জ্বলদর্চি

স্মৃতিমেদুর ছেলেবেলা/মৌসুমী ভট্টাচার্য্য

স্মৃতিমেদুর ছেলেবেলা

মৌসুমী  ভট্টাচার্য্য 


ছোটবেলা কেটেছে একেবারেই  জঙ্গলে। পার্বত‍্য ত্রিপুরায়। একটু বড় হতে রাজধানী আগরতলায়। 
ঐ শৈশবে আগরতলার উপকন্ঠে মাত্র 10 কিমি দূরত্বে ঘন জঙ্গল, তাতে বাঘ মৌমাছির আস্তানা ছিল।
ঐখানে হর্টিকালচার ডিপার্টমেন্টের অরচার্ড ছিল। ভীষণ সুন্দর। চারদিকে লেক। নিঝুম বনানী। তার মধ‍্যে পেয়ারা ও সবেদা চাষ হত। এগ্রিকালচার ডিপার্টমেন্টের এক ইন্সটিউট ছিল। বাবা সরাসরি এনিয়ে পড়াশুনো না করলেও কোন একটি বিষয়ের অধ‍্যাপক হয়ে  কাজ করছিলেন। বয়স 30 ও ছিল না। তখনই  বিয়ে। তারপর আমি এলাম। কোয়ার্টার  কমপ্লেক্স ছিল। ভালো  সুন্দর কোয়ার্টার। 
কিন্তু  বনবেষ্টিত আর বনে বাঘ থাকত।
আমার  বয়স যখন তিন, বোতলে আর দুধ খাই না। মা বিটি ট্রেনিং  নিচ্ছিলেন। একবছর হোস্টেলে থাকতে হয়েছিল। তখন এই মা বাঘিনীকে গুলি করে হত‍্যা করে শিকারীরা। কারণ ছিল বোধহয়। বাঘিনীর 3 টে শিশু ছিল, দুধ খাওয়ার পর্বের। মাতৃহারা তাদের নাকি আমাদের  কোয়ার্টারে আনা হয়েছিল।  আমার  পরিত‍্যক্ত ফিডিং বোতল দিয়ে দুধ খাওয়ানো হয়েছিল।
পরে লোকাল জু-তে পাঠানো হয়।

বাবা যখন ছোট্ট। কমলপুর নামে মফস্বল, উত্তর ত্রিপুরার।   সর্বত্র বাঘ ছিল। জঙ্গুলে জায়গাই  ছিল ত্রিপুরা।
এক বয়স্ক ভদ্রলোক প্রতিদিন সন্ধ‍্যায় তাস খেলতে যেতেন বন্ধুর বাড়ি। মনোরঞ্জনের কিছুই ছিল না তখন। পঞ্চাশের দশক,  ছোট সরু পথ,চারপাশে ঘন গাছপালা। 
খেলাশেষে লন্ঠন হাতে ফিরতেন বাড়ি। লন্ঠনের কাঁচও কালিতে ঢাকা, ভালো  দেখা যায় না। একদিন ফিরতে গিয়ে তিনি দেখেন রাস্তায় এক জানোয়ার বসে আছে।
তিনি গরু ভাবলেন। ' দ‍্যাখো দেখি কান্ড!  গরুডারে ছাইড়া রাখছে। বাঘ আইয়া লইয়া যাইব। কার বাড়ির গরু ইডা?" বলে লন্ঠন নিয়ে ঝুঁকে গরুর মুখ দেখতে গেলেন।

দেখেন গরু নয়, বাঘ বসে আছে। বাঘের মুখের সামনে গিয়ে 'বা---ঘ' বলে বিরাট মুখব‍্যাদান করলেন। 
বাঘও হতচকিত হয়ে  গেছল। তার জীবনে এমনতর অভিজ্ঞতা হয়নি আগে। সে ভয় পেয়ে আক্রমণ না করে ল‍্যাজ গুটিয়ে নাকি পালিয়েছিল। 
এই ঘটনা মুখে মুখে ফিরত। 

আরেকটি শুনেছি, মায়ের জ‍্যাঠামশাই এস ডিও র‍্যাঙ্কে চাকরি করতেন, পোস্টেড ছিলেন কমলপুরে। সেখানে এক গ্রামবাসীর গোয়ালঘরে বাঘ এসেছিল রাতে। এক গরু নাকি শিং ঢুকিয়ে বাঘের পেট ফর্দাফাই করে দিয়েছিল।
মায়ের জেঠু মানে দাদু ঐ গরুকে 5 টাকা সরকারী পুরস্কার দিয়েছিল। সাহসিকতার জন‍্য।
আরও  অসংখ্য  গল্প সত‍্যি ঘটনা শোনা যায়।

 পুকুরঘাটের স্মৃতি কিছু আছে আমার। ভাইয়ের জন্মের আগে, বাবা তখন পাটনায় উচ্চতর শিক্ষায়, মা আর চার বছরের আমি উত্তর ত্রিপুরার মহকুমা শহর কমলপুরে,  আমাদের  পৈত্রিক বাড়িতে ছিলাম। দুই বছর। তখন একেবারেই  এঁদো গ্রাম ছিল কমলপুর। প্রতিটি বাড়িতে একটি পুকুর থাকতোই। পানীয় জলের জন‍্য চাপা কল। পাশেই কিছু মানকচুর গাছ থাকত।
পুকুরপাড়ে লাইন দিয়ে সুপুরী গাছ থাকত। তার ছায়া পড়ত। হাঁস থাকত প্রায় সব ঘরেই। ব্রাক্ষ্মণ সেই পাড়াতে মুরগী নিষিদ্ধ ছিল তখন। 
হাঁসের ডিমের ডালনা রাঁধা হত আলু দিয়ে,  লম্বা ঝোল। 
কমলপুরে বাবার ঠাকুর্দা ঢাকা থেকে দেশভাগের অনেক আগেই চলে এসেছিলেন। প্রচুর জমিজমা নিয়ে তালুকদারের মত হয়ে  গিয়েছিলেন। দেশভাগের যন্ত্রণা বা রিফিউজি তকমা এই পরিবারে নেই। বেশ সম্পন্ন। সব কিছু ক্ষেত থেকে আসত। ধান,  উৎকৃষ্ট সব কোয়ালিটি,  এখন বিলুপ্তপ্রায়। আখ চাষ হত আরও  ডাল ফাল হত। এসব চাষীরা করত। মণিপুরী গ্রাম ছিল,  তারা নাকি প্রজা ছিল আমাদের । 
যাই হোক,  আমাকে বাড়িতে  রেখে আমার  মা সেখানের একমাত্র সরকারী মেয়েদের হায়ার সেকেন্ডারী স্কুলে যেতেন চাকরী করতে। সারাদিন আমার  কিকরে কাটত!  খালি পায়ে ঘুরে পায়ের নিচে কাঁচের টুকরো ফুটে যাওয়া, বড় রোমশ শুয়োপোকার রোম লাগানো,  এসব তো থাকতই। আর 
জ‍্যাঠতুতো দাদা দিদিদের সাথে পুকুরে নেমে জল খাওয়া। সাঁতারের ব‍্যর্থ চেষ্টা, পায়ে কাঁকড়ার  চিমটি কয়েকবার খাবার পর আর নামতেই চাইতাম না।
কাঁকড়াগুলো পুকুরের পাড়ে চলে আসত ধীরে। আমার  কচি পায়ের আঙুল যেন বেশ পছন্দের ছিল তাদের।

বেশ কবার বড় দীঘিতে পাড়ে বসে থেকেই জলে ডুবে যেতে যেতে বেঁচেছিলাম। সে অনেক কীর্তি। কটা বলব। মা স্কুল থেকে এসে দেখতেন সব দুর্ঘটনারা ওনার পুচকিকেই বেছে নেয়।
কেউ সাইকেলের চাকা পায়ে তুলে দিল,  নখ উপড়ে যাওয়া। সেই সাইকেলেই মহকুমা হাসপাতালে গিয়ে ব‍্যান্ডেজ বেঁধে ফেরা। 
 উপর থেকে পড়ে নাক ভেঙে  বীভৎস  অবস্থা। মা মন দিয়ে চাকরি করতেন। বাড়ির গুরুজনদের কথা মেনে চলতেন। নিজেও ভুগতেন,  আমিও ভুগতাম। 

 এর পর বাবা ফিরে এলে রাজধানীতে শিফ্ট হয়ে  যাওয়া। আর বছরে একবার  গ্রামের বাড়িতে গেলেও পুকুরঘাটে আর নামিনি। কেউ সাঁতার শেখানোর উদ‍্যোগও নেয়নি। 
ক্লাস টেনে পড়ি, দুদিনের জন‍্য গিয়েছিলাম। ভরা বর্ষাকাল তখন। জ‍্যাঠতুতো দিদির সাথে ধলাই নদীতে নেমেছিলাম। পাহাড়ি শীর্ণ নদী, কিন্তু  বর্ষাতে ভয়ংকর  চেহারা হয়। সেখানে সাঁতার না জেনে নামাই ভীষণ মূর্খামি। 
নোংরা  জল বেশ ক ঢোক খেয়েছিলাম, মনে আছে। বাড়ি ফিরে পুকুরে নামি। পুকুরে আবার কয় ঢোক জল গিলি। কত যে ব‍্যকটেরিয়া ভাইরাস গিলেছিলাম ভগাই জানে!  সে এক মধুর স্মৃতি।
খিলখিলিয়ে অনর্থক হাসছি, চোখ লাল করে ডুব দিচ্ছি। 

 আবার গিয়েছিলাম ঠাকুরমা মারা যেতে। ঐ শেষ। শরতকাল। নদীর পাশে কাশফুলের শোভা। ত্রিপুরার গ্রামের সৌন্দর্য্য অসাধারণ। 
 বাড়ি ভর্তি লোকজন, শ্রাদ্ধবাড়ি। আমি কলেজ পড়ুয়া তখন। ছোট পিসির ছোট মেয়ে টুয়েলভে পড়ছিল,  সে আর আমি পাশের এক জ্ঞাতির বাড়ির পুকুরপাড়ে পা ঝুলিয়ে বসে থাকতাম ঘন্টার পর ঘন্টা। ভীষণ গভীর পুকুর, শান্ত। গাছপালায় ঘেরা।  দুই কাজিনের সেই আড্ডা!  সব হারিয়েই গেল জীবন থেকে।

 শ্রাদ্ধ মিটতে একটু দূরের এক গ্রামে দূর সম্পর্কের এক পিসীর বাড়িতে গিয়েছিলাম সবাই। আমি মা বাবা ভাই, ছোট পিসিমণি আর দুই কাজিন। 
সেই গ্রামের বাড়িটি মনের মণিকোঠায় উজ্জ্বল থাকবে চিরদিন। এত সুন্দরও হতে পারে!  বাস থেকে নেমে হাঁটা পথে নদী পার হয়ে  গিয়েছিলাম। হাঁটু অব্দি জল নদীতে, পাড়ে কাশফুল। সকাল সকাল পৌঁছে  গিয়েছিলাম। চারপাশে সবুজ ধানের ক্ষেত দিগন্তবিস্তীর্ণ। পিসির সেই বাড়িটি ভারী সুন্দর। মাটির ঘর লেপা, নিকনো উঠোন। চট্ করে সেই পিসি রান্না চাপিয়ে দিলেন। ওনার এক কিশোর ছেলে বাড়ির পুকুর থেকে মাছ ধরে দিল। মা বটি দিয়ে কাটতে বসে গেলেন। ঘরের পোষা দেশী মুরগী কাটা হল, ছোট পিসিমণি উঠোনে একটি গাছের নিচে মুরগীর পালক ছাড়াতে বসে গেছলেন। 
ভারী সুন্দর খাওয়া দাওয়া হল। সেই পুকুরপাড়ে আবার আড্ডা দিলাম আমি আর লু । কাজিন। 
 জলে  ঠ‍্যাং ডুবিয়ে ধানক্ষেতের শোভা দেখতে দেখতে... আহা। কখনও  ভোলা যাবে না। 
বিকেলে গানের আসর বসল। হারমোনিয়াম নাকি কোন প্রতিবেশীর বাড়ি থেকে আনতে হবে। আমি আর লু  মহা উৎসাহে সেই বাড়িতে গিয়েছিলাম।  সেই আলপথ দিয়ে যাওয়া। দুইপাশে সবুজ ক্ষেত, মাঝে আলপথে ব‍্যালেন্স করতে করতে যাওয়া এক অপূর্ব অভিজ্ঞতা।

গান গাইতে বললেই তখন ' আধেক ঘুমে নয়ন চুমে' বা '  সেদিন দুজনে দুলেছিনু'  এদুটোই গাইতাম। লু এর  তখন নাম হচ্ছে গায়িকা হিসেবে। স্কলারশিপ পায়। বিশারদ কমপ্লিট করে পরবর্তীতে। 
আমি বিশারদ পাশ করে তখন গান ভুলে ফিজিক্স  কেমেস্ট্রি নিয়ে হাবুডুবু খাচ্ছিলাম। বাড়ি থেকে বহু দূর কলেজে যাতায়াতেই সব এনার্জি চলে যেত। 
যাইহোক, বারান্দায় বসে চা খেতে খেতে গ্রাম‍্য গানের আসর বসেছিল। পিসিমণি এত এত কাজের মধ‍্যেও গান লিখে সুর দিতেন। স্কুলে শিক্ষকতা, তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে সংসার, গরু পোষা, সেলাই বোনাই, তারপর গান লিখে সুর দেয়া!  ভীষণ সুন্দরী পিসিমণির অনেক গুণ ছিল। 
লু এমন একটি গানও গাইল।
সন্ধ‍্যায় ফেরা। আকাশে চাঁদ, গ্রামের রাস্তা জোছনায় ভেসে যাওয়া। আমাদের  হা হা হি হি আর বন্ধ হয়  না। খুব ভালো  কেটেছিল দিনটি। আর কখনও  যাওয়া হয়নি এর পর।

উগ্রপন্থী সমস‍্যা, পাকদন্ডী পাহাড়ি রাস্তায় যেতে পেটে মোচড়  দিয়ে হড়হড়িয়ে বমি পাওয়া আমার  আর সাহস হয়নি।
আত্মীয়দের শীতল ব‍্যবহারও কারণ ছিল। অভিমানী আমার  অভিমান ভীষণ।

ভারী মিষ্টি স্মৃতি আছে। বোধকরি বছর পাঁচের হবো।
5 পয়সার কি চার পয়সা ছিল হাতে। কি কারণে মনে নেই। গ্রামের কমলপুরের বাড়িতে ছিলাম। মা স্কুলে। বাড়ির পাশেই বেশ বড় মুদীদোকান।
আমাদের  সমবয়সীদের বড় দল ছিল। গুড়ি গেড়া। ঠিক হলো লজেন্স খাব। আরেকটি পয়সা দরকার। দল বেঁধে দোকানে গেলাম। আমি পয়সা দিয়ে লজেন্সের কথা বলতেই যাচ্ছিলাম তো তারণ আটকে দিল।
এটুকু বয়সে তারণের কি বুদ্ধি  ছিল!  বলল আগে লজেন্স নেব, পরে পয়সাটা ছুঁড়ে ফেলে দৌড়ে বেরিয়ে যাব দোকান থেকে।
প্রশংসার দৃষ্টিতে আমরা মেনে নিলাম। কাঁচের বয়াম থেকে একমুঠো লজেন্স নিয়ে পয়সা দিয়েই দৌড়ে বেরিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু  আরেক ক্ষুদে সদস‍্যার বিপত্তি হলো। তার ছোট্ট পা বাঁশের মাঝে আটকে গেল। রাস্তা থেকে দোকানঘর যেতে কত বড় বড় বাঁশ সমান্তরালভাবে পাতা ছিল। ত্রিপুরা বাঁশবেতের জায়গা। দুগ্গনের পা আটকে যেতে সে ভ‍্যা করে কেঁদে ওঠতে আমাদের  আবার ফিরে ওকে রেসকিউ করতে হয়। এক কি দু পয়সা কম ছিল লজেন্সের।
দোকান মালিক হাসতে ছিলেন আমাদের  কান্ড দেখে! 
কত শত স্মৃতি! আজ এই কয়েনগুলো মিউজিয়ামে রাখার মত মহার্ঘ‍্য।

আমাদের  ছেলেবেলায় আইসক্রিম  পাওয়া যেত 10 পয়সায়। সত্তর দশকের শেষের দিকের কথা বলছি। মূল‍্য বেড়ে বোধহয়  15 পয়সা হয়েছিল।
স্কুলে ঢোকার মুখে আইসক্রীমের বাক্স নিয়ে বসে থাকত কিছু ভ্রাম‍্যমাণ দোকানদার। কি যে ইচ্ছে হত খেতে!  বাড়িতে মেপে পয়সা দিত যাতায়াতের জন‍্যে শুধু।
আইসক্রীম নাকি ড্রেনের জল দিয়ে বানানো হয়,  এমন মা বলতেন।
এখন শুনি আমাদের  সময়  সব বাড়িতেই বলা হত এটি। সাবধানবাণী।
একটু দুধ মিশিয়ে মিল্কি আইসক্রীম 25 পয়সার ছিল। কখনও  কোন সহৃদয় সহপাঠিনী খাওয়ালে ধন‍্য হতাম।
বায়না করার অভ‍্যেসই তৈরী হয়নি। গোড়াতেই নির্মূল করা হয়েছিল তা।

আর ছিল শীতকালে কূল খাবার প্রবল বাসনা। ওটা থেকে বিরত থাকতে পারতাম না। লালচে রঙের নুন পুঁটুলী করে দিত সাথে। তেল মাখিয়ে চকচকে কূলগুলো এত লোভনীয় দেখাত! ঐসময়  বছরের শুরুতেই গানের পরীক্ষা  থাকত। লখনৌ ভাতখন্ডের বিশারদ পরীক্ষার কোর্স করেছিলাম।
ত্রিপুরার কড়া ঠান্ডা, কূলের লোভ সব সামলিয়ে কন্ঠস্বর ঠিক রেখে ক্লাসিকাল গানের পরীক্ষা  উত্তীর্ণ হওয়া এক বিশাল চ‍্যালেঞ্জ ছিল।

বাবা জোর করে কোর্স কমপ্লিট করিয়েছিলেন। লখনৌ ভাতখন্ডের ডিগ্রী নেয়া হয়ে  ঘুমুচ্ছিলো।  এই পরীক্ষাতে থিয়োরী ও প্র‍্যাকটিক‍্যাল হতো। প্র‍্যাকটিক‍্যাল নিতে খোদ লখনৌ থেকে বাঘা বাঘা এক্সামিনার আসতেন।
প্রথমে ওনাকে এক লিস্ট দেয়া হতো ধরিয়ে, কি কি শিখেছি। সিলেবাসে প্রচুর রাগ রাগিনী থাকতো। একেক বছর একেক সিলেবাস। প্রথমে বড় বা বিলম্বিত খেয়াল গাইতে বলা হতো। গাইতাম। তারপর উনি বলতেন অমুক রাগের ছোটা খেয়াল গাইতে। তমুক রাগের। সাথে তরানা থাকতো। ধ্রুপদী থাকতো। 
সে এক অন‍্য জগতই ছিল বটে। নার্ভাস হয়ে  গাইতাম। উতরে যেতাম। কিন্তু  লাস্ট প্রশ্নে এসে আটকে যেতাম। 
প্রশ্নটি থাকতো রাগ আইডেন্টিফাই করার। এক্সামিনার দু সেকেন্ডের  জন‍্য একটি মুখড়া গেয়ে শোনাতেন। তারপর জিজ্ঞেস করতেন,  ঐটি কোন্ রাগ! 
 কয়েক সেকেন্ডের মধ‍্যেই উত্তর দিতে হতো। সবচেয়ে কঠিনতম প্রশ্ন ছিল, এখনো। এর উত্তর দিতে হলে কমপক্ষে পনেরো মিনিট আমার  মেলাতে হতো, কোন্ ঠাট, কোন্ রাগ!  একি দরবারী কানাড়া, না জয়জয়ন্তী, না তিলকামোদ।
🍂

না বৃন্দাবন সারঙের মত লাগছে। অসহায় হয়ে  একটা উত্তর দিতাম, জানতাম এ সঠিক না হবারই সম্ভাবনা বেশী।
ফাইনালে, বিশারদ পরীক্ষার সময়  কলেজে মাত্র ভর্তি হয়েছি, ফিজিক্স  অর্নাস নিয়ে। লোকজন এত কঠিন বিষয়  শুনে একটু সমীহের দৃষ্টিতে দেখতো। মেয়েরা কেন জানি ঝাঁকে ঝাঁকে বায়োলজি পড়তে ভালোবাসতো। এই বিষয়গুলোতে ভীতি থাকতো, পড়তে আসতো না বেশী।
তা পরীক্ষার সেই কঠিনতম মৌখিক প্রশ্নে আমি যখন রাগ রাগিনীর খনি হাতড়ে বেড়াচ্ছিলাম,  অসহায়ভাবে তবলাবাদকের দিকে তাকাচ্ছিলাম। 
এক্জামিনার বাজপাখির মত তীক্ষ্ণ  দৃষ্টিতে আমার  দিকে তাকিয়ে। এমনসময় তবলা বাজালেন যিনি, উনি আমার  ইম্প্রেশন ভালো  করতে বললেন,"বাচ্চী হ‍্যায়। ফিজিক্স  য‍্যায়সে কঠিন সাবজেক্ট  লেকে পড় রহী হ‍্যায়..."। 
মানে ফিজিক্স  কেমেস্ট্রি নিয়ে কলেজ গিয়ে আবার ক্লাসিকাল গান গাইছি, এই ঢের। এতো সময়....! 
যা হোক্, পাশ তো করেছিলাম। জীবনের প্রথম এক বড় ডিগ্রীই বলা যায়। তারপর সত‍্যি পড়ার চাপে ক্লাসিক‍্যাল গানের চর্চা আর হলো না। অনেক বছর পর একটু শুরু করেছিলাম,  আবার ছেদ। মনে আছে মাধ‍্যমিকের আগে টেস্ট পরীক্ষার সময়  থিওরী পরীক্ষা  পড়লো। আমি মানা করেছিলাম যে দেব না। জীবন বিজ্ঞান পরীক্ষা  দিয়ে রাতে ফোর্থ ইয়ারের থিওরী, যা বেশ কঠিন ছিল। এর মধ‍্যেও অংক ছিল। তাল ফাল নিয়ে। 
তার পরদিন ইতিহাস ও ভূগোল দুই পেপার। একদিনেই। আমাদের  সময়  হতো দু বেলা পরীক্ষা। মাঝে কোন ছুটি নেই। আর নাইন আর টেনের পুরো সিলেবাস মনে রেখে বমি করতে হতো। ভীষণই অন‍্যায় ভাবে এই রুটিন করা হয়েছিল। নাইন ও টেনের ইতিহাস পড়তেই তো একদিন লাগে। তারমধ‍্যে ভূগোলও দুই ক্লাসের। আমার  রাত 5 থেকে 8 অব্দি গানের থিওরী পরীক্ষা ছিল। তারপর বাড়ি ফিরে কখন রিভিশন দেব! কখন সকালে ওঠব!  না, প্রচন্ড তালিবানি শাসনেই বড় হয়েছিলাম। নো বায়নাক্কা। বাবা হুকুম দিলেন যে দিতেই হবে। বায়োলজি দিয়ে ( সেদিন একটাই ছিল পেপার)  গানের থিওরী পড়ে গিয়ে যেন পরীক্ষা  দিয়ে আসি। 
এর অন‍্যথা হতে পারবে না। অগত‍্যা, সবই করেছিলাম। পরেরদিন সকালে সামান‍্য সময়  পেয়েছিলাম ইতিহাসে  চোখ বোলাতে। ভূগোল খোদার উপর ছেড়ে দিতে হয়েছিল। বাড়ি থেকে স্কুল দূরে, সকাল 10টা থেকে 1টা, আবার 1.30 টা থেকে 4.30 টে পরীক্ষা  ছিল। বাড়ি থেকে 9 টায় বেরোতেই হতো। তার আগে চান খাওয়া শাড়ি পরা!  উফফ্! কি জীবন ছিল মাইরি! 

ফিজিক্স  নিয়ে গ্র‍্যাজুয়েশন শেষ করব এমন সময়  শান্তিনিকেতনে  গিয়েছিলাম দুদিনের জন‍্য বেড়াতে। গ্রীষ্মের ছুটি চলছিল তখন।
সঙ্গীতভবনে গান নিয়ে পড়ার সুযোগ হল। প্রিন্সিপাল ছিলেন নীলিমা সেন। 
আমি গানকে প্রধান বিষয়  রাখতে চাইনি।
ফিজিক্স  নিয়ে পড়ব, গানের চর্চা থাকবে সাথে।
হয়তো তাহলে জীবন অন‍্যরকম হত যদি সঙ্গীত নিয়েই পড়াশুনো করতাম।

 লতাজীর পুরনো গান, কি হিন্দি কি বাংলা  সবই ছোট থেকে গেয়ে আসছি। বেশ ছোট বয়স তখন,  এগারো কি বারো হবে। পূজোর পর বিভিন্ন  ক্লাবে আয়োজিত ফাংশনে গাইতাম।   ক্লাসিকাল শিখতাম আট বছর বয়স থেকেই। এক বৃদ্ধ মাষ্টারমশায় বহু দূর থেকে এসে শেখাতেন। ভজন ও রাগ প্রধানই শিখতাম। ভোরবেলা ও সন্ধ‍্যাবেলা মা রেওয়াজ করতে বসিয়ে দিতেন। সকালে গলা ভেঙে থাকত। ফ‍্যারিংসের দোষ সবসময়ই  ছিল। এখনো সকালে গলা খোলে না। কোনো মাফ ছিল না। তালমিছরি ও গোলমরিচ  মিশিয়ে গুড়ো করে রাখা হতো। একটু করে  মুখে দিতাম। 
কোয়ার্টার  কমপ্লেক্সে  অনেক উচ্চ পদস্থ অফিসাররা থাকতেন। সকালে অ‍্যালশিয়ান নিয়ে ওয়াকে বেরোতেন। আমার  রেওয়াজ শুনে আমাদের  কোয়ার্টারের সামনে দাঁড়িয়ে  শুনতেন। বাবা ওনাদের জুনিয়র ছিলেন বয়সে ও পদে। বাবাকে বলতেন 'আপনার মেয়ের  গান শুনি'।  বাবা গর্বিত বোধ করতেন। স্কুলে সবসময়ই  ভজনে প্রথম পুরস্কার  পেতাম। মীরার ভজন। সেই সঙ্গীত শিক্ষকের হাতে লেখা প্রথম গানের খাতাটি এক অমূল‍্য সম্পদ হয়ে  আছে।

সমাপ্ত

Post a Comment

2 Comments

  1. খুব ভালো লাগলো।

    ReplyDelete
  2. গানের মত এমন সুধাভরা প্রাণ আর কিছু তে আছে নাকি!গান গাইলেই দিল খুশ! আমি ও গান গাইতে খুব ভালো বাসি।গলাও খারাপ নয়,(অন্ততঃ সবাই তাই বলে), তবে সুযোগ হয়নি শেখার। নাচের ক্লাসে ভর্তি করে দিল।সাহস ছিল না প্রতিবাদ করার

    ReplyDelete