জ্বলদর্চি

২২ শে শ্রাবণ/ বিশ্বজিৎ কর

চেতনায় রবিঠাকুর! 

বি শ্ব জিৎ ক র

বেশ মনে পড়ে, চতুর্থ শ্রেণীতে পড়াকালীন আমার প্রথম কবিতা লেখা! আজও শিহরণ জাগায়, সামনে রবিঠাকুরের "হাট" খুলে লিখেছিলাম -"বাগদিপাড়ার ঠেলাগাড়ি, তার উপরে গুড়ের হাঁড়ি!" বাড়ির লোকজনের সে কি হাসাহাসি, মা পিঠে হাত রেখে বলেছিলেন-"খুব ভাল হয়েছে, আরো অনেক লিখতে হবে!"
কবিগুরু তখন ক্রমশ আমার কাছের হয়ে পড়ছেন, রঘুডাকাতের গল্পে মন বসত না! 'জীবনস্মৃতি'-র পাতায় পাতায় তখন ঘুরে বেড়াতাম! 
পঞ্চম শ্রেণীর বাংলা পাঠ্যবই-এ "অমল ও দইওয়ালা" কোথায় যেন নাড়া দিয়ে যেত!অসুস্থ অমলের বন্ধু হতে মন চাইত,তার রাজার কাছে চিঠি লেখার ছটফটানি,পাঁচমুড়া পাহাড়ের তলায় শামলী নদীর তীরের দৃশ্যের অবতারণা,বুড়ো বটতলার গোয়ালাপাড়া থেকে দই নিয়ে বিক্রি করা,ছটফটে সুধার কথা......! 
চোখে ভেসে উঠত গ্রামবাংলার রাঙামাটির পথ,কলসি-কাঁখে নেওয়া গ্রাম্যবধূ,জমিহারা উপেন....! 
তখন ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ি,'মঞ্চস্থ' করলাম বাবার ডাকঘরের বারান্দায় "অমল ও দইওয়ালা"!চুলে সাদা রং লাগিয়ে,কাঁচাপাকা দাঁড়ি-গোঁফ লাগিয়ে আমি অমলের পিসেমশাই আর বন্ধু অমল অমলেরই ভূমিকায়! 
ঠিক এইভাবেই কবিগুরুতে আচ্ছন্ন হওয়ার চিত্রনাট্য লেখা শুরু হল!৫ম থেকে ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে প্রথম হয়ে ওঠার সুবাদে ইস্কুল থেকে উপহার পেয়েছিলাম রবিঠাকুরের "কাবুলিওয়ালা"!আনন্দে-উচ্ছ্বাসে আত্মহারা হয়ে গিয়েছিলাম! 
হয়তো বা তখন থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছিল শিরা-ধমনীতে রবি-রক্তের নিরবচ্ছিন্ন ফল্গুধারা!মঞ্চে মঞ্চে রবীন্দ্র-কবিতাপাঠের আকাশছোঁয়া বাসনা-"আজি এ প্রভাতের রবির কর... ","গ্রামে গ্রামে সেই বার্তা রটে গেল ক্রমে....... "!
পঁচিশে বৈশাখ এলেই ঘরের বারান্দায় ঠাকরপুজোর তোড়জোড়,বাবার চেয়ারে মায়ের হাতে তৈরি টেবিল-ক্লথ্ মুড়ে ঠাকুর বসানো,কলকে ফুলের মালা আর ধূপের ধোঁয়া,তারপর সমবেত স্বরে "আলোকের এই ঝর্ণাধারায়....."
শৈশব,কৈশোর পেরিয়ে যৌবনের দ্বারপ্রান্তে আসতেই শয়নে-স্বপনে-সোহাগে-ভালবাসায়-শোকে-বিহ্বলে শুধুই রবীন্দ্রনাথ!কতটুকু বুঝেছি,কতটুকু জেনেছি বিশ্বকবিকে-জানি না!জীবনদর্শনের পাতায় পাতায় রবীন্দ্রনাথ এক সচেতনতম শব্দ! 
আকাশে বাতাসে চোদ্দোশো সাতাশে,প্রখর রবি-তাপে সোনারতরী ভাসে!এই শ্রাবণের মহুয়া'-গন্ধে নতুনের কলতান, তবুও আর্তনাদ কেন? 
এখনও পথ চলেছি পথভোলা এক পথিকের আলখাল্লা পড়ে! সঞ্চয়িতার পাতা ওল্টানোর আলোতে পথ দেখি, অনুরণিত হয় এই আনন্দ-বসন্তে সেই অমোঘ বাণী "আছে দুঃখ আছে মৃত্যু"!
সাথে অবশ্যই আছে "আগুনের পরশমণি"-র ছোঁয়া! 
পরিশেষে নিজের কথা বলি -
রাত্রিকে কাছে নিতে চেয়েছিলাম, তুমি বলেছিলে -"রবীন্দ্রনাথ পড়ো! "আমি এখন নৈঃশব্দের সেনানী, "হিমের রাতের ঐ গগনের দীপগুলি"-র আলোয় আমি এখন মানুষ চিনতে পারছি! 
অবসর জীবনের প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে মাঝেমাঝে গেয়ে উঠি-"যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন.....! "



Post a Comment

0 Comments