জ্বলদর্চি

আয়ারল্যান্ডের লোকগল্প (Folk-tale of Ireland)

Folk-tale of Ireland

দূর দেশের লোকগল্প (আয়ারল্যাণ্ড)

চি ন্ম য়  দা শ


রাজার চোখে ঘুম নাই

সারা রাজবাড়ি জুড়ে সে এক হুলুস্থল কাণ্ড। আর হবে নাই বা কেন ? রাজকুমারের অভিষেক বলে কথা। হাজার রকম কাজ। হাজার রকম আয়ােজন সেসবের। কাজের যেন শেষ নাই। দিন কেটে রাত হােল। খাওয়া-দাওয়ার পাট চুকিয়ে শােবার জোগাড় চলছে। রানিমার খুব দৌড়ঝাপ গেছে আজ। এমনকি একবার কেনাকাটা করতেও বেরিয়েছিলেন নিজে। আসলে, নিজে বেছে না আনলে, সহজে কিছুই পছন্দ হয় না তাঁর। যাইহােক, এখন টেনে ঘুম দিতে হবে একটা। এক বাটি মাখন  নিয়ে সারা মুখে মেখে নিল রানি। বিছানায় ঢুকে, রাজাকে বলল-- “কিগাে, ঘুমােবে না? আমি বাপু শুয়ে পড়লাম।”

রাজার কোনও তাড়া নাই। বেশ তরিবত করে ঘূরে ঘুরে দাঁত মাজল। জমকালাে শােবার পােষাক পরল ধীরেসুস্থে। তারপর ধীরে সুস্থে গিয়ে শুয়ে পড়ল বিছানায়। রাজার পালঙ্ক বলে কথা। যেমন তার রাজহাঁসের পালকের মত ধবধবে রঙ, তেমনই মাখনের মত তুলতুলে নরম। কিন্তু কী যে হােল, ঘুমপরী এসে বসলই না রাজার চোখে। একবার এপাশ, একবার ওপাশ করতে লাগল রাজা। কিন্তু ঘুমের দেখা নাই। 

ছটফট করতে করতে কত সময় গেল। রাতের তখন শেষ প্রহর। কী আর করে ? রাজা ভাবল, যাই, একটু ঠাণ্ডা বাতাস খেয়ে আসি বাগানে বেরিয়ে। বিছানা ছেড়ে নেমে গেল বেচারা। 
সিঁড়ির শেষ ধাপে পৌঁছেছে, চোখে পড়ল তােষাখানাটা হাট করে খােলা। সেখানে সােনা ভর্তি পুটলি আর থলের সারি। মােহর আর রূপাের টাকার স্তুপ। দামী দামী হীরে-জহরতের পাহাড়। তার আড়ালে প্রায় ঢাকা পড়ে যাওয়া খাজাঞ্চী মানুষটা কাজ করে চলেছে।

রাজা সেখানে ঢুকে বলল- "রাখাে তােমার গােণা-গাঁথার হিসেব। আমার বলে ঘুম আসছে না কিছুতে। কোন একটা উপায় বাতলাতে পারো?" খাজাঞ্চি লােকটা বেশ বুদ্ধিমান। তার বুঝতে কিছু দেরি হােল না। সারাদিন কাজকম্ম না থাকলে, ঘুম আসবে কী করে? রাজাকে বলল-- "এ আর এমন কী কথা? এখুনি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।" 
একটা সিন্দুকের ডালা খুলে, হলদে রঙের একটা মখমল তুলে দিল রাজার হাতে।

কাপড়টা হাতে পেয়ে, রাজা তাে আহ্লাদে আটখানা- "আরে বাস। দারুণ জিনিষ তাে। এটা গায়ে দিয়ে শুয়ে পড়লেই, ঘুম চলে আসবে চোখে।"

খাজাঞ্চি হাত কচলে বলল- “হুজুর, এটা গায়ে দেওয়ার চাদর নয়। এ দিয়ে হিরে-জহরত মােছামুছি করলে, চকচকে হয়। মুছতে মুছতে ঘুমও চলে আসে চোখে।”

ভারি কাজের কথা। রাজা বলল-- "যাও, তুমি একটু গড়িয়ে নাও। আমি করে দিচ্ছি তােমার কাজ।" খামখেয়ালি রাজা। বলা-কওয়া নাই, চলে যায় যদি ? ঘর কার জিন্মায় থাকবে? উঠে যাওয়া চলবে না। এই ভেবে, দেওয়ালে ঠেস দিয়ে ঝিমিয়ে নিতে লাগল খাজাঞ্চি।

এদিকে কাজ একেবারে শেষই হয়ে গেল। আলাে ছিটকে বেরুতে লাগল হিরে-জহরত থেকে। মােহরগুলাে ঝকমক করছে। হাত টনটন করছে রাজার। খাজাঞ্চি বলল- "কাজ তাে শেষই করে ফেলেছেন আপনি। এবার গিয়ে শুয়ে পড়ুন। ঠিক ঘুম আসবে।'

রাজা বেরিয়ে এল। কিন্তু ঘুমের তো কই দেখাই নাই। এদিকে পেটে একটু খিদে খিদে ভাব মালুম হচ্ছে। রসুই খানার দিকে চলল রাজা। সেখানে হালুইকর এক বস্তা ময়দা ঢেলে মাখতে বসেছে। রাজাকে দেখে, হুড়মুড়িয়ে উঠতে গেল লােকটা। রাজা বলল-- "ব্যস্ত হােয়াে না। বােস, বােস। বল তাে, রাতে ঘুম হয় তােমার? আমার তাে ঘুমই আসছে না। কী যে করি?"

লােকটা বলল-- "সত্যি বলতে কি, ময়দা মাখলে, ঘুম আসে তাড়াতাড়ি। আসলে এ কাজে মেহনত তাে কম নয়। আমি তাে এখানেই ঘুমিয়ে পড়ি কতদিন।"
-- “তাই বুঝি ? সরাে তাে দেখি।" হালুইকরকে সরিয়ে, রাজা বসে গেল ময়দা মাখতে। কিন্তু বসলেই তাে আর ময়দা মাখা হয় না। আনাড়ি হাতে বাতাসে উড়ে বেড়াতে লাগল ময়দার গুঁড়াে। যেন কুয়াসা ঢুকে পড়েছে রসুইশালায়। মাখবার কাজ খানিক এগিয়েছে, অমনি হাঁচি পেল রাজার। হাঁচিরই বা দোষ কী। যা ময়দা ঢুকছে নাকে। রইল পড়ে আধমাখা ময়দার তাল। নাকে ময়দার গুঁড়ো ঠাসা হয়ে গেছে। হাঁচতে হাঁচতে বাইরে বেরিয়ে এল রাজা। মনে ভাব-- বাগানে গিয়ে নাকে একটু খােলা বাতাস টানা দরকার। 
মালি তখন বাগানে ঘাস ছাঁটছিল। রাজা বলল-- "কী করি বল তাে? রাতে আদৌ ঘুম আসে না আমার। তােমার ঘুম হয়?"

মালি মুখ ফুটে বলে কোন সাহসে? মনে মনে বলল-- 'অত আরাম-আয়েসে থাকলে, ঘুম হবে কেন?' মুখে বলল-"বাগানের ঘাস ছাঁটি তাে, দারুণ ঘুম হয় আমার।"
শুনে রাজা ভারি খুশি। মালির হাত থেকে কঁচিখানা কেড়ে নিয়ে বলল- "তাহলে আমিও ঘাস ছাটব।”

কিন্তু বললেই তাে আর ঘাস ছাঁটা যায় না। ইয়া ভুঁড়ি রাজার। মাথা নীচু করে ঝুঁকবেন, সে সাধ্যি কোথায়। মালি বলল- “দেখবেন হুজুর, ঘাসের ডগা যেন সব সমান করে ছাটা হয়।"

রাজা তখন মরীয়া। ঘাস ছাঁটতেই হবে। ঘুম হবে তাহলে।

গায়ে দামী পােষাক। নিজে হলেন দেশের রাজা। সব ভুলে গেল বেচারা মানুষটা। হাঁটু গেড়ে বসে কাঁচি চালাতে লাগল। একবার কাঁচি চালায়, একবার পরখ করে দেখে, ডগা সব সমান হােল কি না। কোন দিন এভাবে বসে না রাজা। একটু বাদেই কোমর টাটাতে লাগল। হাঁটু টনটন। নাকের ফুটো দিয়ে জোরে জোরে বাতাস ঢুকছে, আর বের হচ্ছে। কিন্তু কাজ ছাড়বার ইচ্ছেই নাই রাজার।

এদিকে সকাল হয়ে গেল দেখতে দেখতে। আলাে ফুটল একটু একটু করে। রানি উঠল ঘুম থেকে। তাকিয়ে দেখে, রাজা নাই বিছানায়। সেকি! গেল কোথায় মানুষটা? জানালা দিয়ে তাকাতে, চোখ কপালে উঠে গেল রানির। হাঁটু গেড়ে বসে, বাগানে ঘাস কাটছে রাজা।

হুড়মুড় করে বাগানে দৌড়ে এল রানি। রাজাকে বলল-"হয়েছে কী তােমার? মাথা খারাপ হয়নি তাে?"

-- "নাগাে, মাথা খারাপ হবে কেন ? ঘুম হয়নি আমার সারা রাত। কেউ কিছু বাতলাতেও পারছে না।” রাজার গলায় ভারি বেদনার সুর। 

হাত ধরে রাজাকে টানতে টানতে তুলে নিয়ে গেল রানি। বিছানায় বসিয়ে, এক গেলাশ গরম দুধ খাওয়াল। বলল- “শুয়ে পড়। আমি আসছি। হাত বুলিয়ে দেব মাথায়। ঠিক ঘুম এসে যাবে।” রাজা বাধ্য ছেলের মত শুয়ে পড়ল।

এ বয়সে কি আর গান-টান হবে? এই ভেবে, রানি একটা রূপকথার বই পেড়ে আনল আলমারির বই-পত্তর ঘেঁটে। মাথায় হাত বুলাতে বুলােতে, গল্প পড়ে ঘুম পাড়াবার চেষ্টা করবে মানুষটাকে। 

ঘরে ঢুকে রানি আবার অবাক। কাকে গল্প শােনাবে? রাজা তাে ঘুমিয়ে পড়েছে। নাকও ডাকতে শুরু করেছে হালকা হালকা। যাকে বলে, ঘুমিয়ে একেবারে কাদা।

                 অলংকরণ - রবীন্দ্রনাথ কপাট  

Post a Comment

0 Comments