জ্বলদর্চি

গুরুপূর্ণিমা: প্রাচীন আধ্যাত্মিকতা থেকে আধুনিক চেতনায় গুরু-তত্ত্বের পুনর্মূল্যায়ন /সত্যজিৎ পড়্যা

গুরুপূর্ণিমা: প্রাচীন আধ্যাত্মিকতা থেকে আধুনিক চেতনায় গুরু-তত্ত্বের পুনর্মূল্যায়ন

সত্যজিৎ পড়্যা

ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির বুনিয়াদে ‘গুরু’ বা আচার্যের স্থান অত্যন্ত উচ্চে। ‘গুরুপূর্ণিমা’ সেই আবেগ ও কৃতজ্ঞতার এক অনন্য উৎসব, যেখানে শিষ্য তার জ্ঞানগুরুকে স্মরণ করে, শ্রদ্ধা নিবেদন করে। প্রতি বছর আষাঢ় মাসের পূর্ণিমা তিথিতে পালিত এই উৎসব কেবল ধর্মীয় বা আচারগত নয়, বরং তার মধ্যে নিহিত রয়েছে নৈতিকতা, শিক্ষা, সংস্কার ও আত্মানুসন্ধানের গভীর বার্তা। এই গবেষণাপত্রে গুরুপূর্ণিমার আধ্যাত্মিক, ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক ও শিক্ষাগত তাৎপর্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে।গুরুপূর্ণিমার ইতিহাস অত্যন্ত প্রাচীন। বিশ্বাস করা হয়, এই দিনটি মহর্ষি বেদব্যাসের জন্মদিন। তিনি মহাভারতের রচয়িতা ও চারটি বেদের সংকলক। সেই কারণেই এই দিনটি ‘ব্যাসপূর্ণিমা’ নামেও পরিচিত। তিনি ছিলেন জ্ঞানের প্রতীক এবং শিক্ষক সমাজের আধার।অন্যদিকে, যোগদর্শনের পথপ্রদর্শক পতঞ্জলি, আয়ুর্বেদের জনক চরণবিদ্যাচার্য, এবং নৃত্যের গুরু ভরতমুনিও এই গুরু-শ্রেণিতে স্থান পেয়েছেন। প্রাচীন ভারতে গুরু-শিষ্য পরম্পরা শুধুমাত্র শিক্ষাদানের মাধ্যম নয়, বরং তা ছিল আত্মোন্নতির পথ।হিন্দু দর্শনে গুরুকে পরম ব্রহ্মের অনুবর্তী রূপে দেখা হয়। ‘গু’ অর্থ অন্ধকার এবং ‘রু’ অর্থ অপসারণকারী—এই ভাবনায় গুরু সেই ব্যক্তি, যিনি অজ্ঞানতা ও অন্ধকার দূর করে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করেন। উপনিষদে বলা হয়েছে— “গুরুব্রহ্মা গুরুর্বিষ্ণু: গুরুর্দেবো মহেশ্বরঃ।
গুরুসাক্ষাৎ পরব্রহ্ম তস্মৈ শ্রীরুরবে নমঃ॥”

এই চরণগুলো গুরুপূর্ণিমার আধ্যাত্মিক মর্মকে আরও গাঢ় করে তোলে। গুরু কেবল একজন শিক্ষক নন, তিনি হলেন আত্মজ্ঞানের দিশারী।প্রাচীন ভারতীয় শিক্ষাপদ্ধতি গুরুকুল ভিত্তিক ছিল, যেখানে শিষ্য গুরু-আশ্রমে বাস করত এবং নির্লোভভাবে শিক্ষা গ্রহণ করত। গুরুপূর্ণিমা সেই গুরুকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের একটি দিন।
🍂
ad

বর্তমান যুগে শিক্ষকদের ভূমিকা পরিবর্তিত হলেও মূল সত্তা অপরিবর্তিত—আজও শিক্ষকই হলেন নৈতিকতা, মানবতা এবং বৈজ্ঞানিক ভাবনার প্রথম অনুপ্রেরণা। এই প্রেক্ষাপটে গুরুপূর্ণিমা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, শিক্ষকতা কেবল একটি পেশা নয়, এটি একটি গুরু দায়িত্ব।ভারতবর্ষের প্রতিটি ধর্ম, সম্প্রদায় ও সংস্কৃতিতে গুরু বা শিক্ষকের প্রতি শ্রদ্ধা একটি সাধারণ আবেগ। গুরুপূর্ণিমা হিন্দু, বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের মধ্যে সর্বজনগ্রাহ্য উৎসব হিসেবে পালিত হয়।বৌদ্ধধর্মে, এই দিনটিতে গৌতম বুদ্ধ তাঁর প্রথম উপদেশ দেন বারাণসীর সারনাথে, যাকে ধম্মচক্র প্রবর্তন বলা হয়।জৈনধর্মে, এই দিন মহাবীর স্বামী তাঁর প্রথম শিষ্য গৌতম
গান্ধারকে দীক্ষা দেন বলে বিশ্বাস করা হয়।এইভাবে গুরুপূর্ণিমা ধর্মীয় বিভাজনের ঊর্ধ্বে উঠে এক সর্বজনীন মানবিক বোধকে উদযাপন করে।

আজকের প্রযুক্তি নির্ভর যুগে ‘জ্ঞান’ সহজলভ্য হলেও ‘জ্ঞানবুদ্ধি’ এবং নৈতিকতাসম্পন্ন মনুষ্যত্বের চর্চা প্রায়শই হারিয়ে যাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে গুরুপূর্ণিমা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়-শিক্ষকতা কেবল পাঠ্যসূচি নয়, বরং মূল্যবোধের পাঠ।জ্ঞান কেবল তথ্য নয়, বরং উপলব্ধির পথ।ডিজিটাল শিক্ষা, অনলাইন প্ল্যাটফর্ম, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স—সবই শিক্ষার মাধ্যমে পরিবর্তন আনছে, তবে মানবিক মূল্যবোধের দিশারি আজও একজন গুরু।

গুরুপূর্ণিমা শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় বা আচারিক উৎসব নয়; এটি এক আত্মিক উপলক্ষ্য। এই দিনটি স্মরণ করায়, আমাদের জীবনে প্রকৃত গুরুর প্রয়োজনীয়তা এবং শিক্ষার গভীর তাৎপর্য। বর্তমান সময়ের সমাজিক, শিক্ষাগত এবং নৈতিক সংকটের মুখে গুরুপূর্ণিমার মর্মকথা আমাদের আলো দেখাতে পারে।তাই বলাই যায়,
"যে জাতি গুরুকে সম্মান করতে জানে, সে জাতি কখনো পথভ্রষ্ট হয় না।"

Post a Comment

0 Comments