জ্বলদর্চি

(Pablo Ruiz Picasso) পাবলো রুইজ পিকাসো /সন্দীপ কাঞ্জিলাল

"আমি একটা বিষয়কে যেভাবে দেখি সেভাবে আঁকি না, যেভাবে ভাবি, সেভাবেই আঁকি। পেইন্টিং হচ্ছে অন্ধ মানুষের পেশা, যা দেখেন তা তিনি আঁকেন না। যা অনুভব করেন, বিষয় সম্পর্কে নিজেকে যা বলেন তা-ই আঁকেন। রাফায়েলের মতো আঁকতে আমার চার বছর লাগলো। কিন্তু শিশুর মতো আঁকতে লেগে গেল সারাটা জীবন।"

Pablo Ruiz Picasso 
পাবলো রুইজ পিকাসো 
(২৫/১০/১৮৮১-০৮/০৪/১৯৭৩)

সন্দীপ কাঞ্জিলাল

প্রসব ঘর থেকে বেদনার চিৎকার আসছে। বাইরে অপেক্ষারত পরিবার পরিজন। কিছুক্ষণ পর প্রসব বেদনার চিৎকার আর আসছে না। শিশু জন্মালে না হয় মায়ের প্রসববেদনা কমে। তা-ও তো নয়। শিশুর কান্নার আওয়াজও আসছে না। সবাই যখন দরজা খুলে দ্যাখে দূরে টেবিলে শোয়ানো শিশু। ধাত্রী প্রসূতির পরিচর্যা করছে। ছেলেটি নিথর। হাত পাও ছুঁড়ছে না। কান্না তো দূরের কথা। ধাত্রী ভূমিষ্ঠ হওয়া ছেলেটিকে মৃত ভেবে পাশের টেবিলে শুইয়ে রেখেছেন। সবাই শোকে কান্নায় ভেঙে পড়েছে। এই সময় ঘরের প্রবেশ করলো সদ্যোজাতের কাকা! মুখে চুরুট। তিনি শেষ টান মেরে, ছেলেটির দিকে ঝুঁকে দেখছেন। তাঁর ছেড়ে দেওয়া ধোঁয়া ছেলেটির চোখে মুখে। হঠাৎ ছেলেটি কেঁদে উঠলো। সবাই ভূত দেখার মতো চমকে ছেলেটির দিকে তাকালো। শিশুটি যেন চিরঘুমের দেশ থেকে ফিরে এলো। কোনো শিশু জন্মেই যখন কাঁদে তখন 'মা' 'মা' শব্দ করে, কিন্তু এই ছেলেটি প্রথমে বলে উঠলো 'পিজ'। স্পেনীয় ভাষায় 'লাপিজ' এর সংক্ষিপ্ত রুপ। বাংলাতে যার মানে পেন্সিল। সে তো পেন্সিল চাইবে। কারণ যাকে পরবর্তী কালে আঁকতে হবে বিখ্যাত ছবি 'গর্ণিকা' (Gaurnica)- ১৯৩৭। যেখানে দেখানো হয়েছে, স্পেনের গৃহযুদ্ধের সময়, স্পেনের 'গর্ণিকা' 'র বাস্ক শহরে, জার্মানির নাৎসি বাহিনীর বোমাবর্ষণ। সেই হামলার বিভীষিকা সমগ্র মানব সমাজকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। ছবিটি তেল রঙে আঁকা। সাড়ে তিন মিটার লম্বা ও প্রায় আট মিটার চওড়া। যেখানে দেখানো হবে, একজন মাটিতে আহত যোদ্ধা, একজন মা তার সন্তানকে মৃত দেখে কাঁদছে। পাশে একটি ঘোড়া। একটি ছোট বর্গাকার অন্ধকারে, যার মাঝে ঝুলন্ত লণ্ঠন, একটি লম্বা হাত, আর একটি বাতি জ্বালিয়ে আশার আলো প্রতীক হিসেবে দেখানো হয়েছে। এই সময় নাৎসি বাহিনীর এক অফিসার তাঁর আঁকার ঘরে এসে প্রশ্ন করবে- এটা কি আপনার কাজ? শিশুটি পরবর্তী কালে উত্তর দেবে, "না, এটা আপনাদের কাজ।" সেই শিশুটির নাম "পাবলো রুইজ পিকাসো" (Pablo Ruiz Picasso)।
পাবলো রুইজ পিকাসো একটি স্পেনীয় নাম। তার প্রথম পারিবারিক নাম হল Ruiz এবং দ্বিতীয় নাম Picasso। বাবার নাম হোসে রুইজ ব্লাসকো। মায়ের নাম মারিয়া পিকাসো লোপেজ। মায়ের নামের অংশ থেকেই তার বিশ্বপরিচিত নামটি এসেছে। 

১৮৮১ সালের ২৫ শে অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন। দক্ষিণ স্পেনের ভূমধ্যসাগর তীরবর্তী বন্দর শহর মালাগায়। বাবা ছিলেন প্রাদেশিক চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়ের চিত্রাঙ্কনের শিক্ষক এবং স্থানীয় জাদুঘরের কিউরেটর। বিখ্যাত আন্দালুসিয়ার মধ্যে মালাগা ছিল চারুকলার জন্য বিখ্যাত কেন্দ্র। তাই ছোটবেলা থেকেই ছবি আঁকার প্রতি ঝোঁক ছিল পিকাসোর। 

পিকাসোর বাবা নিজ হাতে ছেলেকে ছবি আঁকা শেখান। নিজের স্টুডিওতে নিয়ে কেমন করে ইজেলে ছবি টানতে হয়, কেমন করে প্যালেটে রঙ মেশাতে হয়, কোন রঙের সঙ্গে কোন রঙ মেশালে কোন রঙ হয় তা শেখান। কেমন করে প্যালেট থেকে অবশিষ্ট রঙ ধুয়ে ফেলতে হয় এসব শিখতে শিখতে স্টুডিওর পরিবেশ ভালো লেগে যায় পিকাসোর। বাবাও স্টুডিওতে পেয়ে আনন্দিত। 

বাবা হোজে পাঁচ বছর পরেই কোরুনা থেকে বার্সেলোনার 'লা লোঞ্জা আর্ট স্কুলে' চারুকলার শিক্ষক হিসেবে চাকরি নিয়ে চলে যান। এ সময়েই ঘটে পিকাসোর জীবনে প্রথম মানসিক আঘাতের ঘটনা। ছোট বোন কঞ্চিতা মাত্র সাত বছর বয়সে মারা যায়। এরপর পুরো পরিবার বার্সেলোনা চলে আসে। বার্সেলোনা অনেক বড় শহর। এ শহরে পাবলো মনের মতো করে ছবি আঁকার সুযোগ পেলেন। এখান থেকে ফ্রান্স যাওয়া সহজ। আন্তর্জাতিক শিল্প সাহিত্যের ঢেউ এসে এখানে লাগে। এ সময় তিনি 'অয়েল অ্যান্ড চ্যারিটি' নামে একটি ছবি আঁকলেন। ছবিটি দেখে বাবা নিজেই মাদ্রিদে জাতীয় প্রদর্শনীতে পাঠিয়ে দেন। সেখানে ছবিটি মর্যাদার আসন লাভ করে। পরে জন্মভূমি মালাগার একটি প্রদর্শনীতে ছবিটি আবার পাঠালেন তাঁর বাবা। সেখানে ছবিটি স্বর্ণপদক পায়। এভাবে কিশোর পাবলো সসম্ভ্রমে প্রবেশ করেন শিল্পী জীবনে। 

স্পেনে অল্প বয়স থেকেই শিল্পীর শিল্প চিন্তার বিকাশ ঘটে। মাত্র তেরো বছর বয়সে পিকাসোর হাতে রং তুলি তুলে দিয়ে আঁকা থেকে তিনি বিশ্রাম নেন। বাবা তাঁর ছেলের ছবি আঁকার ক্ষমতা দেখে অভিভূত হন।পিকাসোর অল্প বয়সের আঁকা ড্রয়িংগুলো দেখে সমালোচকরা তাঁকে রাফালের সমকক্ষ বলতেন।পিকাসো নিজে বলতেন, "আমার ছবি আমার চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। আমাকে দিয়ে সে তার চাহিদা মাফিক কাজ করিয়ে নেয়। "পিকাসো জীবনের প্রতিটি ধাপ এগিয়ে গেছেন শিল্পেরই প্রয়োজনে, শিল্পের আহ্বানে। ষোলো বছর বয়সে পেইন্টিং এর যাবতীয় প্রায়োগিক তথ্য জানা হয়ে গেছে পিকাসোর। জ্বরে আক্রান্ত হয়ে যখন তিনি বার্সেলোনায় ফেরেন, সেখানে ডিপথেরিয়া রোগে সাত বছরের বোনের মৃত্যু তাঁর বুকে শক্তিশেল বেঁধে।
মাত্র চোদ্দ বছর বয়সে ধর্মীয় সংক্রান্ত কিছু ছবি আঁকেন, যা তিনি কখনো বিক্রি করেননি। পিকাসোর বয়স যখন কুড়ি তখন দারিদ্র‍্য তাঁর নিত্য সঙ্গী। এরমধ্যে তিনি আধুনিকতার ছোঁয়া পেতে চলে এলেন প্যারিস। এখানেই খুলে গেল তাঁর জীবনের হাজার জানালা।পেলেন এক শরতের মেঘমুক্ত আকাশ। 'আবস্যাঁত পান' (absaat Pan) এর মতো একাকিনী নারীর গেলাসের সঙ্গে কথা বলার ছবি। রঙের ব্যবহারে অন্য সব রঙকে ছাপিয়ে যাচ্ছে নীল রঙ।এটাই পিকাসোর জীবনে (১৯০১-১৯০৪) নীল অধ্যায় বা ব্লু পিরিয়ড। বন্ধু কার্লোস কাসাহেমাস-এর আত্মহত্যার বেদনায় তাঁর জীবনে শুরু হবে নতুন অধ্যায়। তাঁর তুলিতে তখন আঁকা হচ্ছে দারিদ্র্য নিপীড়িত বিপন্ন মানুষের ছবি। এ যেন তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে, দুঃখ যন্ত্রণা কষ্টের সঙ্গে শুরু হলো রং আর তুলির যুদ্ধ। তখন খাবার বা রং তুলি কেনার পয়সা নেই। যেখানে তিনি থাকেন, সেই মানাক-এর চিলেকোঠায় যথেষ্ট জায়গা নেই। ভীষণ শীতে যখন ঘর গরম করার প্রয়োজন পড়ত, তখন তিনি অনন্যোপায় হয়ে তাঁর আঁকা ছবি পুড়িয়ে বাধ্য হতেন শীতের ঠান্ডাকে দূরে ঠেলতে। এই নিত্যসঙ্গী অভাব আর সৃজনশীলতাকে সার্কাসের রিং মাস্টারের মতো পোষ মানাতে চেয়েছেন। এখন থেকে তিনি পরিচিতি পেতে শুরু করলেন। শিল্প মাধ্যমের ওপর তাঁর ক্ষমতা, প্রতিভা স্বীকৃতি পেতে শুরু করে। এবার শুরু হবে তাঁর জীবনের কমলা ও গোলাপি রং দিয়ে আঁকা, তাঁর জীবনের গোলাপি পর্ব। পিকাসোর জীবনের সবচেয়ে বড়ো বৈশিষ্ট্য, তিনি প্রত্যেক পর্যায়ে তাঁর আগের পর্যায় থেকে সরে এসেছেন। 

এই পর্যায়ে ঘটান তাঁর চিত্র ভাষার নতুন বিস্ফোরণ। আঁকলেন 'লে দ্যমোয়াজেল দাভিন্যাঁ (les Demoiselles D'avignon)-১৯০৭.ইতিমধ্যে সেজাঁ-র হাত ধরে ইউরোপে কিউবিজমের সূত্রপাত হয়ে গিয়েছে। পিকাসো তাঁর ছবিতে কিউবিজমের সঙ্গে নিজস্ব নতুন স্টাইল জুড়ে নিরীক্ষা শুরু করলেন। তিনি এবার ছিঁড়ে ফেলবেন শিল্পের পুরনো ধ্যান ধারণা। লে দ্যমোয়াজেল দাভিন্যাঁ ছবিটি দেখে অনেকে মন্তব্য করেছে ছবিটি অশ্লীল। সেই সময় ছবিতে এই ধরনের নান্দনিক শারীরিক বিকৃতি অন্য কেউ ছবিতে ফুটিয়ে তুলতে পারেননি। এ এক নতুন অভিজ্ঞান, সত্যকে আবিষ্কারের নতুন পদ্ধতি, যা পুরনো তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। কিউবিজমের আধুনিক দুই স্রষ্টা পিকাসো আর ব্রাকের হাত ধরে কিউবিজম পেলো এক নতুন ফর্ম। পিকাসোর ভাষায়-"ব্রাক বলতেন ছবিতে যে জিনিসটি আসল তাহলো উদ্দেশ্য। কিউবিজমের ক্ষেত্রে  যা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ তা হল, তুমি কী করতে চাইছো, কী তোমার উদ্দেশ্য। উদ্দেশ্য, যাকে আঁকা যায় না।

এই যুগান্তকারী ছবিতে  প্রতিটি নারী শরীর আলাদা আলাদা উপাদান দিয়ে তৈরি, যা পরস্পর বিরোধী তান ও লয় সৃষ্টি করেছে। তিনি যেন পরশুরাম। কুঠার হাতে নিয়েছেন শিল্পী ও শিল্প সর্ম্পকে পুরনো যা ধ্যান ধারণা সব পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন করবেন। পিকাসোর ভাষায়, "যখন আমি একটি বাটি আঁকছি, অবশ্যই আমি দেখাতে চাইছি সেটি গোল। কিন্তু ছবির সাধারণ ছন্দ, তার কম্পোজিশনের গঠন আমাকে বাধ্য করতে পারে দেখাতে যে সেটি চৌকো।----আমি উদ্দামভাবে ধাক্কা মারতে চাই, সেদিক থেকে আমি এক ট্রাম্প, ভবঘুরে। 
বিখ্যাত শিল্পী যোগেন চৌধুরী বলেন, "পিকাসো তো শুধু ছবি আঁকিয়ে ছিলেন না। আর্টের বিভিন্ন ধরনের মধ্য দিয়ে তিনি  নিজেকে প্রকাশ ঘটিয়েছেন।" 
পিকাসো নিজেও বলতেন, ছোটোবেলায় তিনি ওল্ড মাষ্টারদের মতো ছবি আঁকতেন। আর বড় হয়ে আঁকি শিশুদের মতো। তাঁর ছবিতে  ছিল সেই স্বাধীনতা, কোনোকিছুকে পরোয়া না করা। তিনি নানাভাবে ছবিকে ভাঙার কাজ করেছেন। রাতের পর রাত জেগে যুদ্ধ করেছেন বলগা হীন ষাঁড়ের মতো। ১৯০৫ সালে আপোলিনে-এর সঙ্গে বা মাতিসের সঙ্গে দেখা হওয়া যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি অসংখ্য নারীর সাথে।পিকাসোকে কি ঝড় বলবো? না, মহাপ্রলয়?
পিকাসো তাঁর শিল্পী জীবনে যখন নীল অধ্যায় শুরু করেছেন, তখন, ১৯০৪ সালে লালের আভা নিয়ে হাজির হন পিকাসোর চেয়ে চার বছরের বড়ো ফার্নান্দে অলিভিয়া। ১৯০৪-১৯১২ সাত বছরের বেশী সময় তিনি শিল্পীর সঙ্গে ছিলেন। তাঁকে নিয়ে আঁকা পিকাসোর ভাস্কর্য-নারীর মাথা(The Head of Women) -১৯০৯।

ফার্নান্দো অলিভিয়ে ছেড়ে যান ১৯১২ সালে।সেই সময় প্রবেশ করেন ইভা গুয়েল। পিকাসো একত্রিশ।১৯১৫ সালে ইভা গুয়েলের মৃত্যু হয় যক্ষায়। তাঁকে নিয়ে আঁকা 'ওমেন ইন আর্মচেয়ার'( Women In Armchair)-১৯১৩। ইভাকে নিয়ে এটি তাঁর শ্রেষ্ঠ কীর্তি। এরপর আসেন ব্যালে নৃত্যশিল্পী ওলগা খোকলোভা। ১৯১৮ সালে তাদের বিয়ে হয়। বিয়ের স্বাক্ষী জ্যাঁ ককতো। বিয়ে তাঁদের সুখের হয়নি। তাঁকে নিয়ে পিকাসোর ছবি 'হাতলওয়ালা চেয়ারে ওলগা'(Olga in chair)-১৯১৩। ১৯২১ সালে জন্মে পুত্র পাওলো।

খোকলাভো-এর সর্ম্পক থাকা অবস্থায়, তিনি ম্যারি-থ্যারিস ওয়াল্টার নামে এক তরুণীর প্রেমে পড়েন। এই সময় তিনি স্ত্রী থেকে আলাদা থাকতেন।ওয়াল্টারকে নিয়ে ছবি আঁকেন 'স্বপন' ও 'ঘুমন্ত' নামে দুটি ছবি। পিকাসো এবং ওয়াল্টারের একটি কন্যা সন্তান হয়। এর কিছুদিন পর ফ্রাঁসোয়া জিলো তাঁর জীবনে আসেন। ফ্রাঁসোয়া জিলো ও পিকাসোর দুটি সন্তান হয়েছিল। এরপর তাঁর জীবনে আসে ডোরা মার। এইসময়  আঁকেন ছবি 'গর্ণিকা'(Gaurnica)-১৯৩৭। আর 'দ্য উইপিং ওমেন'(The Weeping Women)-১৯৪৩। এরপর জেনভিয়েভ লেপার্তকে নিয়ে ছবি আঁকলেন 'জেনেভিয়েভ পোর্ট্রেট'(Zenviev Potrait)-১৯৫১। তারপর বিয়ে করেন জ্যাকুলিন রোক কে।তখন পিকাসোর বয়স ঊনআশি আর জ্যাকলিনের বয়স ছাব্বিশ। তাঁকে নিয়ে সবচেয়ে বেশী পোট্রের্ট  আঁকেন পিকাসো। প্রায় সত্তরটির মতো। বিখ্যাত পোট্রের্ট 'জ্যকুলিন উইথ ফলাওয়ার্স'-১৯৬৫. মৃত্যুর শেষদিন পর্যন্ত জ্যাকলিন পিকাসোর সঙ্গে ছিলেন। প্রকৃতপক্ষে, পিকাসোর জীবনে একের পর এক নারী তাঁর চিত্রকর্মকে জীবনীশক্তি দিয়েছে। তাঁর ধারণা যদি কাজ না করেন, তাহলে বুড়ো হয়ে যাবেন। যাতে দেহ বুড়ো না হয়, সে কারণে নারীর প্রয়োজন। 
কিছুদিন আগে লন্ডনে একটি চিত্র প্রদর্শনী হয়।সেখানে পিকাসোর ২৬,০৭৫টি ছবি স্থান পায়।পিকাসো বেঁচে ছিলেন ৩৩,৪০৩ দিন। হিসাব করলে দেখা যায়, কুড়ি বছর বয়স থেকে মৃত্যু পর্যন্ত গড়ে প্রত্যেকদিন একটি করে ছবি এঁকেছেন।
এ কি ধ্বংসের কবিতা? এলিয়ট এর 'দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড' এর শিল্পরূপ? না। এর প্রবল শক্তি আকাশছোঁয়া। ১৯১৮ সালে অকালমৃত আধুনিক ফরাসি কবিতার উদগাতা আপোলিনের মৃত্যুর আগে পিকাসোকে লিখেছিলেন-- "আমি এই মুহুর্তে যে কবিতা লিখছি, তা আপনার চিন্তাধারার খুব কাছের। আমি কবিতার শৈলীকে বদলে দিতে চেয়েছি, একটি ক্ল্যাসিক্যাল ফ্রেমওয়ার্কের মধ্যে।" আক্রমণাত্মক নতুন ভাবনা, শিল্পের অন্তর্গত পরিবর্তন এবং শান্ত ও কঠিন ক্ল্যাসিক্যাল বিন্যাস পরস্পর বিরোধী নয় আর। ১৯১৭ সালের মে মাসে জাঁ ককতো'র একটি ব্যালের সঙ্গে ইতালি ভ্রমণের পর পিকাসো ক্রমশ বিশ্লেষণ ও ব্যবচ্ছেদ মূলক কিউবিজম থেকে দূরে সরে যান। ১৯১৯ সালে টেম্পেরা, জলরং ও পেনসিলে আঁকা "ঘুমন্ত চাষিরা" বা ১৯২২ সালে আঁকা প্লাইউডের ওপর তেলরঙ "সমুদ্রবেলায় দৌড়নো নারীরা" তার প্রমাণ। যেন এবার কিউবিজমের প্রশ্নময়তাকে থমকে দিয়ে বিমূর্ত থেকে বাস্তবে ফিরে আসছেন তিনি। 
ভেঙে দেওয়া ফর্ম, যা পিকাসোর চিরকালের বৈশিষ্ট্য, হয়ে উঠছে বিপর্যয় ও বিভ্রান্তির প্রতীক। এইভাবে ইতিহাসের এক বিশেষ মুহূর্তে পিকাসোর 'গের্নিকা' হয়ে উঠছে বহুচেতনার (Collective consciousness) অঙ্গ, ইতিহাসের শিলালিপি। 
আপনারা চান আমি আপনাদের বলি 'শিল্প কী?' যদি জানতাম, নিজের কাছে রেখে দিতাম সেই জ্ঞান। 
যদি জানতাম কী করতে চলেছি, কী লাভ হত তা করে? জানলে তো কাজটার কোনও অর্থই হয় না। অন্য কিছু করাই ছিল ভালো। 
২০১৫ সালের ১১ই মে কিংবদন্তী চিত্রশিল্পী  পিকাসোর আঁকা "দ্য উইমেন  অব আলজিয়ার্স" (The Women Of Algiers)-১৯৫৫. ছবি বিশ্বের সবচেয়ে দামী শিল্পকর্ম হিসেবে, নিলামে ১৭ কোটি ৯৩ লক্ষ ৬৫ হাজার মার্কিন ডলারে বিক্রি হয়। যা ভারতীয় মুদ্রায় ১৩৫ কোটি টাকারও বেশি। এতে পিকাসোর কিউবিক ধারার ছাপ রয়েছে। ১৯৪৪ সালে তিনি প্যারিসের কম্যুনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। আমৃত্যু তার সদস্য ছিলেন। এইসময় ছবি আঁকেন 'দোভ অব পিস'(Dove Of Peace)-১৯৫০. পিকাসো ছবি  আঁকার পাশাপাশি কবিতাও লিখতেন। তিনি লেখেন,"আমি জানিনা কিসের জন্য পৃথিবী লড়ছে/কিংবা কেন আমাকে প্ররোচিত করা হচ্ছে /সেইজন্যই আমি এই শুনশান রাস্তায় হাঁটি কেননা আমি থাকতে চাই /একা।"(অনুবাদ -মলয় রায়চৌধুরী)। 

১৯৭৩ সালের ৮ এপ্রিল ভোর তিনটা পর্যন্ত ৯১ বছর বয়সী পিকাসো ছবি এঁকেছেন। তারপর ঘুমিয়ে পড়েন। সকালে বিছানা থেকে নামতে কষ্ট হচ্ছিল 
তিনি জ্যাকুলিনের নাম ধরে ডাকেন। দশ মিনিট পর তার মৃত্যু হয়। মৃত্যুর কারণ বড় মাপের হার্ট অ্যাটাক। নিজেকে দিয়ে আঁকা সর্বশেষ সেলফ পোর্ট্রেট শেষ করেন ৩০ জুন ১৯৭২। সে পোর্ট্রেটের নাম-- 'সেলফ পোর্ট্রেট ফেইসিং ডেথ'(Self Potrait Faceing Death)-১৯৭২। মৃত্যুর মুখোমুখি আত্মপ্রতিকৃতি। কাগজের ওপর ক্রেয়নে আঁকা এই পোর্ট্রেট পিকাসো তার নিজের মুখের ওপর স্থাপন করে তাঁর বন্ধু পিয়েরে দাইকে দেখিয়েছেন। তাঁর মনে হয়েছে, এখানে ভীতির অভিব্যক্তি আসলে পিকাসোর একটি কৌশল। তিন মাস পর পিয়েরে আবার যখন পিকাসোর কাছে যান, দেখতে পেলেন ছবির রুঢ় দাগগুলো আরো গভীর হয়ে আছে, তিনি অপলক তাকিয়ে আছেন, তাঁর মনে হয়েছে পিকাসো সরাসরি নিজের মৃত্যুর দিকে তাকিয়ে আছেন।

এই মহান ব্যাক্তিত্বকে আমি কিসের সাথে তুলনা করবো? লম্বায় যদিও ৫' ফুট ৩" ইঞ্চি, তবু তাঁর মাথা আকাশ পেরিয়ে যাবে। বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বিষ্ময়কর প্রতিভা। ধ্রুবতারার সঙ্গে তুলনা? তা-ও ঠিক হবে না। কালের প্রভাবে ধ্রুবতারা একদিন ধ্বংস হতে পারে। কিন্তু মানুষ যতদিন থাকবে, ততদিন পাবলো পিকাসো। কারণ সব হিসাব নিকাশ ওলোট পালোট করে Balance- Sheet-এ দেখিয়েছেন, পৃথিবীর কাছে থেকে গেছে তাঁর পাওনা। যার জন্য এ পৃথিবীর সবাই তাঁর কাছে ঋণী--শিল্পের জন্য, কবিতার জন্য, নাটকের জন্য। তাই নিজেকে নিজে প্রশ্ন করি-"তুমি কি লজ্জা পাও নিজের সত্তার বন্দরে? বা "তুমি কি ক্রুদ্ধ হও নিজের সত্তার বন্দরে?"(নবারুণ ভট্টাচার্য)
______________________
আরও পড়ুন 
আধুনিক চিত্রশিল্পের ইতিহাস 
শ্যামল জানা 

নিয়মিত পড়ার জন্য জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

3 Comments

  1. ভীষণ ভালো লেখা।সমৃদ্ধ হলাম।

    ReplyDelete
  2. ভীষণ ভালো লেখা।সমৃদ্ধ হলাম।

    ReplyDelete
  3. ভীষণ ভালো লেখা।সমৃদ্ধ হলাম।

    ReplyDelete