জ্বলদর্চি

প্রাণবল্লভ ঘোষ /ভাস্করব্রত পতি

মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ১৭২
প্রাণবল্লভ ঘোষ

ভাস্করব্রত পতি

'কাশীজোড়ার কাঁইকুঁই মণ্ডলঘাটের ধারা। 
চেতুয়ার বন্দোবস্ত কুতুবপুরের গেরা।।'
প্রাচীনকালের বহুল আলোচিত 'চেতুয়া বন্দোবস্ত' নিয়ে এই আঞ্চলিক ছড়াটি বেশ জনপ্রিয় ছিল একসময়। ঘাটাল মহকুমার এই চেতুয়া পরগনার অন্তর্গত বাসুদেবপুর গ্রামে কবি প্রাণবল্লভ ঘোষ 'জাহ্নবীমঙ্গল' নামে একটি কাব্য রচনা করেছিলেন। পুঁথিটির অনুলিখন হয়েছিল ১১৩১ বঙ্গাব্দের ৫ জ্যৈষ্ঠ তথা ১৭২৪ সালে (১৬৪৬ শকাব্দ)। এর লিপিকর ছিলেন আম্বুয়া পরগনার বাসিন্দা সীতারাম দাস সুর। পুঁথিটির লিপিকালে কবি জীবিত ছিলেন বলে জানা যায়। 'জাহ্নবীমঙ্গল' পুঁথিটি ছিল ষোড়শ শতকের শেষে মাধবাচার্যের লেখা 'গঙ্গামঙ্গল' কাব্যের এক বৃহত্তম কাব্য। উল্লেখ্য যে, এই পুঁথিটির আবিষ্কারক ছিলেন চেতুয়া বাসুদেবপুর নিবাসী শ্রীযুক্ত পঞ্চানন রায় কাব্যতীর্থ জ্যোতির্বিনোদ। 

বাসুদেবপুর গ্রামের বাসিন্দা ব্রজবল্লভ রায়ের বাড়িতে পুঁথিটির লিপি সমাপন হয়। এই পুঁথির মোট পত্র সংখ্যা ছিল ১৭৪ টি। কিন্তু ৩৫ টি পত্র হারিয়ে যাওয়ার দরুন আপাতত ১৩৯ টি বিদ্যমান। উল্লেখ্যনীয় যে, ঘাটালের দাসপুর এলাকার কবি, প্রাবন্ধিক ও লেখক ড. পুলক রায় "গঙ্গামঙ্গল কাব্য এবং প্রাণবল্লভ ঘোষের জাহ্নবীমঙ্গল কাব্য" বিষয়ের ওপর গবেষণা করে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন। অখ্যাত এই কবিকে সকলের সামনে তুলে ধরেছেন তিনি। 

তখন আঠারো শতকের প্রথম দিক। চলছে নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ'র রাজত্ব। নবাবের রাজস্বকর্মী হিসেবে বর্ধমানের অম্বিকা কালনা থেকে ১৭২২ -১৭২৩ সালে মেদিনীপুরে আসেন জনৈক প্রাণবল্লভ ঘোষ। মূলতঃ মেদিনীপুর জেলার চেতুয়া পরগনার বন্দোবস্তের জন্য তিনি এসেছিলেন। তিনি ছিলেন নবাব মুর্শিদকুলির রাজস্ব বন্দোবস্তের সময়ের একজন সুদক্ষ কর্মচারী। তখন ঘাটালের চেতুয়া (ডিহিচেতুয়া) গ্রামে এই কাজের সদর কার্যালয় ছিল। তিনি এখানে ছিলেন ১১৩১ সালের মাঘ মাস থেকে ফাল্গুন মাস পর্যন্ত। যতদূর জানা যায়, চেতুয়া পরগনার রাজস্ব আদায়ের জন্য যুগ্মভাবে নিয়োজিত ছিলেন কবি প্রাণবল্লভ ঘোষ এবং রামচন্দ্র রায়। 

১১০৪ বঙ্গাব্দে বর্ধমানের রাজা কীর্তিচন্দ্রের রাজত্বকালে তাঁরই মায়ের অনুরোধেই কবি এই কাব্যটির রচনা শুরু করেছিলেন বলে জানা যায়। এ প্রসঙ্গে ড. প্রনব রায় লিখেছেন, "পুঁথির একটি পৃষ্ঠায় বর্ধমানরাজ কীর্তিচন্দ্র ও তাঁর 'কৃষ্ণপরায়ণী' জননীর উল্লেখ থেকে এই ১১০৪ সালকেই কাব্যের জন্মকাল বলে মনে করা যেতে পারে। শোভা সিংহের বিদ্রোহের ফলে ১৬৯৬ খ্রীস্টাব্দে কীর্তিচন্দ্রের পিতা জগৎরাম ঢাকায় পলায়ন করলে কীর্তিচন্দ্রের মাতা কিছুকাল রাজ্যশাসন করেছিলেন। বর্ধমান রাজবংশে রাজমহিষীও যে রাজ্যশাসন করতেন তার প্রমাণ ১৭৭৬ খ্রীস্টাব্দে তেজশ্চন্দ্রের মাতার কিছুকাল রাজ্যশাসন। কীর্তিচন্দ্রের মাতার শাসনকাল ১৬৯৭ খ্রীস্টাব্দ, বাংলা ১১০৪ সাল। তাই পুষ্পিকায় উল্লিখিত এই সালকে প্রকৃত কাব্যরচনার কাল ধরলে অন্যায় হবে না। আর এ সময় থেকে লিপিকালের ব্যবধান মাত্র ২৭ বৎসর। কবি প্রাণবল্লভ তখন নিশ্চয়ই বৃদ্ধত্বের সীমায় পা দিয়েছেন। কাজেই ১৭২৪ খ্রীস্টাব্দের পর আর বেশিদিন তাঁর জীবিত না থাকাই সম্ভব। কর্মাবস্থায় চেতুয়ার বাসুদেবপুরে থাকাকালীন কবির দেহত্যাগও অসম্ভব নয়। পুঁথিটি এই গ্রাম থেকে আবিষ্কৃত হওয়ায় এ অনুমান হয়।"

প্রাণবল্লভের 'জাহ্নবীমঙ্গল' কাব্যে এগারো দিনের উনিশটি পালাগান দেখা যায়। কবির লেখায় আছে --
'একাদশ দিন কথা পুন করি গান। 
তিথিমধ্যে একাদশী প্রভু নারায়ন।। 
একাদশ রুদ্র শিব জানে জগজন। 
একাদশ স্কন্ধ গ্রন্থ পোতা ভাগবত।। 
একাদশ দিন কথা শুন পূর্ব্বমত।।'
এই উনিশটি পালার প্রথম দুদিন হয় নিশাপালা, তৃতীয় দিন থেকে দশম দিন পর্যন্ত প্রতিদিন দিবাপালা ও নিশাপালা। দশম দিনের নিশাপালাকে বলা হয় 'জাগরণ'। এই অংশে গঙ্গার বিবাহ বর্ণিত রয়েছে। একাদশ দিনের সকালের পালায় কাব্যের ফলশ্রুতি ও ভারতকথা বলা হয়েছে। কাব্যে কোথাও কবি তাঁর নিজের পরিচয় উল্লেখ করেননি। কেবলমাত্র উল্লেখ করেছেন তাঁর পিতা হিসেবে বংশী ঘোষের নাম। ফলে কবি সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায় না। আদপে বর্ধমানে জন্ম হলেও মেদিনীপুরের মাটিতে তিনি পরিপুষ্ট হয়েছিলেন। তাই মেদিনীপুর জেলার 'মানুষ রতন' হিসেবে আখ্যায়িত করাই যেতে পারে।
 
এই কাব্যের কাহিনি পৌরানিক, কিন্তু এটি অনুবাদকাব্য নয়। ড. প্রনব রায় লিখেছেন, "কবি প্রধানত মহাভারত, নারদীয়, ব্রহ্ম ও পদ্মপুরাণের ক্রিয়াযোগসার অবলম্বনে কাব্যটি রচনা করলেও স্বকীয় প্রতিভা ও কবিত্বশক্তিতে পুরাণের নীরস ও বৈচিত্র্যহীন কাহিনীকে সরস অথচ 'ভকতজনে'র হৃদয়গ্রাহী করে পরিবেশন করেছেন। ভক্ত কবি শ্রোতৃবৃন্দকে গঙ্গা ও হরির অভিন্নত্বের বিষয় বারবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। মহাপাপীরাই এঁদের উভয়ের ভেদ করে থাকেন। কবি তাই বিষয় বারবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। মহাপাপীরাই এঁদের উভয়ের ভেদ করে থাকেন।" 

'জাহ্নবীমঙ্গল' কাব্যের ভাষা অত্যন্ত মাধুর্যপূর্ণ এবং খুব সুন্দর। কবি এক জায়গায় বলেছেন --
'জাহ্নবীমঙ্গল গীত অমৃত লহরী। 
পিতভ ভকতলোক কর্ণপুট ভরি।।'
আসলে কবি প্রাণবল্লভ ঘোষ গঙ্গা এবং হরির অভিন্নত্ব দেখিয়েছেন। সেইসাথে হরিনাম শ্রবণের মতো গঙ্গা মাহাত্ম্য শ্রবণেও যে সমস্ত পাপ দূর করা যায় তা বোঝাতে গঙ্গামাহাত্ম্য বর্ণনা করেছিলেন।
🍂

Post a Comment

0 Comments