসূত্র  পুরাণেও পাওয়া যায়। "দেবীপুরাণ" ১ম অঃ-তে রম্ভাসুরের পুত্র ঘোরাসুর ছিলেন কুশদীপের অধিপতি। মানবতাবাদী এক বীর যোদ্ধা। কথিত, এই ঘোরাসুরই হলেন মহিষাসুর। সর্বগুণ সম্পন্না নারীকে যেমন "মহিয়সী" নামে ভূষিত করা হয়, ঘোরাসুরকেও তেমন "মহিষ" বা "মহীয়স" শব্দ (মহিষ + অসুর) যোগে মহিষাসুর উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছে। বীর যোদ্ধা ছিলেন এই ঘোরাসুর বা মহিষাসুর। সুতরাং ঘোরাসুর মহিষাসুর হুদুড় দুর্গার মধ্যে আদিবাসী খেরওয়াল সম্প্রদায়ের মানুষ কোনও অশুভ শক্তির ছায়া খুঁজে পাননি। বরং তার মধ্যে সুরক্ষা দানকারী শুভ শক্তির এক আলোকছটা প্রত্যক্ষ করেন।

হিন্দু বাঙালিরা পুজোর দিনগুলোতে যখন উচ্চকিত ডিজের সাউন্ডে, ঢাকের বোলে, ঘন্টা ধ্বনিতে, নাচে গানে, যাত্রা পালায়, জলসায় মেতে থাকেন, তখন নীরবে আদিবাসী খেরওয়াল সম্প্রদায়ের মানুষেরা "দাঁশায়" ব্রতের মধ্য দিয়ে তাদের বীর হুদুড় দুর্গার প্রতি শোক জ্ঞাপন করে থাকেন। পুজোর সময় এই "দাঁশায়" নাচ হল জঙ্গলমহলের এক অন্যতম উল্লেখযোগ্য আদিবাসী নৃত্য।

কী এই দাঁশায় নৃত্য? আদিবাসী সম্প্রদায়ের পুরুষেরা নারীর পোশাককে বেশ সুসজ্জিত ভাবে ধুতির মতো করে পরে ঘুরে ঘুরে একটি নির্দিষ্ট পায়ের ছন্দে  তালে তাল রেখে রেখে এই নৃত্য করে থাকেন। অপূর্ব ঢঙে মাথায় গোঁজেন ময়ূরের পালক। যা মুকুটের মতো শোভা বাড়ায়। হাতে থাকে ভুয়াং বাদ্য যন্ত্র। লাউয়ের শুকনো খোলে ধনুকের টঙ্কার জুড়ে এমন বাদ্যযন্ত্র তৈরি করা হয়। সেটিকে আবার রঙিন কাগজের নকশা দিয়ে সাজানো হয়। ভুয়াং বাদ্যযন্ত্র সহযোগে এমন নৃত্য পরিবেশিত হয় বলে একে "ভুয়াং নাচ"ও বলা হয়। এছাড়াও কাঁসর, থালা প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্র সহযোগে ঘুরে ঘুরে "হায়রে!হায়রে!" শোক ও দুঃখের ধ্বনি তুলে তুলে এই নৃত্য পরিবেশিত হয়। গানের সুরে তারা কেবল শোক প্রকাশ করেন না , কীট পতঙ্গ,উদ্ভিদ প্রাণী সবাইকে প্রশ্নও করেন যে, তাদের বীর যোদ্ধা হুদুড় দুর্গা বা মাহিষাসুরকে কেউ দেখেছে কিনা--- 
"অকারে দ ভুয়াং এম জানাম লেনা রে?
অকারে দ ভুয়াং এম বুঁসাড়লেনা রে?"

জঙ্গলমহলের  মাহাতো কুর্মি সহ অন্যান্য আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষও দুর্গাপূজার সময় "কাঠি নাচ" বলে এক ধরণের নৃত্য পরিবেশন করে থাকেন। হাতে সবসময় কাঠি না থাকলেও হাতে রুমাল নিয়ে পুরুষেরা নারীদের পোশাকে অপরূপ সৌন্দর্যে সেজে ওঠেন। মাদল, করতাল, হারমোনিয়াম, ঝুনঝুনি প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্রের সমাহারে, দুই পা সামনে আর পিছনে অদ্ভুত রীতিতে  আগে পিছে সরিয়ে সরিয়ে কোমর দুলিয়ে গানের ছন্দে, ঘুরে ঘুরে অপরূপ দক্ষতায় নাচ করেন । মূল গায়ক ও দোহারীদের কণ্ঠেও দুঃখের প্রলাপ "হায়!হায়!"রব ধ্বনিত হয়। মনে করা হয় যে, এই নৃত্যের মধ্য দিয়েও হুদুড় দুর্গার করুন পরিণতিকে দুঃখের সঙ্গে স্মরণ করা হয়।

 নারীর পোশাকে পুরুষদের কেন এমন নাচ গান? তবে কি গভীর কোনও উদ্দেশ্য আছে? আসলে এ নিয়ে নানান মতভেদ ও একাধিক মতবাদ প্রচলিত রয়েছে। অনেকে মনে করেন, আর্যদের প্রবল আক্রমণে দিশাহারা আদিবাসী সম্প্রদায়ের পুরুষেরা আত্মরক্ষার্থে  এভাবেই নারীর পোশাকে সেজে উঠে নৃত্য পরিবেশন করতে করতে কোনও রকমে পালিয়ে গঙ্গার এপারে  চলে আসেন। আর্যরা যেহেতু নারীদের  কখনো কোনও ধরনের আক্রমণ করেননি, তাই আত্মরক্ষার কৌশল হিসাবে এই নৃত্য রীতি প্রচলিত হয়ে থাকতে পারে। আবার অনেকে বলেন, এই দাঁশায় নৃত্যের মধ্য দিয়ে তাদের প্রিয় বীর রাজা হুদুড় দুর্গা বা মহিষাসুরের মৃত্যর কারণে শোক জ্ঞাপন বা দুঃখ প্রকাশ করা হয়ে থাকে। বাড়িতে বাড়িতে তারা এই শোকগাথা "হায়রে!হায়রে!" সুরে বর্ণনা করতে করতে সামান্য কিছু ভিক্ষা করেন। যদিও কোনও রূপ ভিক্ষা করা আদিবাসী সম্প্রদায়ের কাছে অত্যন্ত রীতি বিরুদ্ধ ব্যাপার। তবুও পুজোর এই কটা দিন তারা মাগণ করে থাকেন। অন্য আর একপক্ষ বলেন,  এভাবেই কাঠি নাচ ও দাঁশায় নাচের মধ্য দিয়ে তাদের বীর হুদুড় দুর্গাকে তারা খুঁজে বেড়ান। ভিক্ষা বা মাগণ করে যেটুকু অর্থ -চাল আদায় হয়, পুজোর পর কোনও একদিন সেই চাল ও টাকা দিয়ে সকলে মিলে আনন্দ সহকারে খাওয়া দাওয়া করেন।
হিন্দুদের দুর্গা পুজোয় প্রতিষ্ঠিত হয় দেবতাবাদ। যিনি দেবী দুর্গা তিনি হলেন, দৈব শক্তির অধিকারী। তিনি আরাধিত ও পূজিত হন। অন্যদিকে রাজা হুদুড় দুর্গা হলেন একজন বীর পুরুষ। যিনি যথার্থই মানবতাবাদী। তিনি আরাধিত বা পূজিত নন, কারণ তিনি মানুষ। এ প্রসঙ্গে খেরওয়াল আদিবাসী অ্যক্টিভিস্ট অজিত প্রসাদ হেমব্রম "আয়নানগর" নামে  লিটল ম্যাগাজিনে এক সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে  হুদুড় দুর্গা সম্পর্কে বলেছেন --
"হুদুড় দুর্গা কোনো ঈশ্বর নন যে আমরা তাঁর পূজা করব। তিনি ছিলেন আমাদের রাজা। আমরা পাঁচ দিন ধরে তাঁর জন্য শোক পালন করি। আমরা তাকে হোড় বলি। হোড় মনে হল মানুষ। আদিম মানুষ।"
এখানে তাই মানবতার জয়গান গাওয়া হয়।

সুতরাং জঙ্গলমহলের দুর্গোৎসব মানে একই সঙ্গে দেব বন্দনা ও মানবতার জয়গান। আর এ দুটোই  স্বাধীন ভাবে নিজেদের মতো করে পালিত হয়ে চলেছে।
----------------------------------------
আপনিও পাঠাতে পারেন আপনার গদ্য। পুজোর গদ্য।  jaladarchi@yahoo.in    

Post a Comment

0 Comments