জ্বলদর্চি

শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ সঙ্গীতামৃত -২৩/ সুদর্শন নন্দী

পর্ব-২৩

শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ সঙ্গীতামৃত  

সুদর্শন নন্দী

ঠাকুরকে যারা গান শুনিয়েছেন অর্থাৎ যারা গান গেয়েছেন উল্লেখযোগ্য তাঁদের কয়েকজন সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করলাম (শেষ অংশ)
তারাপদ -- ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের সান্নিধ্যে আগত সুপ্রসিদ্ধ গায়ক। বলরাম বসুর ঘরে গিরিশচন্দ্র ঘোষ প্রমুখ ভক্তদের সাথে তিনি ঠাকুরের দর্শনলাভে ধন্য হন। সেই সময়ে গায়ক হিসাবে তাঁর পরিচয় জানতে পেরে ঠাকুর তাঁর গান শুনবার আগ্রহ প্রকাশ করেন। তারাপদ গিরিশ ঘোষের “কেশব কুরু করুণা দীনে” গানটি শোনালে ঠাকুর সন্তুষ্ট হন এবং ঠাকুরের অনুরোধে তিনি আরও কতকগুলি ভজন ও কীর্তন গেয়ে শোনান।

নবাই চৈতন্য -- প্রকৃত নাম নবগোপাল মিত্র। শ্রীরামকৃষ্ণের গৃহীভক্ত মনোমোহন মিত্রের জ্যেষ্ঠতাত। তিনি দক্ষিণেশ্বরে প্রায়ই আসতেন এবং শ্রীশ্রীঠাকুরের কথামৃত শুনতেন এবং উচ্চ সংকীর্তনাদি করতেন। পানিহাটীর উৎসবে শ্রীশ্রীঠাকুরের বিশেষ কৃপালাভ করে ধন্য হন তিনি। তিনি শ্রীরামকৃষ্ণের দর্শন ও কৃপালাভ করার পরে সংসারের ভার পুত্রের উপর দিয়ে কোন্নগরে গঙ্গাতীরে পর্ণকুটিরে জপধ্যান ও কীর্তনাদি করতেন। ১৮৮২ খ্রীষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁহার গৃহে পদার্পণ করেছিলেন।
কেদার (কেদারনাথ চট্টোপাধ্যায়) -- ঠাকুরের বিশেষ কৃপাপ্রাপ্ত গৃহীশিষ্য। হালিশহরবাসী কেদারনাথের আদি নিবাস ঢাকায়। তিনি ঢাকাতে সরকারি অফিসে অ্যাকাউটেন্টের কাজ করতেন। ১৮৮০ খ্রীষ্টাব্দে ঠাকুরের দর্শন লাভ করেন। কেদারনাথ প্রথমজীবনে ব্রাহ্মসমাজ, কর্তাভজা, নবসরিক প্রভৃতি বিভিন্ন সম্প্রদায়ে যোগদান করেন এবং অবশেষে দক্ষিণেশ্বরে শ্রীরামকৃষ্ণের শরণাগত হন। ঢাকায় থাকা কালে শ্রীশ্রীবিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর সাথে শ্রীরামকৃষ্ণ বিষয়ে তাঁর আলোচলা হত। কর্মস্থল ঢাকা থেকে কলিকাতায় এলে তিনি দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের নিকট যেতেন। ঠাকুর নরেন্দ্রনাথের সাথে কেদারনাথের নানাবিষয়ে তর্ক বাধিয়ে বেশ আনন্দ উপভোগ করতেন।
ভূপতি -- কলিকাতার রাজবল্লভ পাড়ায় জন্ম। বলরাম-মন্দিরে ঠাকুরকে প্রথম দর্শন করেন এবং পরেদক্ষিণেশ্বরে যাতায়াত করিতেন। ঠাকুর একদিন ভাবাবিষ্ট হয়ে তাঁকে স্পর্শ করলে তাঁর উচ্চ অনুভূতি হয়। পরবর্তীকালে তাঁর শিষ্যগণ বারাসতের হৃদয়পুরের কোঁড়া অঞ্চলে ‘ঋষভ আশ্রম’ প্রতিষ্ঠা করেন।

কেশব কীর্তনীয়া -- ঈশান মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে শ্রীরামকৃষ্ণদেবের সাথে এনার প্রথম সাক্ষাৎ হয়। এদিন শ্রীরামকৃষ্ণদেবকে কীর্তন শুনিয়েছিলেন।
কোন্নগরের গায়ক -- হুগলী জেলার কোন্নগর নিবাসী জনৈক উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের গায়ক। দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরকে নানাপ্রকার কালোয়াতি গান শুনিয়ে মুগ্ধ করেছিলেন।
ভবনাথ [ভবনাথ চট্টোপাধ্যায়] (১৮৬৩ - ১৮৯৬) -- ঠাকুরের গৃহীভক্ত ভবনাথ চট্টোপাধ্যায়ের বরাহনগরে বর্তমান অতুলকৃষ্ণ ব্যানার্জী লেনে জন্ম। পিতামাতার একমাত্র সন্তান ভবনাথ যৌবনের প্রারম্ভ থেকেই নানা জনহিতকর কার্যে নিযুক্ত থাকতেন। ব্রাহ্মসমাজে যাতায়াত নরেন্দ্রনাথের সাথে বন্ধুত্ব, শিক্ষকতা করা এবং সর্বোপরি ১৮৮১ খ্রীষ্টাব্দ নাগাদ শ্রীশ্রীঠাকুরের সান্নিধ্যলাভ তাঁর জীবনের স্মরণীয় ঘটনা। নরেন্দ্রনাথের সাথে  তাঁর অন্তরিকতা দেখে ঠাকুর ওদের ‘হরিহরাত্মা’ বলতেন। তিনি সুগায়ক ছিলেন, বহুবার ঠাকুরকে গান শুনিয়েছিলেন। ‘নীতিকুসুম’ ও ‘আদর্শনারী’ তাঁহার রচিত দুইখানি গ্রন্থ। তাঁরই আহ্বানে বরানগরের অবিনাশ দাঁ দক্ষিণেশ্বরে আসিয়া তাঁহার ক্যামেরায় ৺বিষ্ণু মন্দিরের দালানে সমাধিস্থ অবস্থায় শ্রীশ্রীঠাকুরের বহুল প্রচারিত ছবি তোলেন।  
ঠাকুরদাদা-বরানগরনিবাসী ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের পুত্র।  ণদাস বন্দ্যোপাধ্যায়য়নারা নাম।তিনি কথকতা অভ্যাস করতেন। সাধারণতঃ “ঠাকুরদা” বলেই তিনি পরিচিত ছিলেন। ২৮ বৎসর বয়সে বরানগর থেকে হেঁটে ঠাকুরকে দর্শন করতে আসেন।  ঠাকুরদাদা  ঠাকুরকে গান শুনিয়ে বিশেষভাবে প্রীত হন।  এছাড়া ঠাকুরের উপদেশামৃতশুনিবার সৌভাগ্য তাঁর হয়েছিল।
রামলাল -- ঠাকুরের মেজদা রামেশ্বর চট্টোপাধ্যায়ের জ্যেষ্ঠ পুত্র। ঠাকুর তাঁকে স্নেহভরে “রামনেলো” বলিয়া ডাকতেন। এবং বেলুড় মঠের সকলের নিকট তিনি “রামলাল দাদা” নামে পরিচিত ছিলেন। রামেশ্বর দেহত্যাগের পর তিনি দক্ষিণেশ্বরে ৺ভবতারিণীর পূজকের পদে নিযুক্ত হন এবং আজীবন সেই দায়িত্ব পালন করেন। তিনি সুগায়ক ছিলেন। শ্রীশ্রীঠাকুরকে অনেকবার গান শুনিয়েছেন। ঠাকুর কাশীপুরে কল্পতরু দিবসে রামলালকেও কৃপা করেন।

নীলকণ্ঠ [নীলকণ্ঠ মুখোপাধ্যায়] (১৮৪১ - ১৯১১) -- ইনি বর্ধমানের ধরণী গ্রামের  বিখ্যাত যাত্রাওয়ালা। গোবিন্দ অধিকারীর যাত্রা দলে প্রথম ছিলেন। সুগায়ক নীলকণ্ঠ কৃষ্ণযাত্রায় দূতীর ভূমিকায় অভিনয় করতেন। ভাল সংস্কৃত জানতেন। গোবিন্দ অধিকারীর মৃত্যুর পর তিনি তাঁর যাত্রা দলের মালিক হন। কবিত্ব শক্তির জন্য বিখ্যাত ছিলেন। তাঁর রচিত ‘কৃষ্ণযাত্রা’ বর্ধমান, বীরভূম, মুর্শিদাবাদ এবং বাঁকুড়ায় খুব খ্যাতিলাভ করেছিল। নীলকণ্ঠ দক্ষিণেশ্বরে শ্রীরামকৃষ্ণকে গান শুনিয়ে মুগ্ধ করেন। ঠাকুরও তাঁকে গান শুনিয়ে ধন্য করেছিলেন। নীলকণ্ঠের যাত্রা অনুষ্ঠান দেখতে আগ্রহী শ্রীরামকৃষ্ণ হাটখোলার বারোয়ারী তলায় গিয়েছিলেন। পরে আর একবার ঠাকুর ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দের অক্টোবর মাসে নবীন নিয়োগীর ঘরে  আমন্ত্রিত হয়ে নীলকণ্ঠের যাত্রা শোনেন। সেদিনও তিনি সমাধিস্থ হন। তাঁর মধুর কণ্ঠে গান শুনে ঠাকুর বিভোর হয়ে যেতেন।  

বিহারী (বিহারী মুখোপাধ্যায়) -- শ্রীরামকৃষ্ণের ভক্ত। বীরভূমের অধিবাসী, চাকরির খোঁজে কলকাতা আসেন। ভাগ্যক্রমে দেবেন্দ্রনাথ মজুমদারের সংস্পর্শে আসেন এবং তাঁর আশ্রয় লাভ করেন। পরবর্তীকালে তিনি দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে শ্রীরামকৃষ্ণের নিকটে যান এবং তাঁর আশীর্বাদ প্রাপ্ত হন। শ্যামপুকুরের বাড়িতে বিহারী কালীপূজা দিবসে স্তব ও গান করেছিলেন।
বৈষ্ণবচরণ -- প্রখ্যাত কীর্তনীয়া। বলরাম বসু, অধরলাল সেন প্রভৃতি অনুরাগীদের বাড়িতে শ্রীরামকৃষ্ণ কয়েকবার বৈষ্ণবচরণের কণ্ঠে কীর্তনগান শোনেন। শ্রীরামকৃষ্ণের নির্দেশে অধর সেন প্রতিদিন তাঁর নিকট কীর্তন শুনতেন। বৈষ্ণবচরণের মুখে ঠাকুর এই বিশেষ গানটি শুনতে ভালবাসতেন -- “দুর্গানাম জপ সদা রসনা আমার, দুর্গমে শ্রীদুর্গা বিনে কে রে নিস্তার ।” বৈষ্ণবচরণের গানে ঠাকুরের ভাবসমাধি হত এবং ভাবাবিষ্ট অবস্থায় তিনি নৃত্যও করতেন। বৈষ্ণবচরণ শ্রীরামকৃষ্ণকে বিশেষ ভক্তি করতেন।
ঋণস্বীকারঃ স্বামী লোকেশ্বরানন্দের সম্পাদনায় “শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণের প্রিয় সঙ্গীত” (প্রকাশকঃ রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অফ কালচার, গোলপার্ক,কলকাতা), মহেন্দ্রনাথ গুপ্তের শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ কথামৃত (উদ্বোধন), শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণলীলাপ্রসঙ্গ (স্বামী সারদানন্দ,উদ্বোধন), শ্রীরামকৃষ্ণ ভক্তমালিকা (স্বামী গম্ভীরানন্দ, উদ্বোধন)ইত্যাদি গ্রন্থ ছাড়া এই লেখা সম্ভব হত না। জয় শ্রীরামকৃষ্ণ।
(শেষ)
-------------
আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments