জ্বলদর্চি

নীতি নৈতিকতার কবিতা ও ব্যাখ্যা/সন্দীপ কাঞ্জিলাল

 


সন্দীপ কাঞ্জিলাল

নীতি নৈতিকতার কবিতা ও ব্যাখ্যা 


আমাদের সর্ম্পক 
শক্তি চট্টোপাধ্যায় 

ঈশ্বর থাকেন জলে
       তাঁর জন্য বাগানে পুকুর 
                         আমাকে একদিন কাটতে হবে। 

আমি একা....
      ঈশ্বর থাকুন কাছে, এই চাই- জলেই থাকুন! 

জলের শান্তিটি তাঁর চাই, আমি, এমনই বুঝেছি 
কাছাকাছি থাকলে শুনি মানুষের সঙ্গে দীর্ঘদিন 
                                                  সম্পর্ক রাখা দায়
তিনি তো মানুষ নন!
           তাছাড়াও, দূরের বাগানে 
                  - থাকলে, শূন্য দুরত্ব ও
                   আমাদের সম্পর্ক বাঁচাবে।

এই কবিতাটি কিংবদন্তী কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের 'পরশুরামের কুঠার' কাব্যগ্রন্থের তিন নম্বর কবিতা। কবি ঈশ্বরের সঙ্গে এক সখ্য, আত্মীয়তা, ঈশ্বরের ভালোমন্দ, তাঁর শান্তি অশান্তি নিয়ে বেশ চিন্তিত। ঈশ্বরকে তিনি কাছাকাছি রাখতে চান তবে একদম কোলে নয়। ঈশ্বর থাকুন দূরে, কারণ আমরা তো জানি ভালোবাসা বেঁচে থাকে দূরত্বে, বিরহে। তাছাড়া ঈশ্বরকে একটু দূরে সরিয়ে রাখলে সমস্ত দায় তাঁর ওপর চাপিয়ে, তাকে দোষের ভাগীদার করাও যায় না। তাতে সম্পর্কও বাঁচবে। ঈশ্বর কাছাকাছি থাকলে রাম-রহিম মেতে উঠবে ধর্ম্মের খেলায়। তাদের মুখ চেনা যায় না। প্রত্যেকে থাকে মুখোশে। তাই কবি বলছেন, ঈশ্বর দূরে থাকুন। তাহলে আমাদের এই পৃথিবী এক হৈ চৈ রঙের মিলন মেলা হয়ে উঠবে। রাজনীতি আর ধর্ম দুটোই হিংসার। আবার তা যদি একসঙ্গে মিশে যায়, তবে তা ভয়ংকর। তখন মনে হয়, মানুষের রক্তপাতে থেকে যায় মানুষের পরোক্ষ সমর্থন। তাই কবির ভাবনা ঈশ্বর থাকুন ঈশ্বরের জায়গায়, মানুষ থাকুন তার নিজস্বতায়। কারণ "তিনি তো মানুষ নন।" তবেই পৃথিবী হয়ে উঠবে এক আনন্দ নিকেতন।


ঝুলতে ঝুলতে 

সুভাষ মুখোপাধ্যায়

এখন আমার হাড়ে দুব্বো গজাচ্ছে 
শিরদাঁড়ার ব্যামোয়।
ভিড়ের বাসে এক পায়ে ঝুলতে ঝুলতে 
শিরায় টান ধ'রে 
মুঠো যখন আলগা হয়ে আসে 

টেলিগ্রাফের তারে 
বৃষ্টির শেষে জলের ফোঁটার মত 
যখন আমি টলমল করি 

ঘাড় ফিরিয়ে পেছন তাকাতে 
আমার খুব কষ্ট হয়।

আমি আজও মনে করে রেখেছি 
বড়দের সেই বারণ
চলন্ত গাড়ি থেকে পেছনদিকে মুখ করে 
কক্ষনো নামতে নেই। 

আমার যে বন্ধুরা পৃথিবীকে বদলাবে বলেছিল
জ্বর সইতে না পেরে 
এখন তারা নিজেরাই নিজেদের বদলে ফেলছে।

আমি এক পায়ে এখনও পা-দানিতে ঝুলছি। 
মুঠো আলগা হয়ে এলেও, আমার কপাল ভালো, 
ঘাড় ফিরিয়ে 
কিছুতেই পেছনে তাকাতে পারছি না। 

কবিতাটি প্রখ্যাত কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের 'একটু পা চালিয়ে ভাই' কাব্যগ্রন্থের দশ নম্বর কবিতা- 'ঝুলতে ঝুলতে।'

এই কবিতায় বিষাদ, আর বিদায়ের করুণ সুর এক মমতাময় আবহ তৈরি করেছে স্বপ্ন দেখা এক লড়াকু কবির আশাহত যাত্রাশেষের দিনগুলি নিয়ে। তিনি একটি সুন্দর রূপকের মাধ্যমে বুঝিয়েছেন, পৃথিবী এক ভিড়ে ঠাসা চলন্ত গাড়ি। তিনি তাতে বসা দূর অস্ত দাঁড়ানোর জায়গা না পেয়ে হাতল ধরে চলেছেন গন্তব্যে। বলছেন, পেছনের দিকে তাকিয়ে লাভ নেই। আমাদের সামনে তাকাতে হবে। জীবন হচ্ছে চলমান। এগিয়ে যাওয়ার নাম জীবন। মনে পড়ে বেদের সেই কথা "চরৈবেতি চরৈবেতি।" বেদের ওই শাশ্বত বাণীকে তিনি সুন্দরভাবে কবিতায় উপস্থাপন করেছেন। 
এই কবিতার এক জায়গায় বললেন, যারা পৃথিবীকে বদলানোর শপথ নিয়ে এগিয়ে এসেছিলেন, শোষণ মুক্ত সমাজ গড়ার কথা বলেছিলেন- পৃথিবীকে বদলাতে অনেক সময় লাগবে,এত সময় তাদের হাতে নেই, তাই তারা নিজেদের বদলে নিয়েছেন। তাইতো আমরা দেখতে পাই, নেতা মন্ত্রীদের  প্রত্যেক বছর সম্পদ গুণিতক হারে বাড়ছে। আর আমরা সাধারণ মানুষ কোনক্রমে বেঁচে দিন গুজরান করছি। কবি এদের কথা মনে রেখে সামনে এগিয়ে যেতে বলেছেন। আর বলেছেন নিজেকে বদলানোর সর্বশ্রেষ্ঠ উপায়-উপনিষদের সেই শ্লোক- "তেন ত্যাক্তেন ভুজ্ঞিথা।" সব দিয়ে সব পাওয়ার মাধ্যমে নিজেকে বদলাতে হবে।


আজ : মে ২০০২ 

জয় গোস্বামী

আমার সমস্ত বাক্য আগুনে নিক্ষেপ করা শিশু 
আমার সমস্ত ধ্বনি জয়ধ্বনি, মারণাস্ত্রগুণ 
আমার সমস্ত ছন্দ হত্যায় ওঠানো তলোয়ার 
আমার সমস্ত কাব্য তলোয়ার শীর্ষে গাঁথা ভ্রূণ 
আমার সমস্ত প্রেম কিছু নয়, কিছু নয় আর 
ছেলের চোখের সামনে তার জননীর বলাৎকার 

এখনও, এখনও যদি ঘরে বসে নিজেকে বাঁচাই 
যদি বাধা নাই দিই, তত্ত্ব করি, কী হল কার দোষে
যদি না আটকাই, আজও না-যদি ঝাঁপিয়ে পড়তে পারি
আমার সমস্ত শিল্প আজ থেকে গণহত্যাকারী! 

এই কবিতাটি বর্তমান সময়ের প্রখ্যাত কবি, জয় গোস্বামীর "সন্তান সন্ততি" কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত। 
কবি এখানে মানবতার জয়গান গেয়েছেন। এই কবিতার মধ্যে তিনি বলতে চেয়েছেন, আমার কবিতা লেখা মানুষের জন্য। কিন্তু চারিদিকে আজ মানবিকতা নীতি নৈতিকতা ধ্বংস হচ্ছে। তা দেখে যদি আমি গর্জে না উঠি, প্রতিবাদ না করি, তবে "আমার সমস্ত বাক্য আগুনে নিক্ষেপ করা শিশু"। তার অর্থ হলো, একটি নিষ্পাপ শিশু সহজ সরল সাদা কাগজের মতো, তাকে আগুনে পুড়িয়ে মারলে যে দোষ হয়, আমি যদি এখনও ঘরে বসে বসে কার দোষ, কী দোষ আর ন্যায় নীতির তত্ত্ব আওড়াই তবে আমি সেই দোষে দুষ্ট হবো। কারণ এই সমাজে যারা আমাকে খাদ্য বস্ত্র পানীয় দিয়ে, বেঁচে থাকতে সাহায্য করছে, তাদের একটু ভালোভাবে বেঁচে থাকার জন্য যদি পথে না নামি তাহলে আমার সমস্ত শিল্প আজ থেকে গণহত্যার দায়ে অভিযুক্ত হবে। এই সমাজ সমগ্র জনতাকে জানিয়ে দিয়েছে আমি কবি, শিল্পী, স্রষ্টা। আমিই পারি নতুন সমাজ তৈরি করতে। সকলের মঙ্গলের জন্য চিন্তা করার অধিকার ক্ষমতা আমার মধ্যে আছে। যেহেতু প্রত্যেকটি শোষিত নিপিড়ীত মানুষ, আমার কাছে জমা রেখেছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য তাদের অধিকার আমানত হিসেবে। সেই হিসেবে একজন কবি লেখক স্রষ্টা শিল্পীর দায় সাধারণ মানুষের অত্যাচারের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠা।তাইতো ১৯৭৮ সালে ঘূর্ণিঝড়ে বিধ্বস্ত বাংলাদেশের জন্য, সুরের যাদুকর 'ভূপেন হাজারিকা' কাঁধে তুলে নিলেন হারমোনিয়াম "মানুষ মানুষের জন্য,/জীবন জীবনের জন্য। / একটু সহানুভূতি কি পেতে পারে না।/ও বন্ধু------।"


অগ্নিপথ 

হরিবংশ রাই বচ্চন

(এই মূল কবিতাটি হিন্দিতে। অনুবাদ করেছেন- সন্দীপ কাঞ্জিলাল।) 

যতই বৃক্ষ ভালো খাড়া হোক,
যতই ঘন যতই বড় হোক, 
একটি পাতা কিংবা তার ছায়া, 
চাসনে চাসনে চাসনে,
অগ্নিপথ অগ্নিপথ অগ্নিপথ। 

তুই কখনও ক্লান্ত হবি না,
তুই কখনও দাঁড়াবি না, 
তুই কখনো পেছনে দেখবি না, 
শপথ কর, শপথ কর, শপথ কর,
অগ্নিপথ অগ্নিপথ অগ্নিপথ। 

এ এক দুর্লভ দৃশ্য 
মানুষের চলছে অশ্রু ঘাম রক্তে ভেজা, 
লটপট লটপট লটপট,  
অগ্নিপথ অগ্নিপথ অগ্নিপথ।

এই কবিতাটি পদ্মশ্রী এবং আকাদেমি প্রাপ্ত বিখ্যাত হিন্দি কবি হরিবংশ রাই বচ্চনের।
জীবনে যখন মানুষ বিপদে পড়ে, তখন তার আসল পরীক্ষা! তখনই তাকে প্রমাণ দিতে হয়, সে কতটা আসল আর কতটা নকল। সে সময় অনেক মানুষ, কেউ পরীক্ষা করার জন্য বা কেউ তোমাকে চিরকালের অনুগত বানানোর জন্য, কেউ বা ছদ্মবেশী ঘাতক, তোমার দিকে হাত বাড়াতে পারে। অথবা কেউ সত্যিকারের সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসতে পারে। সে সাহায্য ও নেওয়া যাবে না। কারণ তুমি পরনির্ভরশীল হয়ে পড়বে৷ তখনই সময় শপথ নেওয়ার,  কখনো কাজ না শেষ হওয়া পর্যন্ত, উদ্দেশ্য না সফল হওয়া পর্যন্ত আমি দুর্বল হবো না, বিশ্রাম নেবো না, পেছনে কি ছেড়ে এলাম, বা কি হারালাম তা-ও দেখবো না। 
এ যেন মনে করায় রবীন্দ্রনাথের সেই গান "বিপদে মোরে রক্ষা কর এ নহে মোর প্রার্থনা / বিপদে আমি না যেন করি ভয়।" বা লক্ষ্যভেদের সময় অর্জুনের সেই কথা "আমি মাছের চোখ ছাড়া আর কিছুই দেখছি না। সেইরূপ আমিও লক্ষ্যে পৌঁছানো ছাড়া আর আমার কিছু কাজ নেই। 

এভাবে চলতে গেলে তুমি চোখের জলে নাস্তানাবুদ হবে, ঘামে শরীর ভিজবে, পা ফেটে রক্ত বেরুবে, তবুও তোমাকে এগিয়ে যেতে হবে, কারণ জীবনের এপথ অগ্নিপথ। সেই যে ঈশা উপনিষদের প্রথম লাইন- "ঈশা বাস্যমিদং সর্বং যৎ কিঞ্চিৎ জাগতাং জগৎ।" অর্থাৎ 'গতিশীল সৃষ্টির যা  কিছু চলমান সবকিছু ঈশ্বরের বাসের উপযুক্ত।"

ঈশ্বর মানে এখানে আমি মনে করি মঙ্গল, ভালো। যারা গতিশীল এগিয়ে যেতে জানে, তাদের সঙ্গেই থাকে "সত্যম শিবম্ সুন্দরম।"

Post a Comment

0 Comments