জ্বলদর্চি

আফ্রিকার লোকগল্প (Folk-tale of Africa)

                       

দূর দেশের লোকগল্প (আফ্রিকা)


চি ন্ম য়  দা শ

সেই লোকটা, যে কখনো মিথ্যে কথা বলেনি 


অতি সাধারণ এক মানুষের গল্প এটি। শহর-নগর বলো, বা ধরো, হাট-বাজার-গঞ্জ-- সবকিছু থেকে অনেক অ-নে-ক দূরে বাস করত লোকটি। পাহাড়-জঙ্গল পেরিয়ে যেতে হয় তার গাঁয়ে। একেবারে সাধারণ আটপৌরে জীবন লোকটার। চাল বা চুলো, নিজের বলতে তেমন কিছুই নাই। দু'বেলা দু'মুঠো জুটিয়ে নেয় কোনরকমে।
তবে, থাকবার মধ্যে একটা জিনিস ছিল লোকটার-- সুনাম। এলাকার লোকেরা তাকে জ্ঞানী বলে জানত। আর জানতো, কখনো মিথ্যে কথা বলে না সে। শুধু কি নিজের এলাকা? কুড়ি-পঁচিশ দিন দূরের গ্রামের লোকেরাও জানত। দূর মানে, পাহাড়-জঙ্গল ডিঙিয়ে যেসব গ্রামে পৌঁছাতে কুড়ি-পঁচিশ দিন লেগে যায়, তারাও জানত কথাটা। 
তা হল কী, রাজা জানতে পারল লোকটার কথা। সবাই জানে, রাজারা তো কান দিয়েই দেখে। এক চর এসে রাজার কানে তুলে দিল কথাটা।
একটুও উচ্চ-বাচ্য করলো না রাজা। গুম হয়ে রইলো সারাটা দিন। দরবার সেরে ভেতর মহলে এল, সেখানেও মুখে কথাটি নাই। রানী ভাবল, হল কী মানুষটার? জিজ্ঞেস করল-- "কী হয়েছে গো? মুখ অমন গোমড়া কেন?"
বেশি কিছু ভাঙল না রাজা। যতটুকু না বললে নয়, ততটাই বলল রানীকে। শেষে বলল-- " দেখাচ্ছি মজা ব্যাটাকে।"
পরদিন। ভরা দরবার। মন্ত্রীকে হুকুম দিয়ে রাজা বলল-- "লোক পাঠাও। কালই এই দরবারে দেখতে চাই হতভাগাকে।"
মন্ত্রীর তো আকাশ ভেঙে পড়ল মাথায়। সে গ্রাম কি এখানে? কম করে আট-দশ দিনের পথ। কালকেই আনা যাবে কী করে? এদিকে ভয়, রাজা চটে গেলে রক্ষে নাই। যা খামখেয়ালি মানুষ, কখন কী করে বসে, তার নাই ঠিক।
একটা বুদ্ধি এল মন্ত্রীর মাথায়। ঘোড়াশালে গিয়ে দুটো তেজি ঘোড়া বার করল। একটাতে এক সেপাই রওনা হোল। খালি ঘোড়াটা চললো তার সাথে সাথে। 
যেমন কথা তেমন কাজ। পরদিন দরবারে হাজির করা হল লোকটাকে। 
রাজার তলব পেয়েই আক্কেল গুড়ুম হয়ে গিয়েছিল লোকটার। কিসের জন্য, কেন তলব-- কিছুই মাথায় ঢোকেনি বেচারার। এখন এই ঝলমলে প্রাসাদ, গমগমে ভরা দরবার, সেপাই-সান্ত্রী, লোক-লস্কর দেখে চোখ কপালে উঠে গেল একেবারে।
রাজার একেবারে সামনে এনে দাঁড় করানো হয়েছে। তার পা থেকে মাথা পর্যন্ত চোখ বুলিয়ে জরিপ করল রাজা। গম্ভীর গলায় বললো-- "শুনলাম, তুমি নাকি ভারী জ্ঞানী মানুষ!" 
কী-ই বা জবাব হয় এ কথার। চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল লোকটা। 
এবার রাজা বলল-- "তুমি নাকি মিছে কথা বলো না। এ কথা সত্যি?" 
মানুষটার তো গলা শুকিয়ে কাঠ, জবাব দেবে কী করে? কোন রকমে একটু মাথা নড়ল-- হ্যাঁ।
জবাব পেয়ে, রাজার মুখ গম্ভীর। বললো-- "ঠিক আছে। ক'দিন থাকো রাজবাড়িতে। পরখ করে দেখি ব্যাপারটা। জেনে রাখো, মিছে কথা বলেছ, কি জিভখানা কেটে নেওয়া হবে তোমার।"
লোকটা রাজবাড়িতে থাকে, খায়-দায়, ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু সবসময় একটা ভয় গুড়গুড় করে বুকের ভেতর। সাতদিন বাদে ডাক পড়ল রাজার কাছে। রাজবাড়ীর দেউড়ির কাছে লোকজন ভিড় করে আছে। কী, না রাজা শিকারে যাবে। জিন চাপানো হয়েছে ঘোড়ার পিঠে। হাতে লাগাম, বাম পা রেকাবে তুলে, রাজা দাঁড়িয়ে আছে। 
লোকটা আসতেই রাজা বললো-- " শোন হে, একবার ভেতর মহলে যাও। রাণীমাকে বলো, আমি শিকারে যাচ্ছি। ফিরে এসে দুপুরে খাব একসাথে।  আর শোন, আজ তুমিও খাবে আমাদের সাথে।"
মাথা ঝুঁকিয়ে বাধ্য ছেলের মত চলে গেল লোকটা। অমনি রাজার সে কী হাসি। লাগাম ফেলে দিল হাত থেকে। পা নামিয়ে নিল, মাথার পাগড়ি খুলে, বলল-- "আজ শিকারে যাচ্ছি না আমরা। তার মানে, রানীকে গিয়ে মিছে কথা বলবে লোকটা। কাল মজা দেখাব বাছাধনকে।" 
কিন্তু এদিকে ব্যাপার হোল অন্য রকম। হোলই বা রাজা, সবই কি আর তার ছক মত হয়? লোকটা ভিতর মহলে গিয়ে রানীকে বললো-- "রাজামশাই দুপুরে একসাথে খাওয়ার কথা বলেছে। এখন রান্না আপনি করবেন, কি করবেন না, সে আপনার মর্জি।"
রানীর তো কিছুই ঢুকলো না মাথায়। বললো-- "খোলসা করে বলো তো বাপু, রাজা আসবে, না কি আসবে না?"    
"সেটা আমি বলবো কী করে?" লোকটা বললো-- "আমি তো হুকুম নিয়ে চলে এলাম। তার পর রাজামশাই ডান পা তুলে ঘোড়ায় চাপলো, না কি বাম পা নামিয়ে নিলো মাটিতে, সেটা তো আমি দেখিনি। দেখার কথাও নয় আমার।"
সেদিন রান্না-বান্না করে সবাই বসে রইলো রাজার জন্য। দিন গিয়ে সন্ধ্যা হলো। রাতও কেটে গেলো। রাজা এলো একেবারে পরের দিন সকালে।
সোজা রানীর কাছে গিয়ে রাজা বললো-- "কী, কাল মিথ্যে কথা বলেছে তো জ্ঞানী আর সত্যবাদী মানুষটা?"
রানী বললো-- "না তো, মিথ্যে বলবে কেন?"
এবার রাজার মাথায় হাত। চমকে গিয়ে বললো-- "কী বলেছে তোমাকে লোকটা?" 
রানী জানালো-- "রান্নার কথা বলেছে আমাকে। তবে সেইসাথে সে বলেছে-- 'তুমি ঘোড়ায় চড়ে সত্যি শিকারে গিয়েছ, না কি রেকাব থেকে পা নামিয়ে নিয়েছ, সেটা সে দেখেনি। জানেও না। মিথ্যে নয় তো কথাটা।"  
রাজার মুখে রা-টি নাই। সোজা দরবারে গিয়ে হাজির হলো।
আবার ডাক পড়লো লোকটার। ভরা দরবার। সবাই মুখিয়ে আছে, কী হুকুম হয় রাজার, শোনবার জন্য। 
রাজা বললো-- " লোকটি কিন্তু মিথ্যে বলেনি রানীকে। আসলে, হিসাবে ভুল হয়েছিল আমারই। বুঝতে পারিনি, জ্ঞানী মানুষ কখনও মিথ্যে বলে না। ততটুকুই বলে, যতটুকু তার নিজের চোখে দেখা।"
এবার দেখা গেল, রাজার আর এক রূপ। লোকটাকে বললো-- " ওই অজ গাঁয়ে ফিরে আর কাজ নাই তোমার। আমার এই দরবারে থাকো তুমি। পরামর্শ-টর্স দিও আমাকে। যাতে ন্যায়বিচারটা ঠিকঠাক করতে পারি। তোমার খাওয়া-পরার খরচ আমার।"
যে কেউ এমন কথা লুফে নেবে। লোকটা কিন্তু মোটেই আহ্লাদে গলে গেল না। শান্ত গলায় বললো-- "সারা জীবন কারও দয়ার অন্ন খাইনি আমি। খাবোও না কোনদিন।"
সারা দরবার বোবা হয়ে গেল ভয়ে। রাজার মুখের ওপর কথা ! এত আস্পদ্দা একটা গেঁয়ো মানুষের। মগজেও কি নাই কিছু? এমন সুযোগ কেউ পায়ে ঠেলে কখনও ! 
রাজার মুখেও কথা নাই কোনও। তবে, রাগও নাই। বরং যেন খুশিই মনে হচ্ছে। রাজা হুকুম করলো—“একটা ঘোড়া দিলাম তোমাকে। দান হিসাবে নয় হে, পুরস্কার। মিথ্যে কথা বলো না, সেজন্য। মাথা না নামিয়ে কথা বলতে পারো, সেজন্যও। আর দেওয়া হল পাঁচখানা গ্রাম। ঘোড়াটার দানা জুট যাবে তা থেকে। তবে, একটা কথা বলি, মাঝে মাঝে এস আমার দরবারে। মনে বল পাবো, তোমাকে চোখে দেখলে।"
যেমনটি আনা হয়েছিল, ঘোড়ায় চাপিয়ে গ্রামে পৌঁছে দেওয়া হল লোকটাকে।
সেই থেকে সুখে-শান্তিতেই আছে লোকটা। তবে, মাঝে-মধ্যে রাজসভায় যায় কি না, খোঁজ নেওয়া হয়নি আমাদের !
অলংকরণ - শ্রেয়সী ভট্টাচার্য্য
---------------------------------------

Post a Comment

0 Comments