জ্বলদর্চি

২২ শে শ্রাবণ / বিশ্বেশ্বর চক্রবর্ত্তী

প্রসঙ্গ: 'চোখের বালি'-র নারী চরিত্রের আধুনিকতা


বি শ্বে শ্ব র  চ ক্র ব র্ত্তী

বাংলা সাহিত্যজগতে যখন রবির উদয় হল  তখন মধ্যযুগীয় বাংলার স্মৃতি ম্লান হয়ে  পাশ্চাত্য সাহিত্য রচনার রীতি অনুসরণে বাংলায় সাহিত্যরচনা শুরু হয়ে গিয়েছে। একদিকে মাইকেল, অন্যদিকে বঙ্কিম সাহিত্যে যে যুগান্তর নিয়ে এলেন, তারই অনতিকাল পরে রবীন্দ্রনাথের  আবির্ভাব । 
সাহিত্যের বিভিন্ন আঙ্গিকের স্রষ্টা রবীন্দ্রনাথ উপন্যাসে নিয়ে এলেন নতুন ধারা। উপন্যাসের চরিত্রগুলির গভীর মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণ করে পাঠকমহলের অন্দরে প্রবেশ করলেন যা ইতিপূর্বে বাংলা সাহিত্যে দেখা যায়নি। আধুনিক  বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের সার্থক মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস হল 'চোখের বালি' (১৯০৩)।
আদিম প্রবৃত্তি অনুযায়ী সমাজবিরুদ্ধ আচরণ বা ব্যভিচারের ইচ্ছা মানুষের স্বাভাবিক ধর্ম হলেও প্রত্যেক দেশের যে নিজস্ব সমাজ আছে তার সঙ্গে মানিয়ে চলা একান্তই কাম্য, আধুনিক মনোবিজ্ঞানের এই অভিমতকে মান্যতা দিয়ে রচনা করলেন এই উপন্যাস।  উপন্যাসের মূল চরিত্রগুলির অন্যতম চরিত্র ‘বিনোদিনী’-র মধ্য দিয়ে আধুনিক নারীমনের সুনিপুণ বিশ্লেষণ করলেন। ‘বিনোদিনী’-কে ঘিরেই উপন্যাসের অন্যান্য চরিত্রগুলি আবর্তিত হয়েছে। সে সুন্দরী, শিক্ষিতা হয়েও  ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে অতৃপ্ত কামনা নিয়ে বৈধব্যের কঠোর জ্বালা সহ্য করছিল। তার চরিত্র বিশ্লেষণ দেখা যায় যেমন তার গুণ, তেমনি তার অন্তরের শক্তি। মহেন্দ্রের সঙ্গে একদা তার বিবাহের কথা উঠেছিল – একথা সে কিছুতেই ভুলতে পারে না। বৈধব্যের অবরুদ্ধ কামনা নিয়ে সে মহেন্দ্র ও আশার বিবাহিত জীবনের প্রতি উৎসুক নয়নে চেয়ে থাকে আর ভাবে অপরিণত বুদ্ধি আশা যেখানে অসমর্থ হাতে সুখের সংসার করছে সেখানে যে আরও যোগ্যতর ছিল এ কথা শুধু তার অবচেতন মনে নয়, সচেতন মনেও আসতে থাকে।
“এমন সুখের ঘরকন্না, এমন সোহাগের স্বামী” চোখের সামনে দেখে  ‘বিনোদিনী’-র অন্তর অগ্নিদাহের যন্ত্রনায় ক্রমশ অস্থির হয়ে উঠছিল। মহেন্দ্রের সংসারে ‘বিনোদিনী’ নামক বিষবৃক্ষের বীজ বপন করেছিলেন রাজলক্ষ্মী এবং সেই বীজকে চারাগাছে পরিণত করেছিল আশার সখীত্ব। সেই চারাগাছ বিষবৃক্ষে রূপান্তরিত হল আশা আর মহেন্দ্রের মধুর দাম্পত্য দশর্নে। বুদ্ধিমতী ‘বিনোদিনী’-র একথা বুঝতে দেরি হয়নি যে, মহেন্দ্রের সংসারে সে আকাঙ্খিত শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা কোনদিনও পাবে না। আর তাই মহেন্দ্রকে নিয়ে সংসার পরিত্যাগের  ভাবনা  ঠাণ্ডা মস্তিষ্কে অতি সুচারুভাবে সে সাজিয়েছিল। 
‘বিনোদিনী’ চরিত্রের বিশ্লেষণ অসম্পন্ন থেকে যেত বিহারীকে ছাড়া। উপন্যাসে মহেন্দ্র যদি স্বচ্ছ পুষ্করীনি হয় তবে বিহারী ছিল অতল সমুদ্র। বুদ্ধিমতী বিনোদিনী তাই অনায়াসেই মহেন্দ্রর ভেতরে প্রবেশ করতে পেরেছিল।  মহেন্দ্র চরিত্রের দুর্বলতাই মহেন্দ্রকে ‘বিনোদিনী’-র হাতের পুতুল করে দিয়েছিল। অপরদিকে বিহারী চরিত্রের দৃঢ়তার কাছে  তার সমস্ত চাতুরী ধরা পড়ে যায়। শ্রদ্ধার কাঙাল ‘বিনোদিনী’ বিহারীর কাছ থেকেই সেই অনুভূতি পেয়েছিল। কিন্তু পরে বিহারীর উপেক্ষা আর ঘৃণা ও আশার প্রতি তার (বিহারীর) মমতা ‘বিনোদিনী’-র হৃদয়ের জ্বালা দ্বিগুণ করে তুলল। সমস্ত লাজ বিসর্জন দিয়ে, বিহারীকে সে বলে –
“আমি সত্যই বলিতেছি তুমি যদি আশাকে ভাল না বাসিতে তবে আমার দ্বারা আশার আজ এ সর্বনাশ হইত না ।”
পূর্বে বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বিষবৃক্ষ’-এর ‘কু্ন্দনন্দিনী’-কে বা ‘কৃ্ষ্ণকান্তের উইলে’-র ‘রোহিণী’-কে সমাজের বিরূদ্ধাচরণ করার জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি পেতে হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের ‘বিনোদিনী’ ঘর বাঁধতে চায় কিন্তু জীবনের বড় কামনা যেদিন সার্থকতার মূর্তিতে দেখা দিল সেদিনই সে নিজেকে সংযত করে নিয়েছে। 
লেখক এখানে সংস্কারের প্রতিকূলে কাহিনী পরিবেশন করেননি। সমাজের কল্যাণে ও দেহাতীত প্রেমকে প্রতিষ্ঠা দেওয়ার জন্যই কাহিনীর শেষে মহেন্দ্রকে আশার কাছে ফিরিয়ে দিয়েছেন ও ‘বিনোদিনী’-র তাদের দাম্পত্য এবং বিহারীর  জীবন থেকে সরে যাওয়ার সিদ্ধান্তকে সম্মান জানিয়ে একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন আলোকে ও আধুনিকা নারীর স্বাতন্ত্র্যে ভাস্বর করে প্রতিষ্ঠা করেছেন।
“চোখের বালি” উপন্যাসের সূচনায় রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং তাঁর এই রচনাটিকে বাংলা সাহিত্যক্ষেত্রে ‘আকস্মিক’ এবং অভিনব বলে স্বীকার করেছেন। এই অভিনবত্বের ভিত্তি হল লেখকের ভিন্ন জীবনবোধ যা তিনি তাঁর ‘বিনোদিনী’ চরিত্রের মধ্যে  সম্পৃক্ত  করেছেন। মূলত, সেই কারণেই,  বাংলা উপন্যাসের ইতিহাসে প্রথম আধুনিকা নারী  চরিত্র হিসেবে ‘বিনোদিনী’ ও প্রথম মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস হিসেবে 'চোখের বালি' পাঠকের হৃদয়ে আজও অমর হয়ে রয়েছে।


                                                                                                                              

Post a Comment

0 Comments