জ্বলদর্চি

সিগমুন্ড ফ্রয়েড (Sigmund Freud) ও আত্মানুসন্ধান

 
সিগমুন্ড ফ্রয়েড ও আত্মানুসন্ধান


ঋ ত্বি ক  ত্রি পা ঠী 

সিগমুন্ড ফ্রয়েড (Sigmund Freud)। ১৮৫৬ সালের ৬ মে মোরাভিয়ার ফ্রাইবার্গ-এ জন্ম। বাবা জ্যাকব ফ্রয়েড গোঁড়া ইহুদী অথচ ফ্রয়েড ছিলেন সংস্কারমুক্ত। ১৮৮১ সালে চিকিৎসা শাস্ত্রের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ব্রুকের শরীরতত্ত্ব গবেষণাগারে ডেমনস্ট্রেটর পদে যুক্ত হন। ১৮৮৫ সালে বৃত্তি নিয়ে প্যারিসে স্নায়ুতন্ত্রের ওপর গবেষণা করেন। ১৮৮৬ সালে প্রেমিকা মার্থা বার্নেস-কে বিয়ে করেন। ১৮৯১ সালে প্রকাশ পায় 'বাকরোধ'(Aphasia) নামে তাঁর বই। ১৯০০ সালে প্রকাশ পায় 'স্বপ্ন ব্যাখ্যা'(The Interpretation of Dreams)। ক্রমে ক্রমে তাঁর আন্তর্জাতিক খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। তবে তাঁর যৌন মতবাদের বিষয় অনেকেই সহজে গ্রহণ করেননি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও তার পরিণাম দেখে ফ্রয়েডের মধ্যে আসে চিন্তার পরিবর্তন। তিনি বুঝতে পারেন সব মানুষের মধ্যেই মৃত্যুর প্রতি প্রবৃত্তিগত এক আকর্ষণ আছে। আর সেই প্রবৃত্তি নিয়েই তিনি লেখেন -- 'বিয়ন্ড দি প্লেজার প্রিন্সিপলস'(Beyond the Pleasure Principle)। ১৯০৯ সালের পর থেকে দেখা দেয় আর্থিক সংকট ও শারীরিক অসুস্থতা। ১৯২৩ সালে তাঁর ক্যান্সার ধরা পড়ে। ১৯২৬ সালের ২৬ অক্টোবর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটে, ভিয়েনাতে। ১৯৩৯ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর তাঁর প্রয়াণ ঘটে।

মনােবিদ্যায় পথ প্রদর্শক হিসাবে সিগমুণ্ড ফ্রয়েড জগদ্বিখ্যাত। মন ও মন সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে ফ্রয়েডের চিন্তা, গবেষণাই যে একমাত্র তা বলা যায় না। তবে সবচেয়ে বেশি আলােচিত। মনস্তত্ত্ব প্রসঙ্গে তাঁর গবেষণা-তত্ত্ব সবচেয়ে বেশি ও উল্লেখযােগ্য স্বীকৃতি লাভ করেছে। মনের জটিলতা, রহস্য ও সেই রহস্যের উন্মােচনে আজও তাঁর পথই অধিক অনুসৃত। মনের সমস্ত বিষয় আমাদের জানা নেই এবং মনের যে এক নির্জ্ঞান প্রদেশ আছে এই তথ্যকে বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে তিনিই সর্বপ্রথম প্রতিষ্ঠিত করেন। যৌনতা, সুখ উপভােগ, নির্জ্ঞান-মন ইত্যাদির রহস্য যেমন আমরা জানতে পারি তেমনি অপরাধ প্রবণতার ব্যাখ্যাতেও ফ্রয়েড-তত্ত্ব গুরুত্বপূর্ণ। অসৎ ব্যক্তি ও মানসিক রোগীর মধ্যে পার্থক্য এই, অসৎ ব্যক্তির মন নানান দূষণীয় ইচ্ছার দ্বারা প্রভাবিত; কিন্তু রোগীর ক্ষেত্রে এই সমস্ত অসৎ ইচ্ছা অবদমিত থেকে ভিন্ন রূপ লাভ করে ও রোগের সৃষ্টি করে।

এক সময়, বিখ্যাত চিকিৎসক তথা হিস্টিরিয়া রোগের বিশেষজ্ঞ শারকোর শিষ্যত্ব নেন ফ্রয়েড। সেই সূত্রে তিনি শিশুরােগ চিকিৎসা শিক্ষা করেন। কোকেন প্রয়ােগে স্পর্শানুভূতি দূর করে চোখের অস্ত্রোপচার সম্ভব একথা তিনিই প্রথম জানান। ১৮৮৯ সালে তিনি Free Association Method বা 'অবাধ ভাবানুষঙ্গ পদ্ধতি' আবিষ্কার করে মনঃসমীক্ষণের মূল ভিত্তি স্থাপন করেন। এছাড়া, ব্যক্তিত্বের বিকাশ, স্বপ্নতত্ত্ব, সম্মোহন প্রভৃতি তাঁর গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা। আর এসবকিছুই বিংশ শতাব্দীর বিশ্ব সাহিত্য ও শিল্পকে প্রভাবিত করেছে। সাহিত্যে বিশেষ করে গল্প উপন্যাসে এল চেতনাপ্রবাহ রীতি।

  লেখকের স্বপ্নলোক তথা অবচেতন মন সাহিত্যে রূপলাভ করতে বাধ্য। ফ্রয়েডীয় তত্ত্বের মাধ্যমে অবচেতন মনের এই সাহিত্যকৃতি আলাদা মাত্রা লাভ করল। এর আগে চেতন মনের প্রভুত্ব ছিল। এবার এল মগ্নচৈতন্য। জন্ম নিল কবিতার ক্ষেত্রে সুররিয়ালিজম বা পরাবাস্তবতাবাদ। বাস্তব চিন্তার সঙ্গে কল্পনা ও স্বপ্নের মেলবন্ধন ঘটল। উল্লেখ্য, বাংলা কাব্য জগতে সুররিয়ালিজমের লক্ষণ জীবনানন্দ দাশের কবিতায় সার্থক ভাবে লক্ষ করা যায়। সুররিয়ালিজমের প্রভাব চিত্রশিল্পীদের ওপরও যথেষ্ট। পাশাপাশি নাটক কিংবা সিনেমাতেও তার প্রভাব। ফ্রয়েডের মতে, দর্শক অবচেতনে প্রদর্শিত কোনও চরিত্রের মধ্যে যেন সে নিজেকেই খুঁজে পায়।

ফ্রয়েড আরও জানালেন, সাহিত্য হল সাহিত্যিকদের ব্যক্তি জীবনের প্রেম-কামনা, ক্ষমতাপ্রিয়তা ও অতৃপ্ত বহু বাসনার সফলরূপ প্রকাশ মাধ্যম। অর্থাৎ শিল্পকর্মে শিল্পীর অপূর্ণ কামনার পরিতৃপ্তিকেই শিল্পচর্চার মূল উদ্দেশ্য বলেছেন। এই শিল্পচর্চা অবশ্যই সত্য ও সুন্দরকে নিয়ে গড়ে ওঠে।

মনের মতো শিল্প-সাহিত্যেও থাকে অপার রহস্য। সেই রহস্য তথা মনােবিশ্লেষণাত্মক ভঙ্গি ফ্রয়েডের অপেক্ষায় ছিল তা জোর গলায় বলা যায় না। কিংবা সেই অপার রহস্যভেদে ফ্রয়েড তত্ত্বই যে একমাত্র ও অভ্রান্ত তা বললেও একটা লক্ষ্মণরেখা টানা হয়, যা কোনও ভাবেই স্বাস্থ্যকর নয় --কী মনের ক্ষেত্রে, কী শিল্প সাহিত্য-রস আস্বাদনে। তবে শিল্প-সাহিত্য চর্চায় অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ ও সাহায্যকারী হিসাবে সংযােজন হতে পারে ফ্রয়েড তত্ত্ব। এখানেই ফ্রয়েডের প্রাসঙ্গিকতা। আসলে, ফ্রয়েড চর্চায় জাগে আত্মানুসন্ধান।
------------------------
স্কেচ - চন্দন মণ্ডল 

Post a Comment

0 Comments