Editor: Struggling for sacrifice and patience
সম্পাদক: ত্যাগ ও ধৈর্যের সংগ্রামী
সূর্যকান্ত মাহাত
যদি সম্পাদককে একটি মুদ্রা ধরে নেওয়া যায়, তাহলে ওই মুদ্রার দুই পিঠ হলেন, যথাক্রমে লেখক ও পাঠক। পাঠক কেবল পাঠ করেন। কিন্তু কী পাঠ করবেন? না, সেটিই পাঠ করবেন, যে পাঠটি সম্পাদক তার কাছে সুন্দর ভাবে সম্পাদিত করে উপস্থাপন করবেন। সুতরাং লেখক ও পাঠকের থেকেও সম্পাদকের দায়বদ্ধতা অনেক বেশি। উনি স্বপ্ন দেখেন একটা বড় প্রাসাদ বানানোর, লেখক হলেন সেই প্রাসাদের ইঁট, কাঠ, বালি, সিমেন্ট। আর পাঠক হলেন, সেই বাড়ির আশ্রিত। লেখক তাঁর সৃজনী শক্তির জল হাওয়ায় যে ফসল উৎপাদন করেন, সম্পাদক সেটাই সযত্নে পাঠকের দরবারে সুচারু রূপে পৌঁছে দেন।
একজন সম্পাদকের দুই অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টি শিকারীর মতোই সর্বদায় প্রদক্ষিণ করে চলে আমাদের চারিপাশ। এভাবেই তিনি একটি ভালো লেখাকে অণুবীক্ষণ যন্ত্রের মতোই আবিষ্কার করেন। অনেকটা "যেখানে দেখিবে ছাই, খুঁজিবে সেখানে তাই, পাইলেও পাইতে পার অমূল্য রতন"-- এর মতোই। সুতরাং সম্পাদক একজন ভালো লেখা ও লেখকের আবিষ্কারকও বটেন। শুধু কি তাই? সম্পাদক হলেন, লেখকের প্রথম পাঠক ও সমালোচক। উনিই তাঁর দূরদর্শিতা ও বিচক্ষণতার মাপকাঠি দিয়ে লেখার গভীরতা মাপেন। লেখাটি কতটা ওজনদার, ধারে ও ভারে কতটা তীক্ষ্ণ ও গভীর, সেটাই ঝটপট পরিমাপ করার অলৌকিক ক্ষমতা সম্পাদকের একটি বড় গুণ। আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে একজন লেখকের লেখক হয়ে ওঠার প্লাটফর্ম বা মঞ্চ তিনিই গড়ে তোলেন। তিনি হলেন লেখকের সিঁড়ি। যেটাতে চড়ে তিনি অতি সহজেই পাঠকের দরবারে পৌঁছে যান।
সম্পাদনা বেশ কঠিন একটা কাজ। সম্পাদক অনুসন্ধানী হয়ে বেশ নৈপুণ্যের সঙ্গে যেমন লেখক তুলে আনেন, তেমনি তাঁর আদর্শ ও দর্শন অনুযায়ী একটি লেখক গোষ্ঠীও গড়ে তোলেন। কেবল এটুকুতেই তাঁর সীমাবদ্ধ থাকলে চলে না। পাঠকের মধ্যে আগ্রহ ও কৌতূহল জাগিয়ে তুলে একটা পাঠক বর্গও তাঁকে গড়ে তুলতে হয়। তাঁর মহৎ উদ্দেশ্য, লক্ষ্য ও দর্শনকে পাঠকের মধ্যে চারিয়ে দিতে হয়। লেখক গোষ্ঠীর বিভিন্ন লেখা ও মতাদর্শের বৈচিত্র্যে পাঠক কুলকে সমৃদ্ধ ও সচেতন করে গড়ে তোলা সম্পাদকের অন্যতম প্রধান কাজ।
তবে লাখ টাকার প্রশ্নটা হল, সম্পাদক কি পাঠকের রুচি বা চাহিদাকে গুরুত্ব দিয়ে সম্পাদনা করবেন? নাকি, সম্পাদকের রুচি ও চাহিদা বা দর্শনকে পাঠক গুরুত্ব দিবেন? না, দুটোকেই সম্পাদক গুরুত্ব দেবেন, সম্পাদক মহাশয় তাঁর অভিজ্ঞতা দিয়ে সেটা ভালোভাবে উপলব্ধি করে থাকেন।
সম্পাদকের এমন উপলব্ধি পাঠকের শ্রেণীবিভাজনের সূত্র ও রীতি অনুযায়ী ঘটে থাকে। যেমন কিছু পাঠক অশ্লীলতা, রগরগে কাহিনী, প্রবল আবেগ মাখা লেখা অধিক পছন্দ করেন। কিছু আবার এর প্রবল বিরোধী। একশ্রেণী দুটোকেই ব্যালান্স করে চলা পছন্দ করেন। তবে বিশেষ এক শ্রেণীর পাঠক আছেন যাঁরা বিষয় অনুযায়ী বিজ্ঞান, সাহিত্য, বিনোদন প্রভৃতি নিজ নিজ পছন্দ অপছন্দকেই বেশি মান্যতা দেন। আসলে পাঠকের রুচি অনুযায়ী সম্পাদনা করতে হলে, সম্পাদককে খিচুড়ির নির্ভরতা গ্রহণ করতে হয়। পূজা সংখ্যাগুলোতে যেটা হয়ে থাকে। এধরনের সম্পাদনায় পাঠকের মানোরঞ্জনকেই অধিক মান্যতা দেওয়া হয়। নিজস্ব দর্শন কতটা উপস্থিত থাকে সেটা নিয়ে একটা বিতর্ক থেকেই যায়। সম্পাদকের মধ্যে যদি একটি বিরাট অর্থনৈতিক লাভের বিষয় যুক্ত থাকে, তাহলে পাঠকের রুচি ও চাহিদাকে গুরুত্ব দিতেই হয়। কিন্তু সম্পাদকের দর্শন বা বিষয়গত লক্ষ্যটা বড় হয়ে উঠলে, পাঠককে নিয়ে ভাবতে হয় না। পাঠক নিজে থেকেই আগন্তুক হয়ে এসে পড়ে।
যেমন "কল্লোল" সম্পাদক মহাশয় রবীন্দ্র বিরোধিতাকে লক্ষ্য বা বিষয় করে পত্রিকাটি গড়ে তুলেছিলেন। এক শ্রেণীর পাঠক এর তীব্র বিরোধিতাও শুরু করেছিলেন। তাতে কি কল্লোলের পাঠক সংখ্যা শুন্য হয়ে পড়েছিল? না, বরং নতুন এক পাঠক শ্রেণী গড়ে উঠেছিল। আবার সবুজপত্র তো সাধু গদ্যের প্রচলিত রীতিকে পদাঘাতে ছিন্ন করে চলিত গদ্যের দুয়ার খুলেছিলেন। তৎকালীন সময়ে গেল গেল রব উঠলেও প্রমথ চৌধুরীর নিজস্ব দর্শন ও বিষয় উপস্থাপনকে পাঠক সাগ্রহ চিত্তেই গ্রহণ করেছিলেন। তাই সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে অবিচল থাকলে অন্য শ্রেণীর পাঠক তো হারাবেনই। যেমন স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় গড়ে ওঠা বিপ্লবী পত্রিকাগুলো সব শ্রেণীর পাঠকের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি। তাই প্রতিটি পত্র পত্রিকা ও লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদকের একটা নিজস্ব দর্শন থাকে। তাদের নিজস্ব পাঠক শ্রেণীও আছেন। তাই অন্য শ্রেণীর পাঠক ধরতে গেলে সম্পাদকের লক্ষ্যচ্যুত হয়ে পড়ার প্রবল সম্ভাবনা তৈরি হয়।
সম্পাদকের কাছে সবচেয়ে বড় জিনিস হল, 'বিষয়'। বিষয়ের অভিনবত্ব সবার উপরে,এমনটাই মনে করেন, যিনি প্রকৃত সম্পাদক। কারণ, তিনি পাঠক ও সম্পাদক এই বিষয়কেই সর্বাগ্রে মান্যতা দেন। বিষয়ের বৈচিত্র্যতা অন্য মাত্রা বহন করে। আর এখানেই সম্পাদকের বাহাদুরিত্বের পরিচয় মেলে। তাঁর দূরদর্শিতা, চয়ন ক্ষমতা, অভিনবত্ব সবই যেন একই সুতোই বাঁধা।
একটি লেখা যতটা না লেখকের, তার থেকেও বেশি সম্পাদকের। কারণ উনিই সেটা পাঠকের দুই চোখের সামনে মেলে ধরেন। ভুল বানান, ভুল বাক্য, অতিকথন, পুনরুক্তি এসব কিছুই তাঁকে মন ও মনন দিয়ে পুনর্বিন্যাস করতে হয়। শ্রম দিয়ে দিয়ে তাকে মৃন্ময়ী থেকে চিন্ময়ী করে গড়ে তুলতে হয়। তাই কোনও লেখা 'লেখা' হয়ে উঠতে না পারলে সেই কষ্ট শুধু একা লেখকই পান না, সম্পাদকও পান। বরং অনেক বেশি পান। অনেক সময় প্রশংসার মিষ্টি মিষ্টি কথায় যেমন আপ্লুত হন, তেমনি নিরন্তর সমালোচনার বিষ বাক্যে জর্জরিতও হতে হয় সম্পাদককে। কত কত সময় লেখকের বিরাগভাজনও হয়ে পড়েন। অনেক সময় আবার ভেঙেও পড়েন। কবিগুরুও এর বাইরে ছিলেন না। যে রবীন্দ্রনাথ "সাধনা"র সম্পাদকের দায়িত্ব নিয়ে লিখেছিলেন,
"সাধনা আমার হাতের কুঠারের মতো, আমাদের দেশের বৃহৎ সামাজিক অরণ্য ছেদন করবার জন্যে একে আমি ফেলে রেখে মরচে পড়তে দেব না---একে আমি বরাবর হাতে রেখে দেব। যদি আমি আরও আমার সহায়কারী পাইতো ভালোই না পাইতো কাজেই আমাকে একলা খাটতে হবে।"
সেই তিনিই হতাশ হয়ে "ভারতী"র সম্পাদক পদ থেকে বিদায় বেলায় লিখলেন,
"আমাদের দেশের সম্পাদকদের পত্রসম্পাদন হাল গোরুর দুধ দেওয়ার মত,--- সমস্ত দিন ক্ষেতের কাজে খাটিয়া কৃশ প্রাণের রসাবশেষটুকুতে প্রচুর পরিমানে জল মিশাইয়া যোগান দিতে হয়।"
সমালোচনার এমন অভিঘাত, নানান প্রতিবন্ধকতার পরেও সম্পাদককে অবিচল থাকতে হয়। সম্পাদনা কেবল পেশা নয়, নাহলে একটা সময় ক্লান্তি এসে ধরা দেবে। হতাশা গ্রাস করবে। অভিনবত্ব ও সৃষ্টির আবিষ্কারে ভাটা পড়বে। তাই সম্পাদনা হল নেশা,প্রেম, ভালোলাগা, আনন্দ আর সবচেয়ে বড় হল আত্মতৃপ্তি। তাই বলে কি কষ্ট নেই! আছেতো! এই জন্যই তো সম্পাদক মানে ত্যাগ ও তিতিক্ষার আর এক নাম। অসীম ধৈর্যের পরীক্ষা দিয়ে চলা এক যাত্রী।
2 Comments
Your amazing mind. Thanks for your Post ☺️☺️
ReplyDeleteধন্যবাদ
ReplyDelete