জ্বলদর্চি

আধুনিক চিত্রশিল্পের ইতিহাস ১৫ / শ্যামল জানা

History of Modern Painting    


আধুনিক চিত্রশিল্পের ইতিহাস -১৫

শ্যা ম ল  জা না

এক্সপ্রেশনিজম (চতুর্থ অংশ)

“দ্য ব্রিজ”— এই সংগঠন থেকেই এক্সপ্রেশনিজম-এর সুত্রপাত হল৷ এটি একেবারে ঠিক কথা হলেও, এর সঙ্গে আরও একটি তথ্য যুক্ত না করলে সত্যটি একশ শতাংশ হবে না৷ “দ্য ব্রিজ”-এর সঙ্গে সম-মানসিকতায় ওতপ্রোতভাবে যুক্ত ছিল আর একটি সংগঠন৷ তার নাম “দ্য ব্লু রাইডার”, ১৯১১ সালে যার প্রতিষ্ঠা করেন ভাসিলি কান্দেনেস্কি৷ এই নামকরণ তাঁরই একটি পেন্টিং থেকে নেওয়া হয়েছিল(ছবি-১)৷

 
এখানে বলে রাখা ভালো, যে, যে তিনজনের হাতে অ্যাবস্ট্রাক্ট আর্টের সূত্রপাত ঘটেছিল, তাঁদের মধ্যে এক নম্বর ছিলেন ভাসিলি কান্দোনস্কি৷ তিনি মূলত সোভিয়েত রাশিয়ার লোক ছিলেন৷ কিন্তু ছবি সম্পর্কে তাঁর একেবারে নতুন মনোভাব বা ধারণাকে তৎকালীন সরকার আধ্যাত্মবাদ হিসেবে মেনে নিতে পারেনি বলে প্রচণ্ড মতবিরোধ হয়েছিল৷ তিনি তখন জার্মনিতে চলে এসেছিলেন৷

সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার এই যে, ছবি সম্পর্কে তাঁর এই নতুন মনোভাব বা ধারণা তৈরি হয়েছিল জার্মান এক্সপ্রেশনিস্টদের সঙ্গে যোগাযোগ হওয়ার অনেক আগেই, যখন তিনি সোভিয়েত রাশিয়াতে ছিলেন৷ পরবর্তীকালে দেখা গেল— বিস্ময়কর ভাবে এক্সপ্রেশনিস্টদের সঙ্গে তাঁর চিন্তা-ভাবনা হুবহু মিলেছে তো বটেই, বরং তাঁর চিন্তা-ভাবনাগুলি আরও বেশি ব্যাপ্ত৷ বিশেষ করে ছবির রং প্রসঙ্গে(Colour Spirituality) তাঁর চিন্তা-ভাবনাগুলি৷
যেমন— একজন যথার্থ পেন্টারের ছবি আঁকার উদ্দেশ্য কী হওয়া উচিত? সে প্রসঙ্গে তাঁর লেখার একটি ছোট্ট অংশ(ইংরাজি অনুবাদ) এখানে উল্লেখ করলে প্রাসঙ্গিক হবে—“In each picture is a whole lifetime imprisoned, a whole lifetime of fears, doubts, hopes, and joys. Whither is this lifetime tending? What is the message of the competent artist? … To harmonize the whole is the task of art.”৷
আর, সেই রং সম্পর্কে যে একেবারে নতুন ও বিস্ময়কর যে ধারণাটি তিনি দিয়েছিলেন, যা নিয়ে এত বিতর্ক, এবং যার জন্য তিনি পরবর্তীকালে অমর হয়ে থাকলেন অ্যাবস্ট্রাক্ট আর্টের জন্মদাতা হিসেবে, সেই কালার স্পিরিচুয়ালিটি সম্পর্কে একটু বলা দরকার—
যে দিন থেকে প্রকৃতিতে প্রাণ সৃষ্টি হয়েছে, সেদিন থেকেই প্রায় অজান্তেই প্রাণীদের একটি অভিজ্ঞতা হয়েছে যে, প্রকৃতির মধ্যে যা কিছু আছে, সব কিছুরই একটি নির্দিষ্ট গঠন অথবা একটি ধারণা আছে, এবং তাদের একটি নির্দিষ্ট রঙও আছে৷ আর, লক্ষ লক্ষ বছর ধরে এই অভিজ্ঞতাই তাদের মনের গহীনে আত্মার সঙ্গে সংপৃক্ত হয়ে আছে, যা প্রতি মুহূর্তে, আমাদের অজান্তে আমাদের পরিচালনা করে৷ যেমন, ধরা যাক হঠাৎ করে নিরীহ একজন মানুষ এত রেগে গেছে, যে, মাথায় খুন চেপে গেছে৷ এই সময় তাকে যদি তরল রক্ত যেভাবে গড়ায়, সেরকম গড়িয়ে যাওয়া তরল ঘন লাল রং দেখানো যায়, তাহলে তার খুন করার প্রবৃত্তি আরও বেড়ে যাবে৷ কিংবা, যদি “ধারণা” প্রসঙ্গে আসি, তাহলে— ধরা যাক আমি রাতে ছাদে শুয়ে আছি৷ চোখের ওপরে সীমাহীন ধূসর নীল রঙের আকাশ৷ তখন ওই ধূসরনীল বিশালত্বের ধারণার কাছে নিজেকে অতি অতি তুচ্ছ মনে হবে, এবং মনের মধ্যে বিষণ্ণতা(Depression)তৈরি হবে৷ তাই, অন্য যে কোনো সময়ে কোনো বিষণ্ণ মানুষ যদি বেশ খানিকটা জুড়ে ধূসর নীল রং দেখে, তাহলে সে আরও বিষণ্ণ বোধ করবে৷ এই ধরনের রং সম্পর্কিত বহু অভিজ্ঞতা আমাদের অজান্তে আমাদের আত্মার সাথে সংপৃক্ত হয়ে আছে৷  এ প্রসঙ্গে কান্দেনেস্কির লেখার ছোট্ট একটি অংশ(ইংরাজি অনুবাদ) এখানে উল্লেখ না করে পারলাম না— “The mutual influence of form and color now becomes clear. A yellow triangle, a blue circle, a green square, or a green triangle, a yellow circle, a blue square— all these are different and have different spiritual values.”৷ তাই তিনি মনে করতেন— পিয়ানোয় সুর তোলার সময়ে যেমন সঠিক রিড-এ হাত দিতে হয়, তেমনি, যেহেতু রং প্রাকৃতিকভাবে(By Nature)আত্মার সঙ্গে সংপৃক্ত, তাই, ক্যানভাসে যদি সঠিকভাবে রং প্রয়োগ না করা যায়, তাহলে দর্শকের আত্মার মধ্যে অনুভবের অনুরণন সৃষ্টি করা যাবে না! 

এ প্রসঙ্গে তাঁর লেখার আর একটি ছোট্ট অংশ(ইংরাজি অনুবাদ)— “Color is a power which directly influences the soul. Color is the keyboard, the eyes are the hammers, the soul is the piano with many strings. The artist is the hand which plays, touching one key or another, to cause vibrations in the soul.”৷
এইভাবেই ভাসিলি কান্দেনেস্কি ও তাঁর গ্রুপ— “দ্য ব্লু রাইডার”(ছবি-২) যৌথভাবে “দ্য ব্রিজ”-এর সাথে থেকে এক্সপ্রেশনিজম-এর আন্দোলনটিকে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করেছিল৷

আর একটি গ্রুপ-এর কথা আমরা প্রথমে উল্লেখ করেছিলাম৷ তার নাম—“নিউ অবজেক্টিভিটি”৷ ১৯২০ সালে গুস্তভ ফ্রেডরিখ হার্টলাব একটি চিত্রপ্রদর্শনীর নামকরণ করেছিলেন এই নামে৷ পরে এটি গ্রুপেরও নামকরণ হয়ে যায়৷ আগের যে দুটি গ্রুপ—“দ্য ব্রিজ” ও “দ্য ব্লু রাইডার” যেমন সম-মানসিকতায় যৌথভাবে এক্সপ্রেশনিজম-এর পক্ষে কাজ করত, এই গ্রুপটি কিন্তু তাদের সাথে সম-মানসিকতায় ছিল না৷ বরং বলা যেতে পারে বিপরীত মানসিকতায় অবস্থান করত৷ নাম শুনে পাঠক নিশ্চয়ই ধারণা করতে পারছেন, এঁরা সাবজেক্টিভ দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, সেই পুরোনো মনোভাব, অবজেক্টিভ দৃষ্টিকোণ থেকেই তাঁরা ছবি আঁকত(ছবি-৩)৷ 

আর, এই জন্যেই তাঁরা তাঁদের গ্রুপের নাম “নিউ অবজেক্টিভিটি” দিয়েছিলেন৷ ফলে, স্বাভাবিকভাবেই তাঁরা মনের গহীনে আত্মার অনুভব থেকে সৃষ্টি হওয়া যে অভিব্যক্তি, তাকে গুরুত্ব না দিয়ে পুরোনো পন্থা— বাহ্যিক রূপকে ক্যানভাসে ডিটেলে ফুটিয়ে তোলাকেই বেশি প্রাধান্য দিয়েছিল৷ কারণ তাঁরা মনে করেছিলেন— ছবিকে বিকৃত(Distorted) বা বিমূর্ত(Abstract)করে পরিবেশন করার চেয়ে ক্যানভাসে হুবহু বাহ্যিক রূপের সাহায্যে মানুষের দুঃখ-দুর্দশাকে তুলে ধরলে তা সাধারণ্যে অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য হয়৷ এতৎসত্ত্বেও কিছু ইতিহাসবিদ এক্সপ্রেশনিজম-এর সূত্রপাতের ক্ষেত্রে “দ্য ব্রিজ” ও “ব্লু রাইডার”-এর পাশাপাশি এই “নিউ অবজেক্টিভিটি” গ্রপেরও উল্লেখ করেন এই কারণে যে, এক্সপ্রেশনিস্টদের যে মূল উদ্দেশ্য ছিল— সাধারণ মানুষের দুঃখ-দুর্দশাকে ক্যানভাসে ফুটিয়ে তোলার মধ্যে দিয়ে প্রতিবাদ করা, সেই একই উদ্দেশ্য এঁদেরও ছিল৷ এবং এঁরা ছিলেন নীতিগতভাবে জার্মানির “উইয়েমার রিপাবলিক”-এর মতাবলম্বী৷ ফলে “ব্লু রাইডার”-এর মতো ১৯৩০ সালের পর পরই ফ্যাসিস্ত নাজি-বাহিনীর উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে ১৯৩৩ সালে এদের নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হয়৷  (ক্রমশ)
------------------------------------------------------------
প্রতি রবিবার  প্রকাশিত হচ্ছে এই ধারাবাহিক। 
আপনার অভিমত পেলে ভালো হয়। 
jaladarchi@yahoo.in          

Post a Comment

2 Comments

  1. তিনটি গ্রুপের সমন্বয়ে এক্সপ্রেশনিজম থেকে রঙ আর
    ভাব প্রকাশের পথ বেয়ে শেষে
    অ্যাবসট্রাকট আর্টে পৌঁছচ্ছে
    তা পড়তে পড়তে কি মমতায়
    এবং গভীর অধ্যাবসায়ের মধ্য
    দিয়ে লেখক-শিল্পী আমাদের নিয়ে
    চলেছেন তা বিস্ময়ের উদ্রেক করে।
    আমাদের চাহিদা ব্যাপ্ত হতে থাকে।
    চলুক। বিষ্ময় বাড়তেই থাকুক।

    ReplyDelete