Arena from the gallery
গ্যালারি থেকে Arena
পর্ব - ১
অ ভি ন ন্দ ন মু খো পা ধ্যা য়
এক কোচ এবং তার হার না মানা টিম
ফাইনালের আগের রাত। দুর্ধর্ষ স্নায়ুর চাপে ভুগছে সব প্লেয়াররাই। এক অনবদ্য ইতিহাসের মুখোমুখি ভারতীয় ফুটবল। এই ম্যাচ জিতলে এশিয়া সহ পুরো বিশ্বের দরবারে অন্যতম শক্তি হিসেবে নিজেদের তুলে ধরা যাবে। এমন দিনে ঘুমোনো সত্যিই বড় অসম্ভব এক কাজ। এমনকি বিছানায় শুয়ে থাকাও কার্যত দুষ্কর। কিন্তু কতক্ষণ আর বিছানায় এপাশ –ওপাশ করা যায়। চুনী গোস্বামী, পি.কে ব্যানার্জী, বলরাম, জার্নাল সিং, ত্রিলোক সিং, ফ্র্যাঙ্কো সহ অন্য প্লেয়াররা সিদ্ধান্ত নিলো ‘চলো একটু হেঁটে আসা যাক। যদি ঘুম পায়। একদম নির্ঘুম অবস্থায় পরের দিন মাঠে নামা কঠিন হয়ে যাবে।'
সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসার সময়েই সবার চোখে পড়ে ছিল দৃশ্যটা। দূরে অন্ধকারে একটা ছোট্ট আগুনের ফুলকি একটু বড় হচ্ছে। আবার ছোট হয়ে যাচ্ছে। সবাই একটু চমকে গেল। কী ওটা! ভূত! নাকি অন্য কিছু! ফুলকির আকৃতি বদলের কোনো পরিবর্তন হলো না। খানিকটা ভয়ের সৃষ্টি হয়েছে সবার মধ্যেই। কিন্তু এভাবে তো দাঁড়িয়ে থাকা যাবে না। হয় এগিয়ে গিয়ে দেখতে হবে অথবা নির্ঘুম বিছানায় ফিরে যেতে হবে। প্লেয়াররা সিদ্ধান্ত নিল এগিয়ে গিয়ে দেখাই যাক আদতে ওটা কী। সেই আগুনের ফুলকির ধারে অপেক্ষা করছিল এক তুমুল চমক। কোচ রহিম সাহেব খুব ধীরে পায়চারি করছেন। হাতে মুঠো করে ধরা জ্বলন্ত চারমিনার সিগারেট। প্লেয়ারদেরকে দেখে মনে হলো না উনি অবাক হয়েছেন। খুব স্পষ্ট ভাবে বুঝতে পারছিলেন টেনশনটা। প্লেয়ারদের বললেন ‘চলো হাঁটা যাক।' খানিকটা যাওয়ার পর হঠাৎ-ই হাঁটার গতি স্তব্ধ করে ধরা গলায় বললেন ‘কাল মুঝে আপ লোগো সে এক তোফা চাহিয়ে।' খানিকক্ষণ নিস্তব্ধতা। তারপর আবার সেই ধরা গলা ‘কাল আপ লোগ সোনা জিত লো’।
সালটা ১৯৬২। জাকার্তা এশিয়ান গেমস। সেবার অসাধারণ ভারতীয় ফুটবল টিম। গোলে থঙ্গরাজ এবং প্রদ্যুত বর্মন। ডিফেন্সে জার্নাল সিং, অরুণ ঘোষ, চন্দ্রশেখর,ত্রিলোক সিং। মাঝমাঠে এফ.এ.ফ্রাঙ্কো, রাম বাহাদুর, আফজল, প্রশান্ত সিনহা। ফরোয়ার্ডে পি.কে.ব্যানার্জী, চুনী গোস্বামী, বলরাম, অরুময়নিগম, এথিরাজ এবং ইউসুফ খান। আর সবার মাথার উপরে কোচ রহিম সাহাব। পুরো নাম সৈয়দ আবদুল রহিম। যিনি শুধু কোচ নন একজন টিমম্যান। সমস্ত ফুলকে একই সুতোয় গাঁথার মূলসূত্র। যার ফুটবল মস্তিষ্ক টক্কর দেবে পৃথিবীর সেরা কোচদেরকেও।
শুরুটা ভাল হলো না। গ্রুপ লিগের প্রথম ম্যাচেই ভারত হেরে গেল কোরিয়ার কাছে ২-০ গোলে। টুর্নামেন্টের ফার্স্ট ম্যাচেই হার কিছুটা চাপে ফেলে দিল টিমকে। বাকি দুটো প্রায় মাস্ট উইন ম্যাচ। দ্বিতীয় ম্যাচে তুলনামূলক সহজ প্রতিপক্ষ থাইল্যান্ডকে ভারত উড়িয়ে দিল ৪-১ গোলে। পি.কে.ব্যানার্জী ২টো, চুনী গোস্বামী এবং বলরাম একটা করে গোল। কিন্তু এই ম্যাচেই ঘটলো এক দুর্ঘটনা। বল ক্লিয়ার করতে গিয়ে মাথা ফেটে গেল জার্নাল সিংয়ের। কপালে পড়ল ১০ টা স্টিচ। সেই সময় পরিবর্ত প্লেয়ারের নিয়ম না থাকার কারণে বাকি ম্যাচটা ১০ জনেই খেলতে হলো ভারতকে। কিন্ত এই ম্যাচেই ঘটে গেল এক অদ্ভুত ঘটনা। তার পেছনেও রয়েছে রহিম সাহাবের তুখোড় মস্তিষ্ক। ১০ জন হয়ে যাওয়ার পরে তিনি প্লেয়ারদের পজিশন একটু বদলে দিলেন। অরুণ ঘোষকে নিয়ে এলেন স্টপারে এবং ভারতের সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফরোয়ার্ড বলরামকে ঠেলে দিলেন মিডফিল্ডে। অরুণ ঘোষ বাকি পুরো টুর্নামেন্টের জন্য ওই পজিশনে দুর্দান্ত ভাবে খাপ খাইয়ে নিলেন। লিগের অন্য ম্যাচে পি.কে ব্যানার্জী এবং বলরামের গোলে ভারত জাপানকে ২-০ গোলে হারিয়ে সেমিফাইনালে পৌঁছে গেল।
সেমিফাইনালে রহিম সাহাব আহত জার্নাল সিংকে নামাতে মরিয়া ছিলেন কারণ সেই সময় অনান্য এশিয়ান টিমগুলো জার্নাল সিংয়ের বড়সড় চেহারা এবং হার্ড ট্যাকেলের জন্য তাকে রীতিমতো ভয় পেত। এই মানসিক সুবিধেটা নেওয়ার জন্যই কোচ তাকে নামিয়ে দিলেন সেন্টার ফরোয়ার্ড হিসেবে। সাউথ ভিয়েতনামের বিরুদ্ধে খেলা। সেই সময় এই টিম যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল। জার্নাল সিংয়ের টোটকা কিন্তু কাজে লেগে গেল। চুনী গোস্বামীর থ্রু ধরে ভারতের দ্বিতীয় গোল করলেন সিং। প্রথম গোল চুনী গোস্বামীর। কিন্তু শক্তিশালী ভিয়েতনাম ৫৮ মিনিটে স্কোর ২-২ করে দিল। ৭৩ মিনিটে আবার ঝলসে উঠলো চুনী গোস্বামীর পা। একটা সোলো রানে ডিফেন্ডারদের ছিটকে দিয়ে ভারতকে নিয়ে গেলেন স্বপ্নের দোরগোড়ায়।
৫ই সেপ্টেম্বর ১৯৬২, ভারত শুরু করলো ৩-৪-৩ ফর্মেশনে। সাউথ কোরিয়া ৩-২-৫ এ। প্রায় ১ লাখ দর্শক ঠাসা স্টেডিয়াম যারা ভারতের জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার সময়ও ন্যূনতম শ্রদ্ধা দেখায়নি। রহিম সাহাব প্লেয়ারদের বললেন অফসাইড ট্র্যাপ এড়িয়ে যেতে কারণ প্রবল আওয়াজে রেফারির বাঁশি শোনা যাবে না। আর বললেন রক্ত গরম করা কথা –‘ এমন খেলো যেন এই আওয়াজ স্তব্ধ হয়ে যায়’। প্লেয়াররা এতটাই চার্জড আপ ছিল যে চোট আঘাতকে উপেক্ষা করেই মাঠে নামতে প্রস্তুত ছিল। সেদিন ভারতের পক্ষে সমর্থক হাতে গোনা যায় এমন। তার মধ্যে অন্যতম ছিল পাকিস্তানের হকি দল যারা আগের দিনই ভারতকে ফাইনালে ২-০ গোলে হারিয়েছে।
১৭ মিনিটে পি কে ব্যানার্জীর দুরূহ কোণ থেকে মারা একটা শট ভারতকে লিড দিয়ে দিল। গোটা স্টেডিয়ামে শ্মশানের নীরবতা। ২০ মিনিটে জার্নাল সিংয়ের দুরন্ত ভলি লিড বাড়িয়ে দিল ২-০ তে । সেকেন্ড হাফে সাউথ কোরিয়া ১ টা গোল করলেও ফাইনাল স্কোর রয়ে গেল ওই ২-১। ১৯৫১ এরপর এক দুরন্ত কোচ আর তার এক দুরন্ত হার না মানা মনোভাবের টিম ভারতকে দ্বিতীয়বার এশিয়ান গেমসে সোনা এনে দিল।
হয়তো এই টিম সেই বছরেই চিলিতে বিশ্বকাপ ফুটবল খেলার যোগ্য ছিল কিন্তু কর্মকর্তাদের উদাসীনতায় সেই স্বপ্ন আর পূরণ হয়নি ভারতীয়দের। রহিম সাহেবেরও ছিল সেই শেষ টুর্নামেন্ট। এরপরেই উনি ফুসফুসের ক্যান্সারে মারা যান। পরে বহু কোচ ওনার আদর্শ অনুসরণ করেই এগিয়েছেন এবং নিশ্চিত ভাবেই রহিম সাহেবের সেই অমর উক্তি ঢুকিয়ে দিয়েছেন প্লেয়ারদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ‘ফুটবলটা নির্ভর করে 2L+2H এই ফর্মেশনে’। দুটো L হলো legs & lungs , আর দুটো H হলো heart & head.
প্রতি রবিবার প্রকাশিত হবে। এই ধারাবাহিক। আপনাদের অভিমত পেলে ভালো লাগবে।
2 Comments
👌👌
ReplyDeleteদারুন হয়েছে দাদা👌👌
ReplyDelete