জ্বলদর্চি

ঘোড়াডিহির অন্তর্ধান রহস্য(উপন্যাস)- ১ / গৌতম বাড়ই

The mystery of Ghoradihi's disappearance.

 অলংকরণ - শ্রেয়সী ভট্টাচার্য্য  

ঘোড়াডিহির অন্তর্ধান রহস্য(উপন্যাস)

গৌতম বাড়ই


 (পর্ব-১)


(তিনটে প্রধান চরিত্র আমার এ উপন্যাসে। তারা ঝেড়ে ফেলতে চায় হাজার বছরের কাঁধে বয়ে নিয়ে চলা বোধ। তারা জীবন দেখে নিজেদের মতন। তারা একে অপরের প্রতি সহানুভূতিশীল আবেগপ্রবণ। তারা জীবনকে দেখে শুধুই একটা  আচমকা ঘটনার উৎস দিয়ে আর মৃত্যু তাদের ভাবনায় ঘটমান একমাত্র সত্যি। সাধের জীবন মেলায় শূন্যতে।আমাদের বহমান চিরাচরিত জীবন তাদের নয়। তাদের জীবন ছকভাঙ্গা এক ভিন্ন মাত্রার। তাদের জীবনেও ঘটে যায় হঠাৎ এক অনভিপ্রেত ঘটনা। তা দিয়েই শুরু আমার এ উপন্যাস।) 

সালতামামির গায়ে কিছু নতুন বছরের পাতলা রোদ। সালতামামি একটা বছর পঁয়ত্রিশের গোঁফ দাঁড়িওলা মানুষ।একটা গোটা মানুষ। ওর কোন খণ্ডতা নেই।ধর্ম নেই।জাত নেই।মায়ের দেওয়া ভাষাটা নিয়ে চলে কারণ অন্য ভাষায় এতটা সড়গড় নয় বলে।তবে কাজ চালানোর মতন আরো দু-তিনটে ভাষা জানে।সালতামামির ঘরের ভেতর ঢুকলাম এই মেঘরোদহাসির সাথে ভর দুপুরবেলা।
মেঘরোদহাসির কথা পরে বলছি। তবে ওর শরীরে ভিন্ন আর এক ধরনের হরমোনের প্রবাহে গোঁফ দাঁড়ি নেই কিন্তু বুকটা ঢেউ খেলে দুটো ভাগে বিন্যস্ত।আমার চোখ কি এক ভালোলাগার জন্য মাঝেমাঝে ঐ ঢেউয়ের দিকে চায়।ওখানেই তো অনন্ত লজ্জা, ওখানেই তো গুটিয়ে নেওয়া, ওখানেই তো যাবতীয় অপবাদ ও অপরাধ বোধ আবার ওখানেই তো চিরন্তন শাশ্বত নবাগত মানবের সৃষ্টির পর আশ্রয়। ওখানেই খোঁজে সৃষ্টির আদিম শান্তি আর স্নেহধারা। মেঘ ও একটা গোটামানুষ  এবং সে জেন্ডার শূন্য মানুষ মনে করে নিজেকে। একটা ডায়েরী আমার সামনে মেলে ধরলো মেঘ। তার একটা পাতার দিকে তাকিয়ে চোখ আটকে গেলো।

জানুয়ারি-০৫/২০২০

ঘোড়াডিহি রাত এগারোটা কুড়ি

পার্ক স্ট্রীটের রাত ছিলো উন্মাদনার।৩১শে ডিসেম্বর ঢুকেছিলাম নিউ ইয়ার্স পার্টিতে। জানুয়ারি ১/২০২০ খুব ভোররাতে ক্লান্ত দেহে বাড়ি ফিরলাম। ক্যাব মওকা বুঝে তিনশো টাকাটা ছয়শো টাকায় রফা করলো। অ্যালকোহল এখন রক্তে মিশে আছে। এই  অ্যালকোহল শরীরটাই আমি যতটা পারি বেশি করে বহন করি। তারপর আর কিছু মনে নেই।

আমি চকিতে হামলে পড়লাম ডায়েরীটার ওপর। হঠাৎ যদি সালতামামি আসে জানি কেস কেলো হয়ে যাবে বা কিছুই হবে না।

মেঘ বললো-জানিস তো সারারাত ধরে সালতা কি যে লিখতো কে জানে!অবশ্য তুইও লিখিস আর আমিও মনমর্জি হলে। অফিস থেকে এসে সময় পেলে।

আমি যদি এই ডায়েরীটা আজকের মতন আমার কাছে নিয়ে যাই তাহলে কোন অসুবিধা আছে?

মেঘরোদহাসি চমকে উঠলো যেন আমার কথাতে।তারপর আমার দিকে কৌতূহলী এক চিলতে হাসিমাখা মুখে বললে-আমার আপত্তি নেই কিন্তু যদি সালতা এসে হাজির হয়? ওর ঐ ডায়েরী একান্ত ব্যাক্তিগত।আমায় কোনদিন পড়েও শোনায় নি আর আমিও টেবিলেই পড়ে থাকে খুলেও দেখিনা। ওটাই তো আমাদের তিনজনের বন্ধুত্বের বিশ্বাস। খোলাবই আমরা। বলি পাতা খোলা আছে পড়ো। পড়ে ভালো লাগতেই পারে আবার নাও লাগতে পারে। যে যেভাবে পারে নাও পড়ে আমাদের। শুধু সালতা ডায়েরী লেখে একান্ত নির্জনে আমি ঘুমিয়ে পড়লে। তাই ওর ওটা ব্যক্তিগত সম্পদ। আমি খুলেই দেখিনি কোনদিন বা পড়িও নি। আজ যে সমস্যার মধ্যে পড়েছি ডায়েরীটা পড়তেই হবে আমাদের। আশঙ্কা নেগেটিভ কিছু লেখেনি তো! তা তুই নিয়ে যা। অসুবিধের কি আছে?

এসেই যদি পড়ে তাহলে আমাকে একবার ফোন করে জানাবি আমি তৎক্ষণাৎ এসে দিয়ে যাবো। আর গভীর রাতে ফিরলে হয়তো ডায়েরীর খোঁজ প্রথমেই নাও করতে পারে। আর করলে একটু ম্যানেজ করবি জাস্ট। ব্যাস! আর তাতেও না বুঝলে কিছু নান্টুঝান্টু আদান প্রদানের পরে দেওয়া হবে।

আমি ঘোড়াডিহি থেকে সেই আলো নিভু নিভু অস্ত বিকেলে ভ্যালেন্টিনো রোসী হয়ে বেরিয়ে পড়লাম। হতভাগ্য এমন এক সময় বিকেল হতে না হতেই সব জেরক্স কপিয়ারের দোকান বন্ধ। আমায় যে করে হোক আজ এই ডায়েরীর জেরক্স চাই।ঘন্টা দুয়েক পর হেঁদুয়ার এক তস্য গলিতে পচা জীবনের বাড়ি টোকা মারলাম।

জীবনের বৌ বেরিয়ে এলো। মাস্কছাড়া।

আমিও একটু তফাতে গিয়ে মাস্ক নামিয়ে জিগ্গেস করলাম-জীবন কোথায়?

জানিনা। আপনি কি আপনার বৌকে সবকিছু বলে বের হন বাইরে?

দেখলাম কথা বাড়িয়ে আর লাভ নেই। একে কি করে বোঝাই এই বেচারার নিজের-ই ছিরিছাঁদ নেই তারপর বৌ পোষা!তারপর মুখটা এমন তিরিক্ষি আর ঝগড়াটে করে আছে নিজের সোয়ামীকে না পেয়ে শালী আমাকেই খিঁচে দেবে মুখ। একটা আইডিয়া মাথায় আসতেই ছুটলাম বিবেকানন্দ রোডের দিকে।তারপর সেন্ট্রাল এভেনিউ পেরিয়ে যদুর ঠেকে।আমাকে ছুটে আসতে দেখে ঠেক থেকে দু-চারজন দে দৌড়।কারো মুখে মাস্ক ঝুলছে আর কারো নেই। করোনা আবহে তো পাড়া রাস্তা সব ফাঁকা ফাঁকাই এখনো। পুলিশের লোক ভাবলো বোধ হয়। তবে পচা জীবন মালটাকে পেয়ে গেলাম।আমায় দেখতে পেয়ে বেজায় খুশি।

গুরু তা এত্তোদিনে মনে পড়লো!আজ তুমি এসেছো বিনা পয়সায় মাল খাবো। বলো কি ব্যাপার?

জীবন বাপ এখনই চল আমার সাথে আমার কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাগজের জেরক্স চাই।

হবে না গুরু। তুমি আমার ড্যাশে যতই ত্যাল দাও।

ভাই তোর পায়ে পড়বো। আমার খুব প্রয়োজন।তোকে আজ রাতে কাল রাতে পরশু রাতে বিনা পয়সায় মাল খাওয়াবো। একটা পাঁইট নিয়ে এসেছি। যা চার্জ লাগবে দোবো। বাপ তুই চল।

জানি জীবনকে নিয়ে ওর বাড়িতে গেলে কিছু কাঁচা খিস্তি তো এদিকেও পড়বে। তবে যা আছে কপালে।এখন আমার জেরক্স চাই যেনতেনভাবে।ওর দোকান ভেতর থেকেই খোলাতে হবে।

মধ্যরাতে বাড়ি ফিরলাম। পুলিশরা চেয়ে চেয়ে দেখলো একটা বাইক মধ্যরাতে দমকা হাওয়া তুলে বেরিয়ে গেলো। বাইকে একটা ছোটো করে সামনে লাল অক্ষরে প্রেস লেখা আছে। তিনবার এরমধ্যে মেঘকে ফোন করেছি।না, সালতামামি ফেরেনি। দুটো চিপসের প্যাকেট আর একটা ঘরে রাখা দেশী বোতল নিয়েই বসবো। ডায়েরীটা আমায় আজ পড়তেই হবে।

কিছু ছেঁড়া পাতা আর দুটো ফাঁকা পাতার পরই দিনলিপির আর একটি পাতা পেলাম। সালতামামি কে আমি জানি-ওর আগুন ওর বিক্ষিপ্ততা ওর জীবন দর্শন কামনা বাসনা। সালতামামি আমার জিগরি দোস্ত।মেঘরোদহাসিও তাই।

জানুয়ারি-১২/২০২০ 
সোদপুর রাত বারোটা চল্লিশ

উহান শহরটা এখান থেকে কত দূরে?

আমি তড়াক করে লাফিয়ে উঠলাম। উহান! আর সোদপুর তো মেঘের নিজের বাড়ি। মেঘের বাড়ি। ওটা বাপের বাড়ি বলা যাবে না। মেঘরোদহাসিকে ও কথা বললেই বলবে--লাথি মেরে গলিয়ে দেবো শালা!আপনা মাকান আপনা ঘর। উহান থেকেই তো করোনা ভাইরাসের বিস্তার!তবে শরীর আর নিতে পারছে না। আমি বিছানায় ঢুলে পড়লাম।

এরপর পরের পর্বে----

(উহানের সেই বিভীষিকাময়  পথের দিকেই কি পাড়ি দেবো আমরা? সালতামামির ডায়েরীতে কি আছে?পরের পর্বে। কেমন লাগছে জানাবেন পাঠক। এখন এই ই-মিডিয়ার সুবিধা তো লেখক আর পাঠকের নিবিড় যোগাযোগ। আমার লেখক বন্ধুদের দিকেও তাকিয়ে রইলাম। জানাবেন। সালতামামির বিচিত্র এক জীবন উঠে আসবে এখানে)

Post a Comment

0 Comments