জ্বলদর্চি

অ্যাঁতেলেকত্যুয়েল বনাম আঁতেল -২০/ সন্দীপ কাঞ্জিলাল

অলংকরণ- প্রান্তিকা মাইতি

 
অ্যাঁতেলেকত্যুয়েল বনাম আঁতেল

পর্ব-২০

"কেউ যদি ইচ্ছে করে থাম জড়িয়ে ধরে বলে থাম আমায় ছাড়ছে না,তেমনি কেউ যদি বলে হাজার চেষ্টায় মদ খাওয়া ছাড়তে পারছি না। তাহলে বুঝতে হবে দুজনের বিপথগামী বুদ্ধি।"

স ন্দী প  কা ঞ্জি লা ল

       
বেপথু বুদ্ধি -২

যাদের বুদ্ধি বিপথগামী, তারা সুখ অথবা দুঃখে উদবেগ প্রকাশ করে। উদবেগ প্রকাশ করা মানে উতলা হওয়া। 'উৎ' মানে 'উপর', 'বেগ' মানে 'গতি'। পাহাড়ে উঠতে গেলে মানুষ বিপদ গোনে, হয়রান হয়, সেই অবস্থা যেন না হয়। দুঃখ ধৈর্য ধরে সইতে হবে। তার কাছে হার মানতে নেই। দুঃখের মতো সুখ ও সাবধানে হজম করতে হয়। মানুষ দুঃখ যেচে নেয় না। ধৈর্য ধরে সয়ে নিলেই হল। কিন্তু সুখের জন্য মানুষ লালায়িত। তা মনকে ভোলাতে পারে। তাই সুখে ভয় আছে। সুখ সম্বন্ধে ভুল ধারণা হেতু সুখের আকাঙ্ক্ষা জন্মে। অতএব সুখ এলে মনকে সাবধানে গোটাতে হবে, রক্ষা করতে হবে। দুঃখ এসেছে কি ধৈর্য ধরতে হবে।  সুখ এলে তার ফাঁদে যেন মন ধরা না দেয়। তাকে গুটিয়ে নিতে হবে। ঢালুর দিকে যাওয়ার সময় মানুষকে দৌড়াতে দেখা যায়। তদ্রূপ সুখের সময়ে মনের বৃত্তি দৌড়াতে থাকে। তাই তাকে সংবরণ করা দরকার। এ কাজ তত কঠিন নয়। কামনার দুই রূপ- সুখ চাওয়া আর দুঃখ না চাওয়া। এই দুইকে সংযত রাখার কথা বলছি।

কামনা যেমন দ্বিবিধ, এর পরিণাম তদ্রূপ তিন প্রকার-- (১) তৃষ্ণা (২) ক্রোধ ও (৩) ভয়। অনুকূল বেদনা থেকে তৃষ্ণা জন্মে। প্রতিকূল বেদনা থেকে ক্রোধ। ভয় ক্রোধেরই, প্রতিকূল বেদনারই রূপ। কিন্তু বেঁচে থাকার এক বিশেষ আসক্তি আমাদের আছে বলে ভয়বৃত্তি ক্রোধ থেকে ভিন্ন মনে করা হয়। আমাদের সহজভাবে বেঁচে থাকার উপর আঘাত লাগলেই ভীতি উৎপন্ন হয়। প্রাণীমাত্রেই এ আচরণ রক্তকণায় আছে। জীবন নাশের প্রসঙ্গ উপস্থিত হওয়ামাত্র তা জাগ্রত হয়ে উঠে। অত্যাচারী লোকেরা এই ভয়বৃত্তির ষোলো আনা সুযোগ নেয়। ভয় দেখিয়ে লোককে তারা গোলাম বানায়। বস্তুত টোটা-বন্দুক ইত্যাদি অস্ত্রশস্ত্র অপেক্ষা এই ভয়বৃত্তি তাদের ক্ষমতার প্রকৃত আধার। অতএব তৃষ্ণা ও ক্রোধ এই দুই বৃত্তি দূর করার জন্য যেমন স্বতন্ত্র সাধনা করতে হয়, ভয়বৃত্তি জয় করার জন্যও তেমনি স্বতন্ত্র সাধনা করা আবশ্যক। তৃষ্ণা, ক্রোধ ও ভয় এই তিন বৃত্তি নাশ হলে প্রজ্ঞা স্থির হয়। এইসব বৃত্তি বুদ্ধির উপর আঘাত হানে। তাই তাদের দূর করে দেওয়ার কৌশল খুঁজতে হবে।  

মনকে কোথাও লিপ্ত হতে দিতে নেই। মনকে কোথাও আটকা পড়তে, মজতে কিংবা ঘর বাঁধতে দিতে নেই।  মানুষের মন কোথাও না কোথাও বাঁধা পড়ে। কেউ মজে বইয়ে তো কেউ মজে চাষবাসে। অশুভ আসে তো তাকে দুঃখদায়ক হতে দিতে নেই, শুভ আসে তো তাকে সুখদায়ক হতে দিতে নেই। তার মানে শুভ হলে সুখ বোধ করা উচিত নয়, এরূপ বলছি না। সুখী হবে হও। আপত্তি নেই। কিন্তু তাতে পাগলপারা হওয়া চলবে না। হর্ষিত হওয়া চলবে না। আনন্দে আটখানা হওয়া উচিত নয়। তালি বাজিয়ে অভিনন্দন করো না। ছেলে হয়েছে তো ভালো লাগছে, বেশ লাগতে দাও। কিন্তু সন্দেশ বিতরণ করো না। বিয়ে হয়েছে, ভালো লাগছে! লাগুক। কিন্তু ব্যান্ড বাজিও না। এইটুকু এখানে বলা। তদ্রূপ, অশুভ ঘটেছে, খারাপ লাগছে? লাগুক না খারাপ। কিন্তু মনে সন্তাপ যেন না হয়। বুদ্ধিতে বিকারের আঁচ লাগে এমনটা তীব্র হতে দিও না। তীব্র বিকার, বুদ্ধির উপর আঘাত হানে। বুদ্ধি অক্ষুণ্ণ থাকা চাই। চাণক্যের কথায় আছে-- আমার সব যাক, কিন্তু বুদ্ধি অক্ষুণ্ণ রাখো। কর্মযোগী মানুষ প্রত্যক্ষ ব্যবহারে কিভাবে চলবে এ হচ্ছে তাঁর বিবরণ। বৃত্তিতে অল্পমাত্র গাম্ভীর্য থাকলে মানুষের পক্ষে এভাবে চলা সহজ। কিন্তু বৃত্তি যদি বাঁদরের মত হয় তো সংযম অসাধ্য। বাঁদর আনন্দে কিল কিল করে আর দুঃখে করে কিচ কিচ। বৃত্তি যেন তদ্রূপ না হয়। 
জ্ঞান-বুদ্ধির মতো অর্থ এবং ক্ষমতাও একে অপরের পরিপূরক। অর্থ ও ক্ষমতার মধ্যে সাধারণত অর্থ উপার্জনের জন্য যে পরিমাণ শ্রম ও জ্ঞান-বুদ্ধি দরকার পড়ে সে তুলনায় ক্ষমতা লাভের জন্য এত কিছু লাগে না। মানুষের রাষ্ট্রক্ষমতা লাভ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বংশগত কারণ, দলীয় বা গোত্রীয় কারণে হয়ে থাকে৷ কেউ কেউ আবার কোনো দৈবাৎ দূর্ঘটনা, ঘটনা অথবা পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে হঠাৎ করে ক্ষমতা লাভ করে ফেলেন। ফলে বেশির ভাগ মানুষের ক্ষমতা লাভের সাথে বিদ্যা বুদ্ধি এবং অর্থজাত প্রভাব থাকে না। তবে ক্ষমতা পরিচালনার জন্য বিদ্যা-বুদ্ধি-অর্থ অতীব জরুরি, অত্যাবশ্যক উপকরণ এবং সেগুলো যদি ক্ষমতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হয়, তবেই ক্ষমতার মারাত্মক বদহজম হতে শুরু হয়ে যায়। উত্তরাধিকার নীতির কারণে পাগল শিশু অথবা বিকলাঙ্গ যেমন অনায়াসে ক্ষমতার সিংহাসনে বসতে পারে, তেমনি সেই উত্তরাধিকার নীতিকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে অযোগ্য ক্ষমতাধরদের ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য সর্বগুণে গুণান্বিত মহামানুষের নেতৃত্বের দরকার পড়ে। ক্ষমতাচক্রের একটি নীতিকথা হলো কোনো অযোগ্য নেতা কখনো অনুরূপ অযোগ্যকে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারে না। তবে আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে ইতিহাসে এমন ঘটনা বহুবার ঘটেছে যখন একজন অযোগ্য অথবা নিকৃষ্টতম নেতা দিয়ে যোগ্য এবং উৎকৃষ্টতম নেতার পতন হয়েছে। 

বর্তমান সমাজব্যবস্থায় অর্থকড়ি এবং টাকা পয়সাকে সবকিছুর নিয়ামক বলে প্রচার করা হচ্ছে। যারা অর্থকে ভগবান অথবা টাকা-পয়সাকে সব সুখ শান্তি, মান-মর্যাদা পাওয়া বা বেঁচে থাকার একক বলে প্রচার করেন, তারা সবাই অর্থজাত বদগুণের শিকার। অর্থের স্বাভাবিক নিয়ম হলো- এটি মানুষের হাতে এলে মানুষ হালকা অনুভব করে। অর্থের কারণে মানুষের মনে ক্ষণস্থায়ী আনন্দ সৃষ্টি হয়, যা কালক্রমে দাম্ভিকতায় রূপ নেয়। অর্থ যদি বিনা পরিশ্রমে অথবা অনায়াসে এবং স্বল্পপরিশ্রমে অর্জিত হয় তবে মানুষ বিলাসী, রাগচণ্ডাল ও জেদি হয়ে পড়ে। বিত্ত-বিলাসের কবলে পড়ে এই শ্রেণির মানুষের বুদ্ধিনাশ ঘটে এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে চরিত্রহানি হয়ে থাকে। এই শ্রেণির বিত্তবানেরা এক ধরনের অনিশ্চিয়তা ও অনিরাপত্তাজনিত মনোরোগের শিকার হয়ে রাজনৈতিক বা রাষ্ট্রক্ষমতা পদলেহন করার জন্য উঠে পড়ে লাগে৷ 

বিত্ত যদি অসৎ পথে ব্যক্তির হস্তগত হয় তবে সংশ্লিষ্ট বিত্তবানের মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা হয়ে পড়ে। এর অর্থ, সারাক্ষণ জাহান্নামের আগুন জ্বলতে থাকে এবং তার আচার-আচরণের নোংরা পশু-পাখির কদর্যতা ফুটে ওঠে। অসৎ বিত্তের মালিকেরা যেকোনো জীবাণুযুক্ত কীটপতঙ্গ ও রোগবাহী ভাইরাসের চেয়েও মারাত্মক। এরা এক ধরনের ছোঁয়াচে রোগের মতো নিজেদের কুকর্ম কু-অভিলাষ এবং কু-অভ্যাসগুলো অত্যন্ত নির্লজ্জ ও বেহায়াপনার মাধ্যমে সমাজ-রাষ্ট্র-প্রতিবেশ ও পরিবেশে বিস্তার ঘটায়। অন্য দিকে, এরা আপন পরিবার ও ক্ষমতার বলয়ে নিজেদের মন্দ চরিত্রের রীতিমতো প্রজনন ঘটাতে থাকে। প্রতিটি অসৎ অর্থের মালিকই  ভয়ঙ্কর মানসিক রোগী এবং এক ধরনের আত্মঘাতী অপরাধী হিসেবে সমাজ-সংসারে ক্রমাগত অশান্তি সৃষ্টি করে থাকে। এদের বিবেকবোধ রহিত হয়ে যায় এবং দিনকে দিন নিষ্ঠুরতার পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে এক সময় রাক্ষস রূপ ধারণ করে। তারা অর্থ ছাড়া অন্য কোনো কিছু কল্পনা করতে পারে না এবং অর্থের জন্য নিজের স্ত্রী-মা ও কন্যাদের যেমন ধর্ষকদের হাতে নির্দ্ধিধায় তুলে দিতে পারে, তেমনি পুত্র-সন্তান-পিতা ও ভাইদের জীবন তার মতো নরপিশাচদের কাছে বন্ধক রাখতে পারে। 
রাষ্ট্রে যদি সুশাসন ও ন্যায়বিচারের অভাব ঘটে তবে জাতীয় অর্থনীতি বেসামাল হয়ে পড়ে। রাষ্ট্রশক্তি যখন চোরদের অধীনে চলে যায়, তখন পরিশ্রমী শ্রমিকের ঘাম, মেধাবী ও সৎ ব্যবসায়ীর পরিকল্পনা ও প্রচেষ্টা ভেস্তে যায়। পুরো অর্থব্যবস্থা এলোমেলো হয়ে পড়ে। ফলে সুযোগসন্ধানী, অর্থনীতির চোর-ডাকাত-বদমাশ-লুটেরা ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ,শিল্পকারখানা ইত্যাদি সব কিছু করায়ত্ত করে নেয়। একটি দুর্ভিক্ষ, একটি গৃহযুদ্ধ, বিপুল সংখ্যক লোকের প্রাণহানি এবং বাস্তুচ্যুতি ছাড়া এ রকম পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পাওয়া যায় না। 

জ্ঞান-বুদ্ধির বিপথগামী লোকেরা প্রথমত লোভী প্রকৃতির হয়। তারা সর্বংসহা মিনমিনে স্বভাবের হয়ে থাকে এবং পেশা হিসেবে চাটুকারিতা ও দালালিকে ভারি পছন্দ করে। এই শ্রেণির লোকেরা ব্যভিচারে পটু হয়ে থাকে এবং অসৎ উপায়ে  সমাজ সংসারে অশান্তি সৃষ্টি করতে বিশেষ দক্ষতা অর্জন করে। তারা সাধারণত পরগাছার মতো নিজের উপকারী বন্ধুবান্ধব, পিতা-মাতা, আত্মীয়স্বজন থেকে শুরু করে আপন স্ত্রী-পুত্র-কন্যাদের সর্বনাশ করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। এ ধরনের লোকেরা নিজেদের স্বার্থের জন্য সব কিছু করতে পারে। যেহেতু এরা জ্ঞান-বুদ্ধি নামের দুর্লভ গুণাবলিসম্পন্ন, সেহেতু তারা খুব সহজে পরিবেশ পরিস্থিতি আন্দাজ করতে পারে এবং আপন স্বার্থমতো ক্ষমতার কাছে নিজেদের উপাদেয় অপরিহার্য বলে তুলে ধরতে পারে।

বুদ্ধির বদহজম হলে সামাজিক, পারিবারিক শান্তি ও সংহতি নষ্ট হয়। এই রোগাক্রান্ত বুদ্ধিমানেরা সবসময় প্রগতির বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় এবং মনগড়া কাহিনি, আজব কুসংস্কার দিয়ে সমাজকে কলুষিত করে। অর্থলিপ্সা বা ক্ষমতালিপ্সার চেয়ে সমাজে অশান্তি সৃষ্টি করাকেই তারা বেশি প্রাধান্য দেয়। তাদের মধ্যে একাংশ রয়েছে, যারা সবসময় অন্যের ত্রুটি খুঁজে বেড়ায় এবং নিজের গুরুত্ব বোঝানোর জন্য নাস্তিকতাকে ফ্যাশন হিসেবে গ্রহণ করে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ অদ্ভুত পোশাক পরে এবং ব্যতিক্রমী কথাবার্তা বলে নিজেদের পাণ্ডিত্য প্রকাশের চেষ্টা এবং লোকজনের দৃষ্টি আকর্ষণের পাঁয়তারা করে। তারা সাধারণত কম হাসিঠাট্টা করে এবং চলনে-বলনে কৃত্রিম গাম্ভীর্যতা ফুটিয়ে তোলে নিজেদের গুরুত্ব বোঝানোর চেষ্টা করে। বিপথগমী বুদ্ধিতে যারা আক্রান্ত,তাদের একাংশ অবশ্য ভণ্ডামিকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করে। তারা সাধু-সন্ন্যাসীর বেশ ধরে এবং বিপুল সংখ্যক ধর্মপ্রাণ ও কোমল হৃদয়ের মানুষকে টার্গেট করে নিজেদের আর্থিক ও পাশবিক লালসা চরিতার্থ করে। ভারতের সাম্প্রতিককালের রাম-রহিম নামের ভণ্ড গুরু এই শ্রেণির লোকদের উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। 

পাণ্ডিত্যের বিপথগামী হলে তার প্রতিক্রিয়া অর্থ ও বুদ্ধির বিপথগামীর চেয়েও ভয়ঙ্কর হয়ে থাকে। কারণ দুঃশ্চরিত্র পণ্ডিত সবসময় রাষ্ট্রক্ষমতার কেন্দ্রীয় ব্যক্তিবর্গ, আর্থিক জগতের সফলতম মানুষ অথবা সামাজিকভাবে অত্যন্ত প্রভাবশালী ও জনপ্রিয় সাধারণ বুদ্ধির লোকজনকে টার্গেট করে কুকর্ম শুরু করে। বুদ্ধি বা অর্থবিত্তের বিপথগামীতা দিয়ে সৃষ্ট সমস্যাগুলোর প্রতিক্রিয়া দীর্ঘস্থায়ী হয় না। কিন্তু বদ পণ্ডিতের সৃষ্ট সমস্যার কারণে কোনো কোনো জাতিকে শত শত বছর দুর্ভোগ পোহাতে হয়। এই শ্রেণির লোকেরা নিজেদের জ্ঞান-বুদ্ধি-ধ্যান-ধারণা, চিন্তা-চেতনা এবং পছন্দ-অপছন্দ দিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতার প্রধানতম ব্যক্তিকে মাদকাসক্তের মতো মোহগ্রস্ত বানিয়ে ফেলে। ফলে রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিরা ওই ধরনের দুর্জন পণ্ডিতের সাহচর্য ছাড়া এক মিনিটও চলতে পারেন না। ইতিহাসে এমন ঘটনা বহুবার ঘটেছে। এসব কারণে দুনিয়ার সর্বত্র দুর্জন বিদ্বানকে পরিহার করতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। 

সাধারণত দুর্বল চরিত্রের মেধাহীন মানুষ যখন রাষ্ট্রক্ষমতার অধিকারী হয়, তখন সেখানের ক্ষমতাকেন্দ্রিক বদহজম শুরু হয়। ক্ষমতার বদহজমের প্রথম উপসর্গ শুরু হয় ক্ষমতাবান মানুষের কান থেকে। অর্থাৎ এই শ্রেণির শাসকেরা পরের মুখে ঝাল খেয়ে প্রভাবিত হন সবচেয়ে বেশি। তাদের দ্বিতীয় মুদ্রাদোষ হলো- তাদের জ্বিহা-ঠোঁট, স্বরযন্ত্র এবং অঙ্গভঙ্গির অশ্লীলতা, কর্কশতা এবং আচার-আচরণের ভারসাম্যহীনতা। বদহজমে আক্রান্ত ক্ষমতাবান পুরুষেরা প্রায়ই নারীর মতো আচরণ করেন। অন্যদিকে, নারীরা পুরুষের মতো দাপট দেখানোর অপচেষ্টা করেন। তাদের পোশাক-আশাক, খাদ্য, আহার-নিদ্রা এবং কথাবার্তার মধ্যে কোনো ধারাবাহিকতা থাকে না এবং প্রায়ই তারা চমক সৃষ্টির জন্য অদ্ভুত সব কাণ্ডকারখানা করে বেড়ান। 
বিপথগামীর শিকার ক্ষমতাবানদের আচার ব্যবহার,  তাদের সঙ্গী-সাথীদের যোগ্যতা-অভিজ্ঞতা, চরিত্রহীনতা ও মনুষ্যত্বের নিকৃষ্টতার সর্বনিম্ন স্তরের হয়। তারা বহু যত্ন করে সর্বনিকৃষ্ট দুর্জন পণ্ডিত, ধড়িবাজ ও অসৎ বুদ্ধিমান, ডাকাত প্রকৃতির বিত্তমান ও তেলবাজ ও অসৎ কর্মকর্তা-কর্মচারী জোগাড় করে এবং এসব লোক দিয়ে নিজেদের চারপাশে দুর্ভেদ্য দেয়াল তৈরি করে। তারা নিজেদের তৈরি দেওয়ালের অভ্যন্তরে ভোগবিলাস, বিত্তবৈভব এবং অশ্লীল কুকর্মের কারখানা  পরিচালনা করে এবং দেওয়ালের বাইরে হাহাকার, আর্তনাদ, জুলুম অত্যাচার, খুনখারাবি, ধর্ষণ-লুটতরাজা, জোর-জবরদস্তি, চুরি-ডাকাতি ইত্যাদির মহোৎসব ঘটিয়ে নিজেদের সুখ সম্পত্তি ও পারবারিক সম্পদ বৃদ্ধি করতে থাকে। এই ক্ষমতাবানদের আরও একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো- এরা সবসময় মানুষকে কষ্ট দিয়ে আনন্দ লাভ করে এবং প্রতিপক্ষকে অপমান এবং সঙ্গী-সাথীদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে গর্ব অনুভব করে। 
ক্ষমতাধরেরা যদি বুদ্ধির বিপথগামীতার শিকার হয় তবে দেশে যে মহাবিপর্যয় নেমে আসে, তা সামাল দেওয়ার মতো পরিস্থিতি তখন নিরস্ত্র ও সাধারণ মানুষের হাতে থাকে না। 

জ্ঞান-বুদ্ধি-অর্থ এবং ক্ষমতার বিপথগামীতা পরিহার করা কোনও সহজসাধ্য বিষয় নয়। বিপথগামীতার কারণ, পরিবেশ ও পরিস্থিতির ওপর এই রোগের নিরাময় নির্ভর করে।

এইসব বিপথগামী বুদ্ধির লোকেদের শোধরাবার সুযোগ  দিলেও শুধরাবে না। এরা যদি নিজেরা নিজেদের না শুধরাতে সচেষ্ট হয়।একবার এক মদখোর এক গুরুর কাছে গিয়ে বললো--গুরুদেব আমি মদ খাওয়া ছাড়তে চাইছি, কিন্তু হাজার চেষ্টা করেও পারছিনা। গুরুদেব সব শুনে বললেন, ঠিক আছে আগামীকাল ভোরে এসো। লোকটি যথারীতি ভোরে হাজির। গুরুদেবকে দেখতে না পেয়ে, সে হাঁকডাক শুরু করলো। অনেকক্ষণ ডাকাডাকির পর গুরুদেব ভিতর থেকে বললেন, আমি যেতে চাইছি কিন্তু থাম আমাকে যেতে দিচ্ছে না। লোকটা তখন অবাক হয়ে ভেতরে গেল। দেখে গুরুদেব থাম জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তখন লোকটা বললো,গুরুদেব আপনি তো থামটাকে জড়িয়ে ধরেছেন। থাম তো আপনাকে ধরেনি। এইকথা শুনে গুরুদেব থাম ছেড়ে আসনে গিয়ে বসে বললেন, ব্যাটা তুমিও মদকে জড়িয়ে ধরেছো। মদ তোমাকে ধরেনি। তুমি মদ ছেড়ে দিয়ে চলে এসো, সে তোমার নাগাল পাবে না। যেমন আমি থাম ছেড়ে দিয়ে আসনে বসেছি। 
মানুষ খারাপ পথে নিজে যায়।খারাপ পথ কাউকে ধরে রাখে না। (ক্রমশ)

Post a Comment

0 Comments