জ্বলদর্চি

হাজার বছরের বাংলা গান -১৬

            কৃষ্ণনগর রাজবাড়ি


হাজার বছরের বাংলা গান।। পর্ব-১৬

তু ল সী দা স   মা ই তি

প্রাক-রবীন্দ্রনাথ পর্বে বাঙালির সংগীতচর্চার আরো কিছু কথা 

"সংগীত সম্বন্ধেও তেমনি ছিল দুই ধারা। উচ্চ সংগীতের ব্যয়সাধ্য চর্চার ক্ষেত্র ছিল ধনশালীদের বৈঠকখানায়। সেই সংগীত সর্বদা কানে পৌঁছত চার দিকের লোকের, গানের সুরসেচনে বাতাস হত অভিষিক্ত। সংগীতে যার স্বাভাবিক অনুরাগ ও ক্ষমতা ছিল সে পেত প্রেরণা, তাতে তার শিক্ষার হত ভূমিকা। যে-সব ধনী দের ঘরে বৃত্তিভোগী গায়ক ছিল তাদের কাছে শিক্ষা পেত শুধু ঘরের লোক নয়, বাইরের লোকও। বস্তুত এইসকল জায়গা ছিল উচ্চ সংগীত শিক্ষার ছোটো ছোটো কলেজ।" 
                 মাইকেল মধুসূদন দত্ত  

রবীন্দ্রনাথের এই বক্তব্যটি আর একবার আনতেই হলো  প্রাকরবীন্দ্র বাঙালির সংগীত চর্চার অবহহটিকে অন্য এক অভিমুখে  বোঝার জন্য।  এপর্যন্ত আলোচনায় রামপ্রসাদের পর থেকে  ব্রাহ্মসঙ্গীতের সূচনা পর্ব অবধি বাঙালির সংগীত চর্চার বিবিধ প্রসঙ্গের আলোচনা হয়েছে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ-এর শ্রেষ্ঠ সংগীত গুণী হয়ে ওঠার বহু পূর্বসূত্র এখনো আলোচিত হয়নি। বলাবাহুল্য, উচ্চসংস্কৃতি ও লোকায়ত সংস্কৃতির অপূর্ব মিশেলে উচ্চ মাত্রার গান হয়ে ওঠার যে পূর্ব ইতিহাস তাতে আরো কিছু সংগীতগুণীর প্রসঙ্গ জরুরি ভাবেই এসে পড়ে তাঁদের কথা সহ তৎকালীন বাংলার সংগীতিক আবহটি বুঝতেই এই পর্বের অবতারণা।

প্রকৃতপ্রস্তাবে, বাংলা গানের জগতে রবীন্দ্রনাথ একটি যুগ। সর্বকালের শ্রেষ্ঠ যুগ বলা যেতে পারে। স্বাভাবিকভাবেই তাঁর অব্যবহিত পূর্বযুগ সম্পর্কে কৌতুহল জাগে। এযাবৎ শাক্তসংগীত,পাঁচালি, কীর্তন টপ্পা, ঠুংরি প্রভৃতি গানের আলোচনার সময় বাঙালির সংগীতগুণীদের কথা হয়েছে। আরো যাঁরা থেকে গেছেন আড়ালে তাঁদের কথাও এসে পড়ে। বাংলাগানের ক্ষেত্রে তাঁদেরও অবদান কম নয়। বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা বহু সংগীত রচয়িতা ও সংগীত রসিক তাঁদের সাংস্কৃতিক অনুভব ছড়িয়ে দিয়েছেন। মূলত কবিগান,পাঁচালি, কথকতা, টপ্পা প্রভৃতি গানের অনুকরণে তাঁরা সংগীত নির্মাণ করলেও প্রত্যেকের গানের মধ্যেই নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ছিল। 
    বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়  

রূপচাঁদ পক্ষী(১২২১ বঙ্গাব্দ) সব রকম গানে পারদর্শী ছিলেন। তাঁর আসল নাম রূপচাঁদ দাস। সংগীতের ভণিতায় খগরাজও লিখতেন। উড়িষ্যাপ্রদেশে তাঁর পূর্বপুরুষগণ বাস করতেন বলে শোনা যায়। গৌড়েশ্বর ষড়ঙ্গদেবের বংশে তাঁর জন্ম। তবে কলকাতায় আগেই তাঁরা চলে এসেছিলেন। তিনি যাত্রা, পাঁচালি,টপ্পা সব রকম গান  বাঁধতেন। বিভিন্ন জমিদার বাড়ি ও বড়ো বাড়ির অঙ্গনে গিয়ে মাতিয়ে রাখতেন এই রসিক আমোদপ্রিয় মানুষটি। তাঁর গানের স্বাতন্ত্র্য ব্যঙ্গাত্মক উপস্থাপনায়। সমাজের অসঙ্গতিকে সাবলীলভাবে তিনি গানে প্রকাশ করতে পারতেন। সমকালে ঘটে যাওয়া অনেক ঘটনাই তাঁর গানে উঠে এসেছে। কন্যাদায়, বিধবাবিবাহ, রেলগাড়ি, টেলিগ্রাফ,গঙ্গার ব্রিজ প্রভৃতি বিষয় তাঁর সংগীতে ছন্দময় হয়েছে। আর বাংলা গানে ইংরাজি বাক্য ব্যবহার করে তিনি এক অদ্ভুত অভিনবত্ব তিনি বাংলা গান এনেছিলেন। এ প্রসঙ্গে স্মরণীয় তাঁর "আমাকে ফ্রড করে / কালিয়া ড্যাম তুই কোথায় গেলি! / আই অ‌্যাম ফর ইউ ভেরি সরি / গোল্ডেন বডি হল কালি" ও "লেট মি গো ওরে দ্বারী / আই ভিজিট টু বংশীধারী / এসেছি ব্রজ হতে? / আমি ব্রজের নারী।" গান দুটি উল্লেখযোগ্য। অবশ্য তাঁর অজস্র বাংলা গান গীতিকাব্যিক মাধুর্যে মহিমাময়। 
                দীনবন্ধু মিত্র

কাশীপ্রাসাদ ঘোষ (১২২৭ বঙ্গাব্দ) এই পর্যায়ের একজন সংগীতগুণী নিধুবাবুর টপ্পার অনুকরণে তিনি অনেক টপ্পা রচনা করেন। রামনারায়ণ তর্করত্ন (১২১৭), হাওড়ার জগন্নাথপ্রসাদ বসুমল্লিক, বর্ধমানের প্যারিমোহন কবিরত্ন(১২৪১), প্রমুখ এই ধারায় নানা স্বাদের সংগীত সৃষ্টি করে বাংলা গানকে সমৃদ্ধ করেছেন। টপ্পা ঠুমরি ও রাগপ্রধান সংগীতের চর্চাও করেছিলেন তাঁরা। হাওড়ার ঠাকুরদাস দত্ত (১২০৮) শখের ও পেশাদারি যাত্রাপালায় গান রচনা করলেও অন্যান্য গানেও দক্ষ ছিলেন বলে জানা যায়।

হুগলির রসিকচন্দ্র রায়(১২২৭) কালোয়াতি সংগীতের তালিম নিলেও  পাঁচালি গান রচয়িতা হিসাবে দাশরথী রায় এর পরেই তাঁর নাম আসে। তবে বহু যাত্রা, তরজা,বাউল প্রভৃতি গানও তিনি বেঁধেছেন। 'হরিভক্তিচন্দ্রিকা' ও 'কৃষ্ণপ্রেমাঙ্কুর' নামে দুটি সংগীত গ্রন্থ রচনা করেন। হাওড়ার ঠাকুরদাস দত্ত শখের ও পেশাদারি যাত্রাপালায় গান রচনা করলেও অন্যান্য গানেও দক্ষ ছিলেন বলে জানা যায়। 
    প্যারিচাঁদ মিত্র

সমকালেই বিদ্যাসাগরের বন্ধু মদনমোহন তর্কালংকার(১২২২) সাহিত্য অনুরাগী ছিলেন ঠিকই কিন্তু সংগীতানুরাগী ছিলেন।  তাঁর পান্ডিত্য সঙ্গীতে প্রকাশ পেয়েছে। এ পর্যায়ে প্যারিচাঁদ মিত্র(১২২১) সংগীত রচনার দিকটিও উল্লেখযোগ্য। আসলে সমকালীন সংগীত চর্চার দিকটিকে গভীরভাবে দেখলে বোঝা যায় সাহিত্যের জগতের দিকপাল গণ ও সংগীত রচনা ও চর্চায় নিমগ্ন থেকেছেন। মদনমোহন তর্কলঙ্কার, প্যারিচাঁদ মিত্র ছাড়াও দীনবন্ধুমিত্র, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, নবীনচন্দ্র দেন, রাজকৃষ্ণ রায়, শিবনাথ শাস্ত্রী, বঙ্কিমচন্দ্র চট‍্যোপাধ্যায়, বিহারীলাল চক্রবর্তী, গিরীশচন্দ্র ঘোষ প্রমুখের কথা বলা যায়। 

 মধুসূদন দত্ত ও দীনবন্ধু মিত্রের  গান তো বাঙলা  গানের  অনন্য সম্পদ। দুজনেই শ্যামাসঙ্গীত ছাড়াও বহু ভক্তিগীতি ও রাগসঙ্গীত উপহার দিয়েছেন।  মধুসূদনের 'যেয়ো না রজনি লয়ে তারাদলে', কাফী রাগে 'মন বুঝে দেখো না', সোহিনী রাগে 'আমি ভাবি যার ভাবে সে তো ভাবে না।' প্রভৃতি গানগুলি বাঙালির হৃদয় জয় করেছে। দীনবন্ধু মিত্রের 'মদনমোহন মুরলীবদন", 'কামিনীকোমল মনে বিরহ কি যাতনা" প্রভৃতি গানগুলি জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। বঙ্কিমচন্দ্রের কথা আলাদা করেই বলতে হয়। সাহিত্যসম্রাটের বাংলা গান কৌতুহলের ও  আকর্ষণীয়। আমরা জানি তাঁর 'বন্দে মাতরম' গানটির কথা। 'আনন্দমঠ' লেখার আগেই গানটি লেখা হয়। যদুভট্ট গানটির প্রথম সুর করেছিলেন। শোনা যায় যদুভট্টের কাছে তিনি গানের তালিমও নিয়েছিলেন। পরে রবীন্দ্রনাথ সহ অনেকেই গানটিতে সুরারোপ করেছিলেন। গানটি জাতীয় সংগীতের মর্যাদাও পায়।  তবে তিনি বহু বাংলা গান রচনা করেন।  তাঁর কীর্তন অঙ্গের 'সিন্ধু-কুলে রই, নূতন তরী বই', 'সাধের তরণী আমার কে দিলো তরঙ্গে', জয় জয় জয় জয় জয় যাত্রী/ জয় জয় জয় বঙ্গ জগদ্ধাত্রী"  প্রভৃতি গানগুলি খুব গুরুত্বপূর্ণ। কিছু কিছু সংলাপ ধর্মী গানও  তিনি রচনা করেন। 
    রাজা বিজয় চাঁদ মাহাতাব

আগেই বলেছি, বাংলা গানের চর্চা ও প্রসারের ক্ষেত্রে রাজা জমিদার সহ ধনী ব্যক্তিদের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। বিষ্ণুপুরের রাজাবৃন্দ সহ অন্যান্য কিছু রাজাদের প্রসঙ্গ আলোচিত হয়েছে। এছাড়াও বঙ্গদেশের কয়েকজন রাজা জমিদারের কথা না বললে বাঙলা গানের আলোচনা অনেকটা সংকীর্ণ হয়ে পড়ে।
বাংলাগানের আলোচনার শুরুতেই রাজাদের সংগীতে পৃষ্ঠপোষকতার কথা হয়েছে। আধুনিক কালেও তা অন্য রূপে থেকে গেছে। অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে বাংলা গান রূপান্তর আসে। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় ও তাঁর সভার দুজন সঙ্গীতগুণী ভারতচন্দ্র রায় ও রামপ্রসাদের সংগীতের হাত ধরে এই বদল আসে বলে মনে করা যায়। রাজা নিজে সংগীতে পারদর্শী ছিলেন। বহু বাংলা গানের নির্মাতা তিনি । তাঁকে ঘিরে  বাংলার সংগীত জগৎ অন্য মাত্রা পায়। রাজা নবচন্দ্র রায় ও মহারাজ শ্রীশচন্দ্রের বাংলা গান রচনায় যথেষ্ট ভূমিকা আছে। নদীয়ার বিষ্ণুরাম চট‍্যোপাধ্যায়ের গানও স্মরণীয়। বহু উচ্চমানের গানের নির্মাতা তিনি। 
কবিগানের আলোচনায় সময় বর্ধমান রাজাদের দেওয়ানবৃন্দের সঙ্গীতগুণের কথা  বলা হয়েছে। মহারাজ মাহাতাব চন্দ্র, ও রাজা বিজয় চন্দ্র শাস্ত্রীয় সংগীতের সাথে সাথে বাংলাগানেরও চর্চায় খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। মহারাজ নন্দকুমার, মুর্শিদাবাদের দেওয়ান গঙ্গাগোবিন্দ সিংহ, কোচবিহারের রাজা হরেন্দ্রনারায়ণ, চুঁচূড়ার গঙ্গাচরণ সরকার- সকলেই রাগসংগীত সহ সমকালীন সংগীতে দক্ষতা অর্জন করেছিলেন।

সমস্ত পুর্ববঙ্গেও একই  আবহ ছিল। নাটোরের মহারাজ রামকৃষ্ণ,ময়মনসিংহ অঞ্চলের মহারাজ কমলকৃষ্ণ সিংহ, রংপুরের রাজা মহিমারঞ্জন রায়, রাজশাহীর রাজা শশী শেখরেশ্বর প্রমুখ সংগীত শিল্পে পারদর্শিতার স্বাক্ষর রেখেছেন। শশী শেখরেশ্বরের গান উচ্চমাত্রার তাৎপর্য বহন করে-

"সংসার জলে ভাসবে বলে দশ লোক ঘাটে
 মহাজনের নৌকা নিয়ে দশে তাতে ওঠে।
সবাই তাতে সমান হয়ে দাঁড় ফেলতে চায় 
মাঝি বিনে মাঝ তুফানে নৌকা ডুবে যায়।"

বিক্রমপুরের আনন্দচন্দ্র মিত্র  ও গোবিন্দ চন্দ্র রায় এর নাম বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য।।আনন্দচন্দ্র মিত্রের 'ভারত শ্মশান মাঝে আমি রে বিধবা বালা' গানটি অতি পরিচিত একটি গান। 

এই ভাবেই অবিভক্ত বাংলার প্রায় সব প্রান্তেই রাজা জমিদারের  উৎসাহ, আনুকূল্য ও সক্রিয় অংশগ্রহণে বাংলা গান তাঁর ক্ষেত্র ও  অবস্থান প্রকাশ করে তুলেছে।
 
বাংলাগানের মধ্যবর্তী পর্বের এই আলোচনায় আরো অনেকের কথা আলোচনা করা গেল না। কিন্তু বাংলা গানের বিপুর সম্ভারে তাঁরাও রইলেন। যে কথা দিয়ে শুরু হয়েছিল যে বাংলা প্রাক-রবীন্দ্র পর্বের গানের ইতিহাস মহিমাময়। বিপুল তার আয়োজন। তারও অনেক কথা বাকি রয়ে গেল। 

অন্য কোনো পর্বে। অন্য কোনো দিন।

চলবে….

Post a Comment

2 Comments

  1. আরো জানার ইচ্ছে রইলো। ভালো হচ্ছে আলোচনা।

    ReplyDelete
  2. এতো তথ‍্যবহুল এক সুর প্রবাহ যে কোন পরবর্তী গবেষক দের সাহায্য করবে , তাদের তথ‍্য সন্ধানে সুবিধা করে দেবে । রবীন্দ্র পূর্ববর্তী যুগে যে বিশাল সুরের সাধনা হয়েছিলো তা এই লেখার পরতে পরতে অনুভূত হচ্ছে । এমন সমৃদ্ধ লেখা আরো কৌতূহল উদ্রেক করে ।
    লেখককে অনেক অনেক শুভকামনা জানাই । সঙ্গে আছি ।

    ReplyDelete