বলাগড়ের রোদ-বৃষ্টির খাতা
প্রথম পর্ব
অয়ন মুখোপাধ্যায়
একটা জামার গল্প
বলাগড় ব্লকের কামালপুর গ্রাম। শরতের দুপুর, পুজো আসছে। কাশফুল দুলছে বাতাসে, আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে তুলোর মতো মেঘ। পরাধীন ভারতবর্ষের খামারগাছির সিযা বাজারে চৌরাস্তায় কয়েকজন বসেছিল। হঠাৎ মদন দা বললেন,
“কাল বটগাছতলায় আসর বসবে। যার যার বিদেশি কাপড় আছে নিয়ে এসো। আগুনে ফেলে আমরা প্রতিবাদ জানাব।”
সবাই চুপ। কেউ সাড়া দিল না। ভিড়ের মধ্যে তখন ছিল কামালপুর জমিদার বাড়ির ছেলেটি—সুনীল। বয়সে ছোট, কিন্তু চোখে জেদ। সে বলে উঠল,
“বিদেশি জামা গায়ে তুললে নিজের শরীর ছোট হয়ে যায়। তাই না কাকা?”
মদন দা খুশি হলেন। বললেন, “ঠিকই বলেছিস।”
একজন ঠাট্টা করে বলল, “শোন বাবা, জামার কাপড়ে আবার দাসত্ব আসে নাকি?”
সুনীল গম্ভীর স্বরে উত্তর দিল, “আসে।”
ভিড় হেসে উঠল। কেউ বলল, “তাহলে তো আমরা বহু আগেই দাস হয়ে গেছি।”
মদন দা মনখারাপ করে বসে রইলেন। বুঝলেন, বড়দের ভেতর আর প্রতিবাদের শক্তি নেই। সুনীল কিছু বলল না। শুধু তার চোখে সেই অদ্ভুত জেদ ঝলসে উঠল।
কিছুদিন পর, বলাগড় উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াশোনার সময় ঘটল সেই বিখ্যাত ঘটনা। গ্রামে সার্কাস বসেছে। সাহেব এক বিশাল মুগুর মঞ্চে রেখে বলল,
“এই মুগুর কেউ তুলতে পারবে না। যদি তোলো, পুরস্কার দেব। তবে তোমরা নেটিভ কালা আদমি—তোমাদের দ্বারা হবে না।”
সারা মাঠে অপমানের ছায়া নেমে এল। মাস্টারমশাইরা মাথা নিচু করে বসে রইলেন। হঠাৎ উঠে দাঁড়াল সুনীল। সবাই অবাক। সে এগিয়ে গেল সাহেবের সামনে, চোখে চোখ রেখে একটানে তুলল মুগুর। হাততালিতে ফেটে পড়ল মাঠ।
🍂
সাহেব বাধ্য হয়ে টাকা বাড়িয়ে ধরল। সবার মনে হলো—সুনীলের সংসারের অভাব মিটে যাবে। কিন্তু সবার বিস্ময়ের সামনে সুনীল টাকাটা ফিরিয়ে দিয়ে বলল,
“সাহেব, এই টাকা দিয়ে তোমাদের দেশের লোককে দুধ খাওয়াও। আমি দাস নই, আমি ভারতীয়।”
চারদিক হাততালিতে কেঁপে উঠল। সেই দিন থেকে গ্রামের পর গ্রামে ছড়িয়ে গেল গল্পটা। আজও কেউ কেউ বলে—শিশুকালে সুনীল জানালার রড বেঁকিয়ে ফেলতে পারত। সেই বাঁকানো রড এখনও আছে তার বাড়িতে।
রক্তে আগুন ছিল তার। মামা ছিলেন বাঘাযতীন। তাই চরিত্রেও দৃঢ়তা।
স্কুল থেকে অসাধারণ ফল নিয়ে বেরিয়ে এলো সুনীল। সংসারের হাল ধরতে চাকরি নিল সেনাবাহিনীতে। বিদায়ের সময় মা কেঁদে ফেলেছিলেন। সুনীল হাসিমুখে বলল,
“বেঁচে থাকলে তো ফিরবই। না বেঁচে থাকলেও ফিরব, তবে ফুলে ঢাকা হয়ে।”
সেনাবাহিনীতে গিয়েই সবার নজরে এল সে। আলাপ হলো মান কুমার বসু ঠাকুর নামে বাংলাদেশের এক তরুণ সৈনিকের সঙ্গে। বন্ধুত্ব জমে গেল। এদিকে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু সৈন্যবাহিনী নিয়ে স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। নেতাজির নাম উচ্চারিত হলেই সুনীলদের বুক কেঁপে উঠত। ইংরেজদের হয়ে কাজ করার ইচ্ছে হারিয়ে যাচ্ছিল।
মান বসু ঠাকুরের নেতৃত্বে কোচিনে শুরু হল সৈন্যদের নিয়ে এক গোপন বিপ্লবী প্রচেষ্টা। সুভাষচন্দ্র বসুর নির্দেশে তারা ইংরেজ অস্ত্রাগারের অস্ত্র জলে ফেলে দিত, জ্বালানি নষ্ট করে দিত, ইংরেজদের গোপন খবর নেতাজির কাছে পৌঁছে দিত। আরও সাতজন সৈনিক মিলে পরিকল্পনা এগিয়ে চলছিল। সুভাষচন্দ্র বসুর ডাক বুকের ভেতর গর্জে উঠছিল।
কিন্তু একজনের বিশ্বাসঘাতকতায় সব ভেস্তে গেল। ইংরেজরা খবর পেয়ে গেল। গভীর রাতে ধরা পড়ল সুনীল আর তার সঙ্গীরা। শিকল পরানো হলো।
অন্ধকার কারাগারে বসে সে কাকা শ্যামাকান্তকে লিখল শেষ চিঠি—
“আমি জানি না, কী অপরাধে মৃত্যুদণ্ড হয়েছে। তবে দেশের জন্য মরতে আমার কোনো আক্ষেপ নেই।”
২৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৪৩। ভোর হয়নি তখনও। জেলের আঙিনায় ফাঁসির দড়ি ঝুলছে। সুনীল হাসিমুখে এগিয়ে গেল, যেন সূর্যোদয়ের দিকে হাঁটছে। গলায় দড়ি পড়ার আগে ঠোঁটে ফিসফিস—
“বন্দে মাতরম্।”
দড়ি নেমে এল। নিস্তব্ধতা ছেয়ে গেল চারপাশে।
কয়েকদিন পর ইংরেজ সেনারা সুনীলের ব্যবহৃত জিনিসপত্র তার মায়ের কাছে পাঠাল। তার মধ্যে ছিল একখানা জামা—রক্তমাখা, শুকিয়ে কালচে দাগ পড়েছে। সেদিন গোটা গ্রাম ভেঙে পড়েছিল কান্নায়।
গ্রামের বটতলায় ভিড় জমল। জামাটা বিছিয়ে দেওয়া হলো। সবাই চুপ করে তাকিয়ে রইল। কারো মুখে কোনো শব্দ নেই। কাশফুল দুলছিল বাতাসে।
মনে হচ্ছিল, সেই জামার ভেতর থেকেই ভেসে আসছে সুনীলের কণ্ঠ—
“বিদেশি জামা ছাড়ো।মৃত্যু কে ভয় পেয়ো না।
কামালপুর গ্রাম আজও সেই জামার কথা মনে রাখে আজও কাশফুল দোলে, বটতলায় ছায়া নেমে আসে, আমরা আজও শুনতে পাই সুনীলের কন্ঠ.....
9 Comments
দারুণ, তথ্যবহুল অথচ সংবেদী...
ReplyDeleteধন্যবাদ
Deleteলেখাটা পড়ে কিছুক্ষণ চুপ করে বসেছিলাম,, কী যে লিখি !! কত সহজ ভাষায় লেখা অথচ মনের গভীরে রেখাপাত করলো,,মন ছুঁয়ে গেলো !! এমনই আরো কিছু গল্প,, প্রবন্ধ,,কবিতার অপেক্ষায় থাকলাম।
ReplyDeleteধন্যবাদ
Deleteপড়া শেষ করে ভাবনার গভীরে ডুব দিলাম।
ReplyDeleteধন্যবাদ
Deleteদারুণ, তথ্যবহুল অথচ সংবেদী...
ReplyDeleteধন্যবাদ
Deleteভালো লাগলো
ReplyDelete