জ্বলদর্চি

শ্রীলঙ্কার লোকগল্প (Folk-tale of srilanka)/ চিন্ময় দাশ

অলংকরণ - রবীন্দ্রনাথ কপাট   


Folk-tale of srilanka
দূরদেশের লোকগল্প (শ্রীলঙ্কা)


চি ন্ম য়  দা শ

মােহরের থলি 

এক গ্রামে বাস করত এক বুড়াে মানুষ। সংসারে নিজের বলতে ছিল তার দুই ছেলে। আর যা ছিল, তা হােল তার বিষয়-আশয়। সেও আবার কম-সম নয়। অঢেল টাকা। সােনা দানা। জমি-জিরেত। ঘর-বাড়ি। লােক-লস্কর। সত্যি বলতে কি, একেবারে রাজার মত বিষয়-আসয় বুড়াের। আর টাকা থাকলে যা হয়, বেশ সুখেই দিন কেটে যায় তার। ছেলে দুটো তাে নয়, একেবারে হীরের টুকরাে। একেবারে বাপ অন্ত প্রাণ দুজনের।

একদিন বুড়াের মনে হল, বয়স তাে হােল। এবার কবে বলতে কবে মরে যাব, তার নাই ঠিক। যদি দুম করে মরে যাই, ছেলে দুটো কী করবে? কত টাকা-পয়সা আছে, তাদের তাে জানা নাই সেসব। জমি-জিরেত কত আছে, কোথায় আছে, সেসব তারা জানেই না। ভারি মুশকিলে পড়ে যাবে দু'জনে। তার চেয়ে আগেভাগে সব বন্দোবস্ত করে যাওয়াই ভালাে।

দুই ছেলেকে ডেকে সব কথা বুঝিয়ে বলল বুড়াে। শেষে বলল- “আমার সময় হয়ে এল। তোমাদের সম্পত্তি তােমরা বুঝে নাও এবার। কাগজপত্রে সব লেখাপড়া করে দিয়েছি। কোনও অসুবিধেই হবে না। যে যার মত সুখে শান্তিতে বাস কোর। ভাইয়ে ভাইয়ে বিবাদ কোর না কোনদিন। আর বুড়াে বাপটাকে দু'বেলা দুমুঠো ভাত দিও কেবল।" 
বাপের সব সম্পত্তি এখন থেকে তাদের নিজেদের হয়ে গেল? ভাবতেই পারছে না দুজনে। আনন্দে বুক ফেটে যাবার জোগাড় হল তাদের। কিন্তু দুজনের মুখে যেন কথা নাই। কোনও রকমে বলল-- "অত তাড়াহুড়াের কী আছে, বাবা? ব্যস্ত হয়ে পড়েছ কেন?" 
সেকথার জবাব না দিয়ে বুড়াে বলল-- “কালকে আমার সাথে বেরুবে। জমি-জায়গাগুলাে নিজেদের চোখে দেখে বুঝে নিও।" 
এইভাবে বিষয়-আসয় সব ছেলেদের হাতে তুলে দিল বুড়াে। সামান্য কিছুও রাখল না নিজের জন্য। মনেও বেশ আনন্দ। টাকা-পয়সা, জমি-জমার ভার নেমে গেছে ঘাড় থেকে, সেজন্য আনন্দ। নিজের হাতে ছেলেদের সব তুলে দিয়ে যেতে পারছে, আনন্দ সেজন্যও। 
কিন্তু ক'দিন না যেতেই সব আনন্দ উধাও হয়ে গেল মানুষটার। দেখতে পেল, দিনকাল যেন আর আগের মত নাই। কোথায় যেন সুর কেটে গেছে। আট-দশটা কাজের লােক এ বাড়িতে। ডাকাডাকি করেও টিকি দেখা যায় না কারও। যাবেই বা কী করে? কদিন না যেতেই, নিজের নিজের আলাদা সংসার করে নিয়েছে ছেলে দুটো। কাজের লােকও ভাগ হয়ে গেছে তাদের মধ্যে। বাপের জন্য কেউ নেই। তারা আসবে কেন?
রান্না এখন আলাদা করে হয় দু'ঘরে। বুড়াের রান্না কে করবে? বাপকে খাবার দেবার কথা কোনদিন ছেলেদের মনে থাকে, তাে কোনও দিন মনেই থাকে না। দুর্দশার এক শেষ। অসুখ-বিসুখ হলে তাে আর কথাই নাই। পড়ে পড়ে ধুঁকতে হয়। এক ঢােক জল এগিয়ে দেবে, তেমনটিও নাই কেউ।
আসলে হয়েছে কি, বুড়াে ভেবেছিল-- 'বয়স হয়েছে, বেশিদিন আর বাঁচবে না সে। অত টাক-পয়সা বিষ-সম্পত্তি দিয়ে যাচ্ছে ছেলেদের। শেষের ক'টা দিন তারাই সেবা-যত্ন করবে বাপের। হেসে খেলে কেটে যবে শেষের দিনগুলাে।'
কিন্তু মানুষ যা ভাবে, সব সময় তাে আর তা হয় না। বরং বুড়াের বেলায় হয়েছে একেবারে তার উলটো। এখন বুড়াে বেশ বুঝতে পেরেছে, তার পয়সাকড়ির জন্যই বাপকে সেবাযত্ন করত ছেলেরা। এখন না চাইতেই সবকিছুর মালিক হয়ে গেছে নিজেরা। বুড়াে বাপ এখন তাদের বােঝা। অকারণ ঝামেলা বই কিছু নয়।
কষ্ট যখন আর সইতে পারা গেল না, অগত্যা গাঁয়ের মােড়লকে ধরে পড়ল বুড়াে। -- “কিছু একটা বিহিত করাে তুমি, মােড়ল। আমি আর সইতে পারছিনা।"
মোড়ল খুব বকাবকি করল তাকে, বলল-- "একেবারে বেকুবের কাজ করেছ তুমি। ফল তো ভুগতেই হবে।"
মোড়লের দুটো হাত চেপে ধরল বুড়ো-- " দোহাই, কিছু একটা করো, ভাই।"
"হাত ছাড়ো। দেখি, কী করা যায়।" মোড়লের কথায় বাড়ি ফিরে এল বুড়ো।
পরদিন মোড়ল এল বুড়োর বাড়িতে। হাতে একটা মুখবন্ধ ভারী থলে। বুড়ো খাতির করে বসল মোড়লকে।
এদিকে হয়েছে কী, মোড়লকে বাড়িতে আস্তে দেখে, ছেলে দুটোর মুখে চিন্তার ছাপ। কী ব্যাপার। এ লোকটা কেন বাড়িতে? বাবা কোনও বিচার-টিচার দিয়ে বসেনি তো? তারা আড়ালে কান পেতে রইল।
মোড়লও অতি চালাক লোক। আড়চোখে দেখে নিয়েছে ছেলে দুটোকে। তাদের শুনিয়ে শুনিয়ে বলতে লাগল-- "এই নাও তোমার মোহর। একটিও এদিক-ওদিক হয়নি। গুণে-গেঁথে তুলে রাখো সব।" 
বুড়ো কিছু একটা আন্দাজ করল। মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল-- "তুমি বাড়ি বয়ে ফেরত দিতে এসেছ। এই আমার কত সৌভাগ্য। এ আবার গুণব কী? তোমাকে অবিশ্বাস করব?" হাসি যেন ধরে না বুড়োর মুখে।
ফিরে যাবার সময় মোড়ল বলল-- " যা গুণধর ছেলে দুটি তোমার ! জানতে আর বাকি নাই কারও। এতসব পেয়েও, দু'বেলা দু'মুঠো খেতে দে না বাবাকে। বে-আক্কেলের দল। ভেবেছে, কত কিছুই না পেয়ে গেছি। জানেই না, যা ওদের দিয়েছ, তার তিন গুণ আছে এই থলেতে। খবরদার, একটা মোহরও দিও না কিন্তু ওদের।"
সবই কানে যাচ্ছে ছেলে দুটোর। চোখ চকচক করে উঠছে তাদের। মোড়ল বলল-- কাল সকালে আসব আমি। ততক্ষণ একটু সামলে-সুমলে রেখো মোহরগুলো।"
পরের দিন একটা বাক্স নিয়ে হাজির হল মােড়ল। থলিটাকে বাক্সে রেখে চাবি সেঁটে দিল। বলল-- "মােহর ভরা বাক্স রইল তােমার কাছে। তবে, চাবিটা রইল আমার পকেটে। নইলে খরচা করে ফেলবে তুমি। দেখো, বেঁচে থাকতে একটা মােহরও যেন খরচা না হয়।"
অমনি সেদিন থেকেই শুরু হয়ে গেল ছেলেদের যত্ন-আত্তি। দুই ভাই যেন প্রতিযােগিতায় লেগে গেল। কে কত যত্ন করতে পারে বাবার। এই ভালাে ভালাে খাবারের থালা সাজিয়ে দিচ্ছে। তো, এই জামাকাপড় কিনে আনছে। দু'জনেই বাড়ি থেকে দুটো লােক পাঠিয়ে দিল বুড়াের ফাইফরমায়েস খাটবার জন্য। দিনে চার বার করে দু’জনে খোঁজ নিয়ে যায় বাবার। সে এক এলাহি ব্যাপার। এত বাড়াবাড়ি, সে যেন সহ্য হয় না। তবুও মুখ ফুটে কিছু বলে না বুড়াে। খিদের কষ্ট সইতে হচ্ছে না, এটাই বড় বাঁচোয়া। এইভাবে দিন যেতে লাগল। সেবাযত্নে থেকে বুড়াের শরীরও বেশ চাঙ্গা এখন। রােগ-বালাই বলে কিছু নাই তার। বেশ কয়েক বছর কেটে গেল এভাবে। বুড়াে যতদিন বেঁচে রইল, ছেলেদের খাতিরদারি একই রকম চলতে লাগল।
বলা নেই, কওয়া নাই, একদিন হঠাৎ টুক করে মরে গেল বুড়ােটা। তাতে মনে কষ্ট পাবে কী, আনন্দ ধরে না দুই ছেলের। তাড়াতাড়ি ছেলে দুটো গিয়ে হাজির হল মােড়লের কাছে। বলল-- "বাবা মারা গেছে। এবার তুমি বাক্সের চাবি নিয়ে চলাে আমাদের ঘরে।”
মােড়ল বলল-- "সব খবরই রাখি। অনেক করেছ তােমরা বুড়াে বাপের জন্য। সবই মোহরের লোভে। যাক সেসব। তা, আমি গিয়ে আর কী করব? এই নাও চাবি। তােমাদের জিনিষ তােমাদের ঘরেই আছে। বাক্স খুলে নিজেরা বুঝে নাও।"
চাবি হাতে পেয়ে ছেলে দুটোর যেন আর তর সয় না। যা পেয়েছে বাবার কাছ থেকে, তাই খেয়ে শেষ করতে পারে না। তারও তিন গুণ সম্পত্তি পড়ে আছে বাক্সের ভিতর! পড়ি কি মরি করে ঘরে ফিরে এল তারা।
বাক্স খােলা হােল। ভিতরের ভারি থলেটা বের করে, ঢেলে ফেলা হল মেঝেতে। 
কত মােহর ছিল থলের ভেতর ? কোথায় কী মোহর! গড়গড় করে যা বেরিয়ে এল থলে থেকে, সে শুধু কতকগুলাে নুড়িপাথর! আর কিছু নয়।
-------------------------------------------
প্রতি মঙ্গলবার প্রকাশিত হচ্ছে দূরদেশের লোকগল্প। 
অভিমত জানাতে পারেন।   
jaladarchi@yahoo.in    

Post a Comment

0 Comments