শিউলি ভেজা আঙিনায়
সুরঞ্জনা দাস
আদরে সোহাগে কে যেন মায়ায় ঘিরে ধরে চারিপাশ, সে পথ অফুরান - হ্যারিকেনের নিভু নিভু আলোর সাথে মিশে গেছে সেই স্মৃতি। লক্ষ্যবিহীন তীরের মতো ছুটে চলে মন। নির্জন পথ, আকাশ জুড়ে মেঘ মদির স্মৃতির শহর। ঘুমের আবেশে সেই আঁচলখানির ছোঁয়া - পরিশ্রম ও ঘামে নেয়ে তার শরীর তখন ক্লান্ত। তবুও সন্তানকে জড়িয়ে নেয় উতলা প্রাণে। মন্ডপে মন্ডপে দুর্গা মাকে যতোই সাজানো হোক, শিউলি ভেজা আঙিনায় তার নিত্য যাপনের আটপৌরে গন্ধ ছড়িয়ে থাকে প্রতিনিয়ত।
জীবনকুঞ্জে এগিয়ে যেতে যেতে নদীটিও ফিরে তাকায়। ছুঁতে চায় মেয়েবেলাকে। বীণার তারে মায়ের রাগিনী সুর তোলে বারবার। বারান্দায় এসে বসলেই ঢেউ তোলে দখিনা বাতাস - ঘোমটা মাথায় সংসারের সব কাজ সেরে চলেছে, তার মনের খোঁজ কেউ রাখে না। সকলের দাবি মেটাতে মেটাতে কখন
যে নিজের শোভা হারিয়ে ফেলে - তাও থাকে অজানা। রবীন্দ্রনাথের মতো বলতে মন চায় আমার---
" ভেঙে দাও আজিকার সভা
আনো নব রৃপ, আনো নব শোভা।"
🍂
আজকের এই জীর্ণ আলোখানিই আমার আনাচে কানাচে স্মৃতির স্তুপের মতো। তপ্ত রোদেরবেলায় ক্লান্ত বৃদ্ধ ডাবের ঝুঁড়ি নিয়ে রাস্তা ধরে চলেছে, মিস্ত্রিরা সারাদিন ধরে ইঁট গাঁথতে ব্যস্ত, হাড় জিড়জিড়ে লোকটাও রিক্সা টেনে নিয়ে চলেছে, একটা হাড়ের টুকরো নিয়ে চেঁচামেচি করছে কুকুরগুলো, অলস দুপুরে কাকের ঠোঁট নর্দমায় ডুবে আছে, আমগুলোকে ঠুকরে ঠুকরে শেষ করে ফেললো পাখিরা। দূর থেকে মায়ের ডাক শোনা যায়।
লেবুর গন্ধ যেমন মায়ায় জড়িয়ে রাখে, তেমনি মায়ের আদুরে স্বর। রিনরিনে সেই কন্ঠ যেন অপেক্ষা করে আছে অনন্ত কাল ধরে। আমার রুক্ষ চুলের গোড়ায় তেল দিতে দিতে কতো বকুনি খেয়েছি। ফিতে দিয়ে চুল বেঁধে বিনুনি করে তবেই ছাড় পেতাম। যাপন নদীতে স্নেহের এমন জোয়ার বড়োই দুর্লভ। মায়ের মন্থরতায় ভরা জীবনটাতে নিজের চাওয়া বলে কিছুই ছিল না। দুয়ার জুড়ে শুধু অপরের ভালো চাওয়া।
আমার মনে সতত রবীন্দ্রনাথের বাস -
" সাগর উঠে তরঙ্গিয়া, বাতাস বহে বেগে,
সূর্য যেথায় অস্তে নামে ঝিলিক মারে মেঘে।"
আর্থিক সচ্ছলতা ছিল না বললেই হয়। পরিবারের সদস্য সংখ্যা অনেক - একান্নবর্তী। কর্মসূত্রে প্রায় প্রত্যেককেই বাড়ির বাইরে বেরোতে হতো। শুধু মা ওই সংসার আগলে তরী বেয়ে চলেছে আজও। মনের কোণে প্রবহমান সেই লুকোচুরির খেলা। খেতে বসতে গিয়ে জড়িয়ে ধরে সেই মায়াবী স্বাদ। আর ছুঁতে পাই না সেই তরকারিকে। আলু পোস্ত, কলমী শাক ভাজা, ল্যাঠা মাছের ঝাল - জিভে দিলেই যেন আঁকড়ে থাকে আমার মায়ের নেশা। কোথাও পাই না আর সেই অনুভূতিটা।
পুজোর ঘরের চন্দনের গন্ধে মা যেন খেলা করে, আঁচল দিয়ে প্রতিমার মুখ মুছে দিত। হৃদয়মন্দিরের ভক্তি কৃত্রিমতায় ঢাকা ছিল না তার, আঁচল দিয়ে বেঁধে আমাদের যেমন কাছে টেনে রাখতো, তেমনই ঈশ্বরের বেলাতেও। মা নিবিড় সৌরভে পুজোর থালা নিয়ে তুলসী মন্দির আলো করে বসতো। লাল পেড়ে সাদা শাড়িতে যেন
" উজ্জ্বল বিমল মূর্তি"। আমার আকুল হৃদয়
আজ বলতে চায় -
" আবরণ সব দূর করো হে, মোচন করো তিমির -
জগৎ আড়ালে থেকো না বিরলে,
লুকায়ো না আপনারি মহিমা মাঝে -
তোমার গৃহের দ্বার খুলে দাও।।"
মেঘ আলো ছায়া মিলেমিশে একাকার। যখন জুঁই ফুলের স্নিগ্ধ ঘ্রাণ আমায় জড়িয়ে ধরে ইচ্ছেরা কেবল দোল খায়। মায়ের মায়াবী গন্ধ আমায় আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলে। স্মৃতিরা ডানা মেলে উড়ে যায় অলীক আকাশে। সেই " ভাঙাচোরা বুড়ি গলা" আমার চারিপাশে আবর্তিত হতে থাকে। নিভু নিভু তবুও যেন প্রজ্জ্বলিত, আবহমান কাল ধরে
এর নীরব স্রোত বইতেই আছে। আঁধারের ঘোর প্রবল তবু পথরেখা প্রকট। অনুখন জেগে থাকে সেই স্মৃতির আলপথ।
লালপেড়ে মোটা গরদের শাড়ি পরে "আমার সকল দুখের প্রদীপ" এই গানটা গুনগুন করে গাইতো। ব্যাকরণের মাত্রা জ্ঞান হয়তো ছিল না - বাক্য, শব্দ, চেষ্টা এসবে নিবেদন ছিল দেখার মতো। উজাড় করা সে পূজা - সঙ্গোপনে বুনে চলি সেই অতীত স্মৃতিকে -
"অনেক দিনের অনেক কথা, ব্যাকুলতা বাঁধা বেদন - ডোরে
মনের মাঝে উঠেছে আজ ভরে।"
শিখা জ্বলতেই আছে । সাঁঝের তারারা গল্প বলে -
মনে পড়ে মায়ের বলা রৃপকথা, রামায়নের সীতা
হরণ। আমার চোখে অশ্রুধারা বইতে দেখলে মায়ের হাসি থামতো না।
" গল্পের গোরু গাছে ওঠে, গল্প শুনে কেউ কাঁদে সোনা?"
" বইতে তাহলে কেন লেখা আছে? তুমি আমাকে বলছোই বা কেন? তাহলে কি সব মিছে কথা? মিছে কথা তো বইতে থাকে না।"
সেদিন মা আর উত্তর দেয়নি, একেবারে নীরব
শ্রোতা। সত্যিতো ছোট্ট এই শিশু সেদিন "বিশ্বাস" নামক ঘোড়ায় চেপে বেরিয়েছিল মানস ভ্রমণে।
কোনোকিছুই সেদিন অসত্য বলে মনে হয়নি।
এতো আলো জ্বালিয়েছে আমার ফুলবনে। আমি হারিয়ে গেলেও রয়ে যাবে এ সত্য।
ক্ষণে ক্ষণে আঁজলা ভরে অতীতের মুহূর্তগুলোকে কুড়িয়ে নিই। আলো জেগে রয়। বীণাখানি পড়ে রয়।
0 Comments